Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

জেলা কোলাজ

জেলা এখন আর জংলায় আঁধার-আঁধার নয়, সাফাচাট। টাকা, ফ্ল্যাট, চিপ্সের জ্যালজেলে প্যাকেট উড়ছে। ঘন ঘন রিচার্জড হচ্ছে জীবন।ফ্ল্যাটের ব্যালকনির রেলিঙে ক্লিপ দিয়ে আটকানো হলদেটে পাজামা। ছেঁড়া গামছা। এই আবাসনটা নতুন। তিন তলা। বট্ল গ্রিন আর অরেঞ্জের ওয়েদারকোট কালারের কম্বিনেশন। ঝকঝকে। উনত্রিশশো টাকা প্রতি স্কোয়ার ফিট। তিন চারে বারোটা ফ্ল্যাট। বারো ঘর। উঠোন? ফ্ল্যাটে উঠোন? প্রতিটা ফ্ল্যাটের সামনে একরত্তি ব্যালকনি। চারচৌকো যাপনের রেলিং দেওয়া স্বাধীনতা। যে ব্যালকনিতে পাজামা আর গামছা শুকোচ্ছে, ওটা জমির মালিকের ফ্ল্যাট। জমির বদলে ফ্ল্যাট আর নগদ টাকা পেয়েছেন। নাকের বদলে নরুন?

ঋষিগোপাল মণ্ডল
শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০১৪ ০০:৩০
Share: Save:

ফ্ল্যাটের ব্যালকনির রেলিঙে ক্লিপ দিয়ে আটকানো হলদেটে পাজামা। ছেঁড়া গামছা। এই আবাসনটা নতুন। তিন তলা। বট্ল গ্রিন আর অরেঞ্জের ওয়েদারকোট কালারের কম্বিনেশন। ঝকঝকে। উনত্রিশশো টাকা প্রতি স্কোয়ার ফিট। তিন চারে বারোটা ফ্ল্যাট। বারো ঘর। উঠোন? ফ্ল্যাটে উঠোন? প্রতিটা ফ্ল্যাটের সামনে একরত্তি ব্যালকনি। চারচৌকো যাপনের রেলিং দেওয়া স্বাধীনতা। যে ব্যালকনিতে পাজামা আর গামছা শুকোচ্ছে, ওটা জমির মালিকের ফ্ল্যাট। জমির বদলে ফ্ল্যাট আর নগদ টাকা পেয়েছেন। নাকের বদলে নরুন?

জেলা শহরটা দ্রুত বাড়ছে। চার দিকে রিয়েল এস্টেটের রকমারি বিজ্ঞাপন। একটায় পরির মতো ফুটফুটে একটা বাচ্চাকে জড়িয়ে মডেল বাবা-মায়ের ছবি। সবাই হাসছে। মডেল-মা দু’একটা বাংলা সিনেমায় ছোট-কাঁচুলির আইটেম-গার্ল ছিলেন। এখন কপালে বড় লাল সিঁদুর-টিপ। এলাকাটা এক সময় জংলায় আঁধার-আঁধার ছিল। এখন সাফাচাট। মার্বেল হাইট্সের জায়গায় বিশাল একটা বিল ছিল। জলার ধারে যজ্ঞিডুমুর, হেলেঞ্চা শাক, শোলা কচু, কচুর লতি, হোগলার বন। অগুনতি ডাহুক। উলের বলের মতো ছানা-ডাহুকদের নিয়ে ডাহুক-মা খুব সন্তর্পণে পা ফেলে ফেলে হাঁটত। এক দিন উদ্বাস্তু হতে হবে এই আশঙ্কায়? আরও উত্তরে গেলে শেয়ালডাঙা। এক সময় শেয়াল ঘুরে বেড়াত। বেশ কয়েক বছর ধরেই ধানজমি বুজিয়ে প্লট করে জমি বিক্রি হচ্ছে। স্পঞ্জ আয়রন, টিএমটি বার, পটেটো চিপ্সের ছোট-বড় প্রচুর কারখানা হয়েছে। শেয়াল নেই আর। শেয়ালডাঙা নামটাও ভুলে যাচ্ছে সবাই। নতুন নাম ‘প্লট ফর্টি’। নামেও তো কত কী আসে যায়!

প্লট ফর্টির ডান দিকে মনীষীদের ছড়াছড়ি। সুকান্তনগর, সূর্যপল্লি, সুভাষপল্লি, অরবিন্দনগর, নেতাজিনগর। এক সময় ও-পার বাংলার উদ্বাস্তুদের কলোনি। উদ্বাস্তুরা আবারও উদ্বাস্তু হয়ে সরে গেছে। কোথায়? কলোনিয়াল হ্যাংওভার কাটিয়ে আকাশচুম্বী আবাসনগুলো নিজেদের নাম থেকে কলোনির গন্ধ মুছে দিচ্ছে। বৃন্দাবন গার্ডেন, গ্রিন পার্ক, ইন্দ্রকানন। গার্ডেন-ভ্যালি-হাইট্স’এ বিবর্ণ পায়জামা আর ছেঁড়া গামছা বেমানান। জেলার জমির মালিক ফ্ল্যাট-কলচর শিখে উঠতে পারেনি এখনও।

রিং রোডটা জেলার বৃহত্তর, উন্নততর আর পরিবর্তিত এলাকাটাকে বুড়িছোঁয়া করে নদীর সাগরে মেশার সার্থকতার মতো সোজা হাইওয়েতে গিয়ে মিশেছে। হাইওয়ের উন্নয়নের ঝকঝকে বিস্তার আর গতি রিং রোড বরাবর এসে মিশে যাচ্ছে জেলা শহরের বাড়তি শরীরে। এই শরীর চড়তি-উভর্তি জওয়ানির মতো। হাওয়ায় হাওয়ায় ছড়িয়ে দেওয়া সিলিকন ইমপ্ল্যান্টের গল্পের মতো উদ্ভিন্ন। আকর্ষক। আবাসনগুলোকে সামনে রেখে খানিকটা পিছিয়ে এলে রিং রোডের পাশেই পুরনো বাজার। বাজারের দোকানিরা ফ্ল্যাটের বাবুদের স্যর বলে ডাকে। বিবিদের ম্যাডাম। এলাকার পুরনো লোকেদের কিছুই বলে না।

লাল সিমেন্টের মেঝেওয়ালা মাংসের দোকান। পাশে চিকেন সেন্টার। তার পর মাছবাজার শুরু। ডান দিকে ফলের দোকান। পুরনো দশকর্মা ভাণ্ডার। লক্ষ্মী-গণেশের ছোট মূর্তি সেলোফেনে মুড়ে দোকানের তাকে রাখা আছে। পুজোর আগে ফের বিক্রির জন্য নামানো হবে। ফুলের দোকান। গাঁদা ফুলের মালা। রজনীগন্ধার স্টিক। ফি বৃহস্পতিবার দূর্বাঘাস, আম্রপল্লব, তুলসীপাতা, বেলপাতা আর পাঁচমিশেলি অল্প ফুলের পলিপ্যাক পাওয়া যায়। নীল অপরাজিতা ফুলের মালা শনিবারে। শনিঠাকুরের সেবায় লাগে। আবাসনের বাবুরা উইকএন্ডে ভক্তিভরে কিনে নিয়ে যান। শনিদেব কি উচ্চবিত্তের দেবতা?

ছুটির দিনে ফ্ল্যাটের স্যররা বারমুডা আর চকরাবকরা টি-শার্টে বাজার করতে আসেন। চোখের তলায় আইব্যাগ। চুলে কলপ। ম্যাডামরাও আসেন। চোখেমুখের মেদে গত রাতের বাড়তি পেগ আর ঘুম লেগে থাকে। মাংসের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে কাটিয়ে মাটন চিকেন নেন। সামনের সাইনবোর্ডে লেখা ‘ন্যায্য মূল্যে ১ নম্বর মাংস’। তবুও ঠকার ভয়। খাসিকে চেপে ধরে আড়াই পোঁচে জবাই করে কসাই। কসাইয়ের হেল্পার পায়ের তলায় চার ঠ্যাং চেপে ধরে। ঠিক এই সময়ে আবাসনের স্যরেরা রিং রোডে মালবোঝাই লরির চলে যাওয়া দেখে উদাস সিগারেট ধরান। লরির পিছনে লেখা ‘হিংসা নয় চেষ্টা করো’। দু’এক জন ফ্ল্যাটবিবি চিকেন নেওয়ার সময় নাকে গোলাপি হ্যাঙ্কি চেপে নিষ্পলক দেখেন মুরগির মৃত্যু, ছাল ছাড়ানো, তিরতির করে কাঁপতে থাকা গোলাপি মাংসের ভাপ, ওজন।

বাজারকে সামনে রেখে পুরনো জেলা শহরের দিকে পিছিয়ে এলে পুরনো চৌমাথা মোড়। ব্যস্ত এলাকা। ট্র্যাফিক পুলিশের দাঁড়ানোর আসন। রাস্তার পাশে পূর্ত দফতরের করে দেওয়া বড় সাইনবোর্ডে লেখা ‘সামনে স্কুল, আস্তে চালান।’ বোর্ডের গায়ে পাতলা কাগজের ছোট ছোট বিজ্ঞাপনের পোস্টার: ‘স্বপ্নদোষ, ভগন্দর, লিঙ্গ শিথিলতা থেকে মুক্তির উপায়’, ‘এখানে যত্ন সহকারে কনে সাজানো হয়’, ‘গোপনে নেশা ছাড়ান’, ‘ফ্রি! ফ্রি!! ফ্রি!!! কম্পিউটার কোর্স।’ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিভাগ নিয়ে এটাই জেলার সবচেয়ে পুরনো ইস্কুল। ছেলেদের নীল শার্ট, সাদা প্যান্ট। মেয়েদের নীল টিউনিক, সাদা জামা। নবম-দশম শ্রেণির মেয়েদের নীল-পাড় সাদা শাড়ি। ইস্কুলের ছেলেমেয়েদের চেহারা, পোশাক, শরীর-ভাষা ঔজ্জ্বল্যহীন। গত বছর এই ইস্কুল থেকেই মাধ্যমিকে রাজ্যে প্রথম হয়েছিল এক জন। কোন নিউজ চ্যানেল সবার আগে কৃতী ছাত্রীকে তাদের কলকাতার স্টুডিয়োতে নিয়ে যাবে, তা নিয়ে তিনটি চ্যানেলের জেলার সাংবাদিকরা ইস্কুলের সামনেই হাতাহাতি করেছিল খুব।

ইস্কুলের গেটের ঠিক উলটো দিকে খাতা-বইয়ের দোকান। দোকানের সামনে পাঁচ টাকার কেক। নামী ব্র্যান্ডের নকল কোল্ড ড্রিংকসের ছোট বোতল। ইজি রিচার্জ। তিন টাকার ইউজ অ্যান্ড থ্রো পেন। মোবাইলে গান ডাউনলোড। ইস্কুলের গেটের পাশেই বৃদ্ধ বকুল গাছ। গাছের তলায় ছোট ঠেলাগাড়ি। ঘুগনি, আলুকাবলি, বারোভাজা, ঝালমুড়ি পাওয়া যায়। কাচের বয়ামে লাল-নীল-সবুজ-হলুদ টিকটিকি লজেন্স, কটকটি, লম্বু, কুচকুচে কালো কুলের আচার, জলছবি। আর তীব্র লবণ মেশানো অদ্ভুত স্বাদের ‘কারেন্ট’-এর পুঁচকে প্যাকেট।

বাংলা মিডিয়াম পুরনো এই ইস্কুল পেরিয়ে বাইপাসের দিকে অনেকটা এগোলে পর পর তিনটি ইংলিশ মিডিয়াম। একটা পুরনো, দুটো নতুন হয়েছে। হলুদ রঙের ঝকঝকে বাস এসে ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে দিয়ে যায়, নিয়ে যায়। অনেকেই নিজস্ব বাহনে আসে। ড্রাইভার এসে ছেড়ে দিয়ে যায়। ডিপ অ্যাশ, মেরুন আর চকোলেট কালারের ড্রেস পরে ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্রছাত্রীরা যখন চলেফেরে, ওদের স্বাস্থ্যোজ্জ্বল কলরবে এলাকাটা সিনেমায় দেখা বিদেশের মতো হয়ে যায় হুবহু।

স্কুলগুলোর উলটো দিকে একটা ছোট মার্কেট। গাড়ির শো-রুম। রেস্তোরা।ঁ মার্বেল টাইলস-এর শো-রুম। একটা বুটিক। মাল্টিমিডিয়া শেখার প্রতিষ্ঠান। সাইবার ক্যাফে। এই স্কুলগুলোতে নতুন ফ্ল্যাটের, আবাসনের ছেলেমেয়েদের ভিড় বেশি। কিছু দিন আগে এই স্কুলের এক ছাত্রীর এমএমএস ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা জেলা শহরে। স্কুলের ফাঁকা কম্পিউটার ল্যাবে ক্লাসমেটের সঙ্গে জাস্ট দেড় মিনিটের একটা ক্লিপিং। চারিদিকে হইচই। একটা নিউজ চ্যানেল মহানগরের বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে সান্ধ্য অনুষ্ঠান করেছিল। জেলার কাউকে ডাকেনি। জেলায় বুদ্ধিজীবী থাকে না?

স্কুল ছাড়িয়ে বিয়ার বার, হেল্থ ক্লাব। বেশ কয়েকটা হিমঘর। সে সব ছাড়িয়ে ফোর লেনের হাইওয়ে ধরে আরও পূর্বে গেলে রাস্তার ধারেই তিন-ফসলি জমি। আশ্বিনে কাশফুল ফোটে। নালিঘাস, নয়ানজুলি, মুথোঘাস, সেচ দফতরের ক্যানাল। আগে বর্ষায় চুনো মাছ উঠত খুব, এখন ওঠে না। কাছের একটা সাবান ফ্যাক্টরির কালো জল এসে নাকি ক্যানালের জলে মেশে। দুর্গন্ধ। পঞ্চায়েত কিছুই করেনি। নয়ানজুলির জলে শাপলা, জলঝিঁঝি। দূরে একটা ইট-ভাটার দেহাতি, আদিবাসী শ্রমিকদের নিচু-নিচু খুপরি ঘর। বড্ড নিচুতে বাঁচা। প্রথম প্লটগুলোর দাম আকাশছোঁয়া। পেট্রোল পাম্প হয়েছে ধানজমি বুজিয়ে। গার্ডেন আমব্রেলা আর লাল চেয়ার দেওয়া ধাবা-ও। চিপস্-এর বড় প্যাকেট ঝোলানো। গাড়ি থামিয়ে অনেকেই ধাবাগুলোতে মোটা দুধের গরম চা খায়। ঠান্ডা বিয়ারও। আরও অনেক শিল্প হবে শোনা যাচ্ছে। অনেকেই জমি কিনে ফেলে রেখে দিয়েছে। দাম বাড়বে, বাড়ছে। জমিতে সাইনবোর্ড গাঁথা ‘...সাইট ফর...’।

রিং রোড আর বাইপাস দুটো দিয়েই জেলা শহরের ভিতরে ঢোকা যায়। ভিতরটা ঘিঞ্জি। পুরনো সরু রাস্তা। আঁকাবাঁকা। বাড়িগুলো রাস্তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। অনেক দোতলা বাড়ির একতলার দরজা-জানলা খুলে ফেলে শাটার লাগিয়ে দোকানঘর বানানো হয়েছে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে একটা তেমাথা। পাশেই নেতাজির একটা মূর্তি। তার পাদদেশে আখের রস বিক্রেতা। নেতাজির বেদিতে শুকনো আখ হেলান দেওয়া। জেনারেটর, কেব্ল টিভি আরও কী সবের একগাদা তার নেতাজির ঠিক কান ঘেঁষে কোথায় যেন চলে গেছে। একটু এগোলেই রিকশা স্ট্যান্ড। বোর্ডে লেখা ‘এখানে দশটি রিকশা দাঁড়াইবে।’ পঁচিশটারও বেশি রিকশা দাঁড়িয়ে থাকে সব সময়। বোর্ডের গা ঘেঁষে একটা বেদি। বিনামূল্যে খবরের কাগজ পড়ার জন্য। বেদিটা আগে লাল রঙের ছিল, এখন তে-রঙা। ‘পড়ুন ও পড়ান’ লেখাটাকে একই রেখে কারা যেন পার্টির মুখপত্রের নামটা বদলে দিয়েছে। পরিবর্তন। একটা গুমটি মতো দোকান। ঘোড়ার নাল, গাছগাছড়ার শিকড়, অষ্টধাতুর আংটি পাওয়া যায়। এই গুমটির মালিক আগে ধনেশ পাখির হাড় আর সামুদ্রিক কাঁকড়ার তেল বিক্রি করত। সর্বরোগহর। এক বার জেলে গিয়েছিল, ছাড়া পেয়ে শিকড়বাকড়।

একটু এগিয়ে ডান দিকে তাকালেই শনিমন্দির। শনিদেবের দিকে নাকি সরাসরি তাকানো যায় না। শাস্ত্রসম্মত সতর্কীকরণ। এই জায়গায় আগে একটা পুরনো বই-পত্রিকার দোকান ছিল। দেশ, দফা ৩০২, সব কম দামে পাওয়া যেত। মন্দিরের গ্রিলের সঙ্গে চেন দিয়ে বাঁধা প্রণামী-বাক্স। দেবতার প্রণামীও চুরি হয়ে যেতে পারে? স্ট্যান্ডের রিকশাওয়ালারাই ফি শনিবার পুজোর আয়োজন করে। শনিদেব কি সাবঅল্টার্নদের দেবতা? মন্দিরটায় আগে সিমেন্টের মেঝে ছিল, এখন মার্বেল ফ্লোর। রংদার টাইলসে সাজানো।

নেতাজি যে দিকে আঙুল দেখাচ্ছেন, সেই বরাবর গেলে জেলার প্রধান বাজার। সার-সার জামাকাপড়ের দোকান, ফলের দোকান। মুদিখানা। এগরোল সেন্টার। মোগলাই, চিলি চিকেনও পাওয়া যায়। মোমো-র ঠেলা, ওষুধের দোকান, নার্সিং হোম, প্যাথলজি সেন্টার, চশমার দোকান, মোবাইল স্টোর, টিভি-ফ্রিজের শো-রুম। হোটেল, লজ। লজে প্রতি শনি-মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন জ্যোতিষ বসেন। পাঁচ মিনিটে বশীকরণ। সব সমস্যার সমাধান। বিফলে মূল্য ফেরত।

বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া হোটেল-লজের ছোট রুমে নানা রকমের, নানা দামের, নানা বয়সের ‘আইটেম’ও বসে। প্রতি দিন। কোনও শনি-মঙ্গলবার নেই। অনেকেই ‘মাল’ বলে ডাকে। ‘পাখি’ নামেও ডাকে কেউ কেউ। নামে কী আসে যায়? লোকে বলে ‘চাদর পালটানো ব্যবসা।’ পাঁচ মিনিটে সব সমস্যার সমাধান হয় কি না, বিফলে মূল্য ফেরত পাওয়া যায় কি না জানা যায় না। আইটেমরা আশেপাশের এলাকা, জেলা, মহকুমা থেকে অফিসটাইমে ট্রেনে বাসে জেলা শহরে পৌঁছে যায়। উঠতি বড়লোক, কাঁচা টাকার ছোট ও মাঝারি ব্যবসাদারদের আনাগোনা এদের কাছে। কম মূল্যের আইটেমরা স্টেশনে, বাসস্ট্যান্ড আর বড় রাস্তার আনাচে-কানাচে কোনা-ঘুপচিতে রং মেখে দাঁড়িয়ে থাকে। শিকারিদের চোখ ঠিক খুঁজে নেয় এদের। অথবা এদের শিকারী চোখ ঠিকঠাক খুঁজে নেয় শিকার। কে শিকারি কে শিকার, গুলিয়ে যায়।

মাঝে মাঝে জেলা পুলিশ রেড করে। আইটেম, খদ্দের, হোটেল-ম্যানেজারকে লাইন দিয়ে পুলিশ ভ্যানে তোলা হয়। পাবলিক কাজ ফেলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। হাসে। লোকাল কেব্ল চ্যানেলের ক্যামেরাম্যান গুছিয়ে ছবি তোলে। আইটেমরা ওড়না-আঁচলে মুখে ঢেকে নেয়, খদ্দেররা রুমাল বা হাতের আড়ালে।

কাছেই শপিং মল। আগে এখানে একটা বড় সিনেমা হল ছিল। অমিতাভ উত্তমকুমারের নতুন বই রিলিজ হলে কারা যেন গুরুদের বিশাল পোস্টারে মালা লাগিয়ে দিত। নাইট শোয়ে ‘রেশমা কি জওয়ানি’-র পোস্টারের সামনে রোজ ‘হাউসফুল’ বোর্ড লাগানো থাকত। ঘনিষ্ঠ সিন শুরু হলেই কাঠের চেয়ার বাজিয়ে হল্লা করত কারা। হলের ভিতরটা গরম হয়ে উঠত। দর্শকদের মাথা আর শরীরও। মাথার উপর লম্বা রডে ঝোলানো বড় ব্লেডের পুরনো ফ্যানগুলো একঘেয়ে আওয়াজ করত। সিনেমাগুলোর মাঝখানে সিন কেটে তামিল, ইংরিজি, টু-এক্স, থ্রি-এক্স দৃশ্য জুড়ে দেওয়া হত। এই সময় কেউ কোনও আওয়াজ করত না। সবাই চুপ। হলের লাইটম্যান ‘আশার’রাও ফাঁকা সিট দেখে বসে পড়ত।

গুরুরা গা-গরম-করা ডায়ালগ বললে খুচরো পয়সা আর বাদাম ধেয়ে যেত পরদার দিকে। যে বার অমিতাভ শাহেনশা হয়ে এলেন, পঞ্চাশ টাকার ব্যালকনি আড়াইশো টাকায় ব্ল্যাক হয়েছিল। এক জন ব্ল্যাকারের হুবহু অমিতাভের মতো হাইট আর কান-ঢাকা হেয়ার স্টাইল ছিল। শত্রুঘ্ন সিনহার মতো ঠোঁটের কোনায় কাটা দাগ। শাহেনশা চলাকালীন ওই ব্ল্যাকার পুলিশের উদ্দেশে বলেছিল, ‘রিস্তে মে তো ম্যায় তুম্হারে বাপ লগতা হুঁ।’ এর পর পাবলিকের সামনেই পুলিশের লাঠি। লম্বা লোকটা এর পর কেমন কুঁজো হয়ে গেল ক্রমশ। সিনেমা হলটা ভেঙে পাঁচ তলা শপিং মল হয়েছে। ব্ল্যাকার বুড়ো হয়েছে। এখন শপিং মলের বেসমেন্টে পার্কিং লটে গোলাপি টিকিট কাটার কাজ করে। অমিতাভর হাইট, হেয়ারস্টাইল, কিছুই নেই। শুধু শত্রুঘ্নর মতো কাটা দাগটা এখনও অবিকল। কিছু দাগ মেলায় না।

মলের বিভিন্ন ফ্লোরে হরেক আয়োজন। ব্র্যান্ডেড গয়নার দোকান। নামী পোশাক বিপণি। স্বচ্ছ কাচের ও-পারে পিৎজার কাউন্টার। রঙিন চেয়ার। মাল্টিপ্লেক্স। হাসিমুখের পোস্টার। হাসিমুখ মানুষ। ম্যানিকিনের শরীরের পোশাকগুলো ঋতু ও ট্রেন্ড অনুযায়ী পালটে পালটে যায়। টিপটপ ফুচকাওয়ালা। স্বচ্ছ সেলোফেনের আড়ালে এই এলাকার ডবকা ফুচকার দাম বেশি।

বড় রাস্তা বরাবর এগোলে স্টেশন। স্টেশনে ঢোকার মুখে অটো, মিনিবাস, মানুষে টানা রিকশা, প্লাস্টিকের ছই দেওয়া ‘ভ্যানো’। ভিড়। ‘এখানে সাইকেল ও মোটরসাইকেল রাখা হয়।’ খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন, বইয়ের স্টল। স্টলের সামনের স্ট্যান্ডে ঝোলানো ম্যাগাজিনে এক নায়িকার ফুল ফিগার। হাসিমুখে সামনে ঈষৎ ঝুঁকে হাসছে। গজদাঁত। কোঁকড়ানো ভিজে চুল। শার্টের সামনের দুটো বোতাম খোলা। পাশেই সরকারি চাকরির প্রস্তুতির পাঁচ হাজার প্রশ্নোত্তরের পাঁচটি সেট একত্রে। জেলার এক কবির কাব্যগ্রন্থ। ২০% ছাড়। পে অ্যান্ড ইউজ টয়লেট। টয়লেটের বাইরে একটা গুমটিতে পান-বিড়ি-সিগারেট-গুটখা-গুল-নিমদাঁতন। ছোট সাবান। টুথপেস্ট। টয়লেটের সামনের টুলে ‘লেডিজ’-এর দিকে এক প্রৌঢ়া। ‘জেন্স’-এর দিকে কেউ নেই। ‘এখানে স্নানের ব্যবস্থা আছে।’ টয়লেট থেকে একটু দূরে ফুলের দোকান। জুঁই, বেল। কালো ব্যাটারির খোলের জলে লাল গোলাপ। অনেকেই ট্রেন থেকে নেমে বাড়ি ফেরার পথে পলিপ্যাকে বেল বা জুঁইয়ের মালা নিয়ে যায়। কারও খোঁপায় আটকে দেয়?

ফুলের পাশেই ফলের দোকান। পলিটিকাল কারেক্টনেস? পেয়ারার ঝুড়ির সামনে দোকানি ‘বারুইপুর-বারুইপুর’ বলে চেঁচায়। মিথ্যে। পেয়ারাগুলো এই জেলারই কোনও গাছের। লোকাল। পাশের সাজানো-গোছানো ফলের দোকানের সামনে আরবের খেজুর। গ্লোবাল। পাশেই একটা ভিখিরি। দুটো পা কাটা। একটা ময়লা চাদর দিয়ে কোলের কাছটা ঢাকা। চাদরে খুচরো পয়সা। হাত দুটো সর্বদাই সামনে প্রসারিত। কথা বলে না। বলতে পারে। পা দুটো কী করে কাটল কেউ জানে না। অনেকে বলে, আগে ট্রেনের হকার ছিল, চাকার তলায় পা-জোড়া গেছে। কেউ বলে, ভিখিরিটা স্টেশন এলাকায় সুদে টাকা খাটায়। সত্যি-মিথ্যে কেউ জানে না। ভিখিরির মাথার উপর বিশাল হোর্ডিং-এ মোবাইল পরিষেবা কোম্পানির বিজ্ঞাপন। লেখা: ‘এবার আপনার জেলায় আপনার হাতের মুঠোয় আমরা।’ বাইক স্ট্যান্ডের এক কোণে রেলের হকার ইউনিয়নের অফিস। রাজ্যে নতুন সরকার আসার ঠিক আগে এখান থেকে অস্ত্র উদ্ধার করেছিল পুলিশ। এখনও কি ভিতরে কিছু অস্ত্রশস্ত্র মজুত? দরজায় লেখা ‘বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ।’

স্টেশন পেরিয়ে বড় রাস্তা ধরে ও-পারে গেলে রেল কলোনি। একতলা, দোতলা, তিনতলা রেল কোয়ার্টার। একটা বড় দিঘি। নাম রেলপুকুর। একতলা কোয়ার্টারের মাথায় পিচ-চট বিছানো। ছাদে এস-বিস্কুটের মতো পাইপ। আগে কলোনির কোয়ার্টার, রেলিং, পাম্প হাউস, জলের ট্যাঙ্ক সব মেটে লাল রঙের ছিল। এখন নীল আর সাদা। ইংরিজি বড় হরফে ‘অ্যাবান্ডন্ড’ লেখা পাম্প হাউসটার গায়েও নীল-সাদার নতুন পরত। পর পর অনেকগুলো ছাতিম গাছ, জারুল গাছ। শীতের সন্ধ্যায় ছাতিমের গন্ধে কেমন দম বন্ধ হয়ে যায়। লোকো শেডটা কবে যেন উঠে গেছে। ইঞ্জিনগুলোর গায়ে জং। আগাছা, মানকচুর সবুজ, পার্থেনিয়ামের জঙ্গল এ সবের আড়ালেই বাংলা আর চুল্লুর ঠেক। সাট্টার পেনসিলার, ওয়াগন-ব্রেকারদের আস্তানা।

রেলের উঁচু পাঁচিলের ও-পারে একটা চায়ের দোকান। বাঁশের চটার বেঞ্চ। দোকানে টিভি চলছে ফুল ভল্যুমে। দেব নাচছে। কিছু লোক সব সময় এই দোকানেই বসে থাকে। দিনরাত। কাজ করে না কোনও? অনিচ্ছুক মানুষ? এলাকায় এক সময় কথায় কথায় মেশিন বের হত, এখন হয় না। যারা ভাল মেশিন চালাত, তাদের অনেকেই দারুণ কথা বলতে পারে। পার্টির মিটিঙে বক্তৃতা দিতে যায়। ইলেকশন এলে পার্টির লিডাররা এদের হায়ার করে নিয়ে যায়। কর্মীদের আনাগোনা আর কাজে ডিজেল শেডটা সব সময় গমগম করে। কর্মচঞ্চল।

বিশ্বকর্মা পুজোয় খুব ধুমধাম হয়। মেলা বসে। গরম জিলিপি পাওয়া যায়। এক টাকায় একটা বেলুন ফাটানো। বুগি-বুগি শো। কাঁচা মুরগি থেকে কাচ খাওয়া নররাক্ষসের লাইভ অনুষ্ঠান। বাংলা ব্যান্ডের ফাংশন। ডান্স রিয়েলিটি শোয়ের টপ টেনের কেউ কেউ থাকে। ডিজেল ইঞ্জিনগুলোকে আচ্ছাসে স্নান করিয়ে আমপাতার শিকলি আর টুনি বাল্ব লাগানো হয়।

রেল কলোনি পেরোলে পুরনো বসত এলাকা। অলি-গলি, তস্য গলির রাস্তা। পাড়া, ক্লাব। তরুণ সংঘ। আমরা ক’জন। বালক সংঘ। নেতাজি সংঘ। কয়েক দশক পেরিয়েছে। সংঘ ভাঙেনি। ফুটবল ময়দান। একটা পুরনো স্টেডিয়াম। গ্যালারি ভেঙে গেছে। দোতলা পাকা বাড়িতে পার্টির জোনাল অফিস, কেব্ল-এর অফিস। যারা এক সময় জেলায় জেলায় কেব্ল চালুর বিরোধিতা করেছিল, অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে এককাট্টা করতে মিটিং-মিছিল ডেকেছিল, তারাই ওই অফিসে বসে। মাস পয়লায় ওদের লোক বাড়ি-বাড়ি গিয়ে কেব্ল-এর মান্থলি তুলে আনে। তার কিছুটা অংশ পার্টি অফিসে যায়। তার নামও মান্থলি। নামে কী আসে যায়?

জেলার পুরনো এই বসতকে বেড় দিয়ে পাকা রাস্তাটা গোল হয়ে এ-দিক ও-দিক বিস্তর ঘুরে ফের বাইপাসে গিয়ে মেশে। গোল গোল চক্রবৎ ঘুরতে থাকে জেলা। জীবন। জেলাজীবন।

rishimosai@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE