Advertisement
০৬ মে ২০২৪
রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ২

জাস্ট যাচ্ছি

এক বার অস্পষ্ট ছবিটা, এক বার আমার মুখটা দেখতে লাগল বন্দুকওয়ালা সিকিয়োরিটি। ঝকঝকে পরিষ্কার আই-ডি কার্ড নেই আমার, আছে ময়লাটে ভোটার কার্ড। তার চোখে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সন্দেহ। টিকিটের প্রিন্ট-আউটটা খুঁটিয়ে দেখে সে ফেরত দিয়ে দিল। ঠান্ডা গলায় বলল, ‘এটা চলবে না এখানে।’ ইশারা করল সরে দাঁড়াতে, পরের লোক তত ক্ষণে নিজের কাগজ এগিয়ে দিয়েছে। বয়স্ক মানুষ, হুইলচেয়ারে বসা, প্রসন্ন মুখ। তার পর আরও অনেকে, সবাই মসৃণ ভাবে ঢুকে পড়ছে বিশাল, ঝলমলে, আকাশ ছুঁতে পারার শান্তিস্তূপে।

ছবি: শুভময় মিত্র

ছবি: শুভময় মিত্র

শুভময় মিত্র
শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০১৪ ০১:০৯
Share: Save:

এক বার অস্পষ্ট ছবিটা, এক বার আমার মুখটা দেখতে লাগল বন্দুকওয়ালা সিকিয়োরিটি। ঝকঝকে পরিষ্কার আই-ডি কার্ড নেই আমার, আছে ময়লাটে ভোটার কার্ড। তার চোখে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সন্দেহ। টিকিটের প্রিন্ট-আউটটা খুঁটিয়ে দেখে সে ফেরত দিয়ে দিল। ঠান্ডা গলায় বলল, ‘এটা চলবে না এখানে।’ ইশারা করল সরে দাঁড়াতে, পরের লোক তত ক্ষণে নিজের কাগজ এগিয়ে দিয়েছে। বয়স্ক মানুষ, হুইলচেয়ারে বসা, প্রসন্ন মুখ। তার পর আরও অনেকে, সবাই মসৃণ ভাবে ঢুকে পড়ছে বিশাল, ঝলমলে, আকাশ ছুঁতে পারার শান্তিস্তূপে। আমি দাঁড়িয়ে আছি ঘুম না ভাঙা, সকাল হতে না চাওয়া, ঘাম জবজবে শহরে। মাথাটা কেমন যেন খালি হয়ে গেল, কী করব মাথায় আসছে না। একটা মিষ্টি গন্ধ, কানের কাছে কে যেন বলল, ‘ওটা তো ফেরার টিকিট, যাওয়ারটা দেখাও।’ কানে হেডফোন, হাসিমুখ, অল্প বয়স। ঠিকই তো, যেটা দরকার সেটা তো আমার বুকপকেটে, এটা কোথা থেকে এল? এ বার ঢুকতে দিল আমাকে। যাকে থ্যাংকস বলতে চাইলাম সে তত ক্ষণে তার ট্রলি ব্যাগ নিয়ে অনেক দূরে চলে গেছে।

মাথাটা খালি হয়ে গিয়েছিল। কোনও শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম না। দাঁড়িয়ে রইলাম কিছু ক্ষণ, তার পরেই খেয়াল হল, সময় নেই আর। সব রকম আওয়াজ ফিরে এল ফেড ইন করে। আমার সামনেই বড় টেলিভিশনে ছেড়ে যেতে প্রস্তুত হওয়া, বোর্ডিং চলা, সিকিয়োরিটি চেক ইন করা সব ফ্লাইটের নাম ফ্ল্যাশ করছিল, আমারটা দেখছি না কেন? চলে গেছে না কি? আমার ব্যাগেজ চেক করার ব্যাপার নেই, সঙ্গে একটাই ছোট হ্যান্ডব্যাগ, সরাসরি দৌড়লাম আমার এয়ারলাইন্স-এর কাউন্টারের দিকে। সেখানেও এঁকেবেঁকে লম্বা লাইন। ফিতের বেড়া পেরিয়ে আগে যাওয়ার উপায় নেই। হুইলচেয়ারে বসা মানুষটাকে দেখতে পেলাম কিছুটা সামনে। সুগন্ধীকে খুঁজে পেলাম না, হয়তো অন্য ফ্লাইট ধরবে। ডিসপ্লে’তে আমার ফ্লাইটের নম্বর ফ্ল্যাশ করছে হিংস্র ভাবে, পাশেই সময় দেখাচ্ছে। সময় নেই, পঁয়তাল্লিশ মিনিটের চেয়ে দেরি হলেই আর নেবে না। ‘প্যাসেঞ্জারস ফর দিল্লি’ ডাকছে এক জন বার বার। মরিয়া হয়ে আমিও চিৎকার করে বললাম, ‘দিল্লি, দিল্লি’। সে ইশারা করল লাইন ভেঙে এগিয়ে আসতে। কাউন্টারে পৌঁছে গেলাম। এগিয়ে দিলাম কাগজপত্র। আমার দিকে এক বারও না তাকিয়ে, মায়া ভরা চোখে সামনের স্ক্রিনে কী একটা দেখে, যেন বহু কাল আমাকে চেনে এমন সহজ গলায় এক জন বলল, ‘তোমাকে উইন্ডো সিট দেব কি?’ আমি মাথা নাড়িয়ে থ্যাংক ইউ বলতে চাইলাম, একটা অদ্ভুত আওয়াজ বেরল। এগিয়ে দেওয়া বোর্ডিং পাসটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আবার সে ডাকল আমায়, গলায় ঠান্ডা মমতা। আমার কেবিন লাগেজের ট্যাগ নিতে ভুলে গিয়েছিলাম। ‘ইউ নিড নট ওরি, ইউ হ্যাভ টাইম।’ তার আয়ত চোখের সীমানায় ফাইন তুলির কালো টান। এয়ারলাইন। আইলাইন।

আবার সিকিয়োরিটি চেক। সফিস্টিকেটেড ধরপাকড়। রোলারের ওপর দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে নানা রকম বন্ধ ব্যাগ উঠে পড়ছে চলন্ত বেল্টে। তার পর ঢুকে পড়ছে এক্স রে মেশিনের অন্ধকারে। পাশের ইলেকট্রনিক জানলায় এক জন চোখ রেখেছে নেকড়ের মতো। ব্যাগের অস্থিমজ্জার মধ্যে ক্যানসার সন্দেহ হলেই শুরু হবে তৎপরতা। এত কিছুর পরও শুনি সোনা, কোকেন মোক্ষম সময়ে অদৃশ্য হয়ে যেতে পারে রাসপুটিনের ম্যাজিকে। আমার কিছুই নেই, তাই নিশ্চিন্তে এসে দাঁড়ালাম বডি সার্চের দোরগোড়ায়। এখানে পুরুষ খোঁজে পুরুষের দেহ। মানিব্যাগে কয়েন বা বেল্টে ধাতু খুঁজে পেলে বদলে যায় তল্লাশকারীর চোখের দৃষ্টি। আমার শরীরে কিছু অকারণ আতঙ্ক, অজানা অস্বস্তি আর অলীক সুখকল্পনা ছাড়া কিছু না পেয়ে তাচ্ছিল্য ভরে ছেড়ে দেওয়া হল দমাদম দুটো স্ট্যাম্প মেরে। মনে পড়ল, বিক্রির আগে চামড়া ছাড়িয়ে উলঙ্গ করে, নির্বিষ প্রমাণিত হলে মৃত পাঁঠার উরুতেও বেগুনি ছাপ মারা হয়। ছাপ খুব জরুরি। ছাপ সব কিছুর ছাড়পত্র।

এক জন পরিচ্ছন্ন যাত্রী হিসেবে ছাড় পেয়ে যাওয়ায় নিশ্চিন্ত লাগছিল। ব্যাগ নিতে এগোলাম। ব্যাগটা বেরল, তার পর আবার ফিরে গেল ভিতরে। এ বারে ও-পাশ থেকে ইশারা, কার ব্যাগ এটা? আমার। খুলে দেখাও, সন্দেহের কারণ ঘটেছে। সাতসকালে শহর-ছাড়া এত মানুষের মধ্যে এক্স-রে আলাদা করেছে আমার ব্যাগ। এক সেট কাচা জামাপ্যান্ট, কাজের কাগজপত্র, মোবাইল ফোন আর টুকিটাকি জিনিস ছাড়া কিছুই নেই। তা সত্ত্বেও সিকিয়োরিটির লোক পুকুরে খুঁজে পাওয়া মানুষের দেহাংশ ভরা বস্তার মতো আমার ব্যাগটা তুলে এনে সামনে ফেলে দিল। আমি এখানে অসহায় দর্শক। নির্বিকার ধর্ষকের মতো হাত চলতে দেখলাম। হাঁকড়ে বেরল একটা দোমড়ানো টুথপেস্ট-এর টিউব। উদ্ভ্রান্ত চেহারার ভবঘুরে টুথব্রাশ প্লেনে উঠতে পারে, এটা নয়। এ বার চোখাচোখি হল আমাদের। আমার বন্ধ মুখের মধ্যে আলোড়ন টের পেলাম। বেরিয়ে আসতে চাইছে হঠাৎই খেপে ওঠা দাঁতগুলো। আপ্রাণ চেষ্টা করে থামিয়ে রাখলাম তাদের। ঠান্ডা চোখে নির্বিকার মুখে বললাম, ‘ফেক দো।’ এ বার দমাস করে ছাপ পড়ে গেল ব্যাগের ভাগ্যের সঙ্গে সুতোয় ঝোলা ট্যাগে।

টেনশন কেটে গেলে আমার খুব খিদে পায়। ঠিক করলাম প্লেন ছাড়লে যতই দাম হোক স্যান্ডউইচ কিনে খাব। দু’পাশে ডানা ছড়িয়ে প্লেন রানওয়ে, সবুজ জমি, শহর, মেঘকে নীচে ফেলে অনায়াসে ওপরে উঠে এল। কাত হয়ে বাঁক নিতেই রোদের স্পটলাইট আর ছায়া ম্যাজিক ল্যান্টার্নের আলোর মতো আমার কপাল ছুঁয়ে গেল। ইঞ্জিনের চাপা গমগমে অভিজাত শব্দ ছাপিয়ে নানা রকম নির্দেশ ও অনুরোধ ভেসে এল স্পিকার থেকে, যেমন আসে প্রত্যেক বার। যেন প্লাস্টিকের তৈরি, পিকচার পারফেক্ট এয়ারহোস্টেসরা চলাফেরা করতে লাগল পাশ দিয়ে। আমার জানলার বাইরে অতি নীল শান্ত আকাশ। স্লো মোশনে সরে যাচ্ছে মেঘের সমুদ্র। কখনও তার নীচে অস্পষ্ট জনপদ, নদীরেখা। ভাল লাগছিল সব কিছু। ঘুম পাচ্ছিল। চোখটা বুজে ফেললাম। কানটা আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

যদিও আমাকে ডাকেনি, তা সত্ত্বেও ঘুম ভেঙে গেল, চোখ খুলে দেখি এয়ারহোস্টেস এসেছে খাবারের ট্রলি নিয়ে। মানিব্যাগ বের করলাম। সঙ্গে আবার ফেরার টিকিটটাও বেরিয়ে পড়ল। পরিষ্কার নোট দিলাম, খাবারের দাম। সামনের সিটের পিছনের ট্রে খুলে তাতে প্যাক করা স্যান্ডউইচ নামিয়ে দিল আলতো করে। টিকিটের কাগজের ভাঁজ খুলে দেখলাম এক বার। এমনিই। স্যান্ডউইচে একটা আলতো কামড় দিতেই চোয়ালটা আটকে গেল। চোখ পড়েছে ফেরার তারিখে। ভাল করে দেখলাম। আজকেরই ডেট। সময়টা যা লেখা আছে, তার মানে হল, প্লেন ছেড়ে দিয়েছে অনেক ক্ষণ আগেই। হয়তো উড়ে যাবে ভীষণ স্পিডে, আমারই পাশ দিয়ে, উলটো দিকে। তাকিয়ে রইলাম জানলার বাইরে।

suvolama@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE