Advertisement
০৭ মে ২০২৪

জা স্ট যা চ্ছি

শার্ল দ্য গল এয়ারপোর্ট-এ পৌঁছেই মোবাইল চালু করলাম। প্যারিস পৌঁছে গেছি মেসেজ করব বলে। কিন্তু তার আগেই দেখি একটা মেসেজ অপেক্ষা করছে ইনবক্সে। ‘তোমার প্রোগ্রাম কিছুটা বদলেছে। সকালের পরিবর্তে বিকেলে আমাদের সি.ই.ও তোমাকে মিট করবেন। সুতরাং তুমি তোমার মতো করে সময় কাটাতে পারো। ম্যারিয়ন নয়, ডরোথি তোমার সঙ্গে থাকবে। কোনও অসুবিধে হলে এই নম্বরে ফোন কোরো।’

শুভময় মিত্র
শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

শার্ল দ্য গল এয়ারপোর্ট-এ পৌঁছেই মোবাইল চালু করলাম। প্যারিস পৌঁছে গেছি মেসেজ করব বলে। কিন্তু তার আগেই দেখি একটা মেসেজ অপেক্ষা করছে ইনবক্সে। ‘তোমার প্রোগ্রাম কিছুটা বদলেছে। সকালের পরিবর্তে বিকেলে আমাদের সি.ই.ও তোমাকে মিট করবেন। সুতরাং তুমি তোমার মতো করে সময় কাটাতে পারো। ম্যারিয়ন নয়, ডরোথি তোমার সঙ্গে থাকবে। কোনও অসুবিধে হলে এই নম্বরে ফোন কোরো।’

ম্যারিয়ন আমার লিয়াজঁ অফিসার। এক বার ফোনে গলা শুনেছি। শুনে হাসিখুশি মেয়ে বলেই মনে হয়েছিল। অবশ্য মেয়ে না মহিলা সেটা পরিষ্কার বুঝতে পারিনি। মনে মনে ম্যারিয়নের একটা চেহারা এঁকে রেখেছিলাম। ডরোথি নামটা দেখে কেন জানি না একটু হতাশ হয়ে পড়লাম। মনে হল, বয়স্ক মহিলাই হবে। কলকাতার মেয়ে বললে যেমন লাল পাড় তাঁতের শাড়ি পরা একটা চেহারা ভেবে নেওয়ার কোনও কারণ নেই, তেমনই আমার ফোন বাজছে। ধরলাম। ‘হাই, আমি ডরোথি বলছি। রেল স্টেশনে চলে এসো অ্যারো দেখে দেখে। প্রথম অটোমেটিক টিকিট কাটার কিয়স্কের পাশে একটা ফোটো বুথ আছে, ওখানে অপেক্ষা করছি।’ আমার ট্রলি ব্যাগ নিয়ে চলে এলাম সেখানে। বহু লোকজন আসা-যাওয়া করছে। এ-দিক ও-দিক দেখছি। লম্বা কালো স্কার্ট পরা এক জন এগিয়ে এল। গলায় ঝোলানো আই.ডি কার্ড তুলে দেখিয়ে বলল, ‘এসো’। পরিষ্কার ইংরিজি। আমি অবাক হয়ে কিছু একটা বলার আগেই উত্তর এল, ‘প্যারিস সম্পর্কে আজও বেশির ভাগ লোকের ধারণাগুলো ভুল। আসলে ট্যুরিস্টরা একেবারেই বোঝে না।’ গলাটা একটু কঠিন শোনাল। আমি ট্যুরিস্ট নই। কিছুই জানি না। ভুল বোঝার দায়ও আমার ওপর বর্তায় না। না দেখার ভান করে ডরোথিকে দেখছিলাম আমি। বয়স নিঃসন্দেহে পঞ্চাশ পেরিয়েছে, ষাটও হতে পারে।

ছবি: শুভময় মিত্র

ট্রেন এল, উঠে পড়লাম, ভিড় আছে, এক পাশ চেপে দাঁড়ালাম। বিকেল অবধি কী করব, কোথায় যাব সেটা ভাবছিলাম। ডরোথি সেটা বোধ হয় আন্দাজ করে নিল। বলল, ‘একটু পরেই আমরা গ্যারে ডু নর্ড পৌঁছব। ওখান থেকে লাইন বদলে ল্য দি ফঁস-এ যাওয়া যায়। আমাদের অফিস ওখানে। সময় আছে যখন, অন্য কোথাও যেতে পারি।’ আইফেল টাওয়ার বা ল্যুভ মিউজিয়াম দেখতে চাওয়াটা ভাল দেখায় না। আমি মুখে একটা উদাসীন ভাব এনে বললাম, ‘তোমার শহর, আমি কী জানি, আই অ্যাম অল ইয়োরস নাও’, বলে একটু ভয় হল, ভুল মানে না করে ফেলে, ক্লায়েন্ট বলে কথা। ডরোথির মুখে কোনও ভাবের পরিবর্তন হল না, একটু যেন তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, ‘সকালবেলা নিশ্চয়ই পিগাল-এ যাবে না।’ আমি জানি পিগাল-এ কী আছে, প্যারিসের সোনাগাছি। ‘অবশ্য গেলেই হয়, কাছেই, লেটস ওয়ক।’ গ্যারে ডু নর্ড স্টেশনের বাইরে চলে এলাম। রোদে ঝলমল করছে মার্চ মাসের প্যারিস। ঠান্ডা আছে। শুকনো পাতা পাক খাচ্ছে রাস্তায়। রেলিং-এ, পোস্টে থোকা থোকা ফুল সাজিয়ে রাখা আছে। ব্যস্ততা আছে, তবে আওয়াজ নেই, কেউ গাড়ির হর্ন বাজাচ্ছে না।

আমার সামনেই হাঁটছিল ডরোথি, বেশ তাড়াতাড়ি। তাই কথা বলাতে অসুবিধে হচ্ছিল। আমার বলার কিছু ছিল না যদিও। একটু অস্থির, উদ্ভ্রান্ত লাগছিল ওকে। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, ‘স্যাক্রে কিওর কাছে। মমার্ত ওখানেই কিন্তু এখন ওখানে গিয়ে কী হবে? দাঁড়াও, কোথায় যাওয়া যায়...’ দাঁড়িয়ে পড়লাম। ক্লিশি বুলেভার্ড-এর ওপর দাঁড়িয়ে আছি। ভালই লাগছে দাঁড়িয়ে থাকতে। কোথাও যেতেই হবে এমন নয়। আবার রাস্তায় দাঁড়িয়ে আড্ডা মারা যেতে পারে, এটাও বলাটা ভাল দেখায় না। ম্যারিয়ন হলে হয়তো বাপারটা অন্য রকম হত। অ্যানভার্স-এর পর পিগাল-এর মোড় পেরিয়েই ডরোথি হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল। তার পর একটা অদ্ভুত হিংস্র হাসি হেসে আমার খুব কাছে এসে বলল, ‘প্যারিসে যে যা চায় তা সবই আছে। কিন্তু পায় না। পায় না বলেই বারবার ফিরে আসে। এসো একটা জায়গায় যাই।’

ডরোথি একটা বাড়িতে ঢুকে পড়ল কাচের দরজা ঠেলে। দরজার বাইরে আমাকে দাঁড়িয়ে পড়তেই হল। কারণ পাশের শো উইন্ডো’তে একটা অদ্ভুত চেয়ার রাখা আছে। বসার জায়গাটা কমোডের মতো ফাঁকা। তার ভেতরে অদ্ভুত সব যন্ত্রপাতি, কী হয় নড়াচড়া করলে বুঝতে অসুবিধে হল না। হাঁকপাঁক করে ঢুকলাম ভেতরে, তত ক্ষণে টিকিট কাটা হয়ে গেছে। ‘এখানে বাচ্চারাও আসতে পারে, তবে বড়দের সঙ্গে, ওদের টিকিটের দাম কম।’ চার পাশের দেওয়ালে নানা রকম ছবি, স্পটলাইট জ্বালা বিচিত্র মূর্তি, উদ্ভট যন্ত্রপাতি। মানুষের তলপেট থেকে মাথা পর্যন্ত অদৃশ্য ইলেকট্রিক তার দিয়ে হাই ভোল্টেজ কারেন্ট চলে, তারই ক্রমাগত শক পেতে পেতে উজ্জীবিত হয়েছেন দুনিয়ার বহু শিল্পী। শিল্পী মানেই রসিক। তাই সৃষ্টিরসের খামতি নেই কোথাও।

অন্যান্য দর্শকদের মতো আমিও নিঃশব্দে হাঁটতে শুরু করলাম বেড়ালের মতো। আমাকে টানছিল সামনের দেওয়ালে লাগানো একটা লাইফ সাইজ ছবি। একটা মেয়ে, সুতোহীন, শুয়ে আছে কাত হয়ে, কনুইতে ভর দিয়ে। সোজা তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তার পায়ের পাতা থেকে একটা ধাতুর তার শুরু হয়েছে, শরীরের জরুরি লাইন বরাবর এঁকেবেঁকে চলেছে ছবি থেকে ইঞ্চি ছয়েক দূরত্ব রেখে, শেষ হয়েছে মাথার কাছে। সেখানে পরানো আছে একটা চাবি, তার থেকেও একটা সরু তার ঝুলছে। এই চাবিকে হাতে ধরে সাবধানে নিয়ে যেতে হবে পা থেকে মাথা পর্যন্ত। প্রথম তারের সংস্পর্শে আনা চলবে না। ঠেকে গেলেই মারাত্মক ব্যাপার। লুকোনো স্পিকারে ভেসে আসবে নারীকণ্ঠের গোঙানি। আজব ফরাসি খেলা, পুরুষদের স্টেডি থাকার পরীক্ষা মোক্ষম সময়ে। চাবির ফুটোটা বেশ ছোট। সুতরাং পাশ করার সম্ভাবনা ক্ষীণ। ডরোথির দিকে তাকিয়ে আমি স্মিত হাসলাম। ভাবখানা হল, প্রথমত, প্যারিসে পা পড়তে না পড়তেই এমন চিত্তাকর্ষক আমোদ উপহার দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। দ্বিতীয়ত, অভিনব এই শিল্পকলার বদমাইশিটা আমার খুবই পছন্দ হয়েছে।

ডরোথি তার ফোনের টাচ স্ক্রিনে কী সব টাইপ করছিল গম্ভীর মুখে, এ দিকে তার নজর নেই। হয়তো অফিসের কাজ সেরে নিচ্ছিল। দুম করে মুখ তুলে আমাকে বলে বসল, ‘কী, করো!’ তার পর, আবার কাজে মন দিল। একটু রাগ হল আমার। খাজুরাহো, কোনার্কের দেশ থেকে এসেছি আমি। লাস্যশিল্পের বজ্জাতি ভরা সংগ্রহশালায় তুমি আমার মনের জোরের পরীক্ষা নিচ্ছ? ধরলাম চাবিটা। আমি জানি ও স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে কাজ করলেও নজর রাখছে আমাকে। গাঁটে গাঁটে চৌষট্টি পেরোলে কী হবে, মাথায় ষোলো আনা দুষ্টুবুদ্ধি বিনবিন করছে।

শুরু করলাম মাথা থেকে। কোনও অঘটন না ঘটিয়ে বুক পেরিয়ে কোমরে পৌঁছলাম। থামলাম। আড় চোখে দেখলাম ওকে। তার পর সাঁ করে চলে গেলাম পায়ের পাতায়। তাকালাম ওর দিকে। ডরোথি চোখ তুলে দেখল। একটা হাসি খেলে গেল ওর মুখে। বলল, ‘ম্যারিয়ন হলে তোমাকে ল্যুভ-এ মোনালিসা দেখাত। যদি এখানে আসত, তা হলে তুমি পাশ করতে না।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE