Advertisement
১৯ মে ২০২৪
রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ২

জা স্ট যা চ্ছি

আকাশের বেলুনটা ফাটবে ফাটবে করছে। এক টুকরো নীল বা সাদার ছিটে নেই। সবটা গাঢ় চাপ চাপ ছাই এলোমেলো পেশি। ফুলে উঠছে কোথাও কোথাও। তার নীচে একটা পাতলা সবুজ দিগন্তরেখা। এর ঠিক নীচের মাত্রায় একটা শুকনো রাস্তা। মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে বাসটা। খারাপ হয়ে গেছে, একেবারে চুপ মেরে গেছে। সব মিলিয়ে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেছে, তাই নেমে, একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছি।

ছবি: শুভময় মিত্র

ছবি: শুভময় মিত্র

শুভময় মিত্র
শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০১৪ ০০:১০
Share: Save:

আকাশের বেলুনটা ফাটবে ফাটবে করছে। এক টুকরো নীল বা সাদার ছিটে নেই। সবটা গাঢ় চাপ চাপ ছাই এলোমেলো পেশি। ফুলে উঠছে কোথাও কোথাও। তার নীচে একটা পাতলা সবুজ দিগন্তরেখা। এর ঠিক নীচের মাত্রায় একটা শুকনো রাস্তা। মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে বাসটা। খারাপ হয়ে গেছে, একেবারে চুপ মেরে গেছে। সব মিলিয়ে মেজাজটা খারাপ হয়ে গেছে, তাই নেমে, একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছি।

বাসে লোক আছে। ছাদের লোক ছাদে, কেউ কেউ গামছা চাপা দিয়েছে মাথায়। ভেতরের সিট পাওয়া লোকরা সিটে, ছাড়ার ব্যাপার নেই। দাঁড়ানো লোকেরা দরজার কাছে। কারও কোনও ব্যস্ততা নেই। বাসের নীচে দুটো ছায়া হামাগুড়ি দিয়ে এ-দিক ও-দিক যাচ্ছে আসছে, ড্রাইভার আর তার স্যাঙাত।

এই যে আমি, একটু আলাদা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি, এটা সবাই দেখছে, বুঝতে পারছে আমি বাইরের লোক, শহরের লোক। গ্রাম্য ব্যাপারস্যাপার আমার ভাল লাগে না, এই বাস খারাপ হওয়া, লোকজনের গা না করে নিশ্চিন্তে বড়র-বড়র করা— বিশ্রী লাগে। অপ্রিয় দৃশ্য দেখব না বলে পিছনে তাকালাম। জবজবে ধানখেত। মাঝখান দিয়ে রাস্তা মতো কিছু একটা আছে, একটু দূরে একটা বাঁশঝাড়। তার পিছনে একটা জঙ্গুলে জায়গা। একটু হেঁটে আসা যেতে পারে।

পিছন ফিরে পা বাড়ালাম। বাস থেকে এক জন চেঁচিয়ে বলল, ‘রাজবাড়িটা দেখে আসুন। সময় লাগবে। পয়সা লাগবে না।’ শুনতে না পাওয়ার ভান করে এগোলাম ও-দিকে। বাঁশবনটা আরও অন্ধকার, চাপ চাপ সবুজ থরথর করে কাঁপছে চারপাশে। হাঁসের ডাক কানে এল। লোকালয় থাকতে পারে আশেপাশে। একটা বাঁকের মুখে পায়ের শব্দ পেলাম ভিজে, নরম মাটিতে। আসছে এক জন। সপসপ ভিজে কাপড় জড়ানো যা হোক করে, হাতে তেল, সাবান। সরে দাঁড়ালাম, দরকার ছিল না যদিও। চোখাচোখি হল, ভুরুটা প্লাক করা।

জঙ্গল ঠিক নয়, অনেক গাছ, ঝোপঝাড় বেড়ে গেছে। প্রথমে কিছু ভাঙা ইট, তার পর একটা শ্যাওলা জমা দেওয়াল দেখা গেল। একটু এগোতেই দেখি দেওয়ালে একটা বড় গর্ত, এতটাই বড় যে মানুষ গলে যায়। উঁকি দিলাম। মস্ত পোড়ো বাড়ি। এটাই তার মানে রাজবাড়ি। মনে হয় এটা পিছনের দিক। ঢুকে পড়লাম।

সাবধানে হেঁটে সামনে পৌঁছলাম। উঠোনে ছ’জোড়া রোমান কলম, দাঁড়িয়ে আছে। একটার মাথায় রয়েছে পরি। খসে গেছে কোনও এক কালে করা প্লাস্টারের তৈরি কাপড়টা। বাকি পাঁচটা পরি ছিল নিশ্চয়ই এক সময়। হয়তো উড়ে গেছে ভারী আকাশ পেরিয়ে অন্য কোনওখানে। চাতাল থেকে চওড়া সিঁড়ি ধরে উঠলাম আগাপাশতলা প্রাণহীন বাড়িটার হাট করে খোলা সদর দরজার দিকে। একটা পুরনো মিষ্টি গন্ধ নাকে এল। চোখে পড়ল পড়ে থাকা একটা লাল চিরুনি।

ভেতরের দেওয়ালগুলোর অবস্থা শোচনীয়, ক্ষয়ে লাল শুকনো মাংস বেরিয়ে পড়েছে। যত্রতত্র খসে পড়া পুরনো কড়ি-বরগা। কোথাও কোনও আসবাবপত্র বা জানলার কাঠ নেই। সব মিলিয়ে গেছে। দেওয়ালে যেখানে চুন-সুরকির প্লাস্টার আছে, সেখানে সময় এঁকে দিয়েছে অজানা মহাদেশের ম্যাপ। তার মধ্যেই এক জায়গায় রুখে দাঁড়িয়ে আছে একটা রাগী পেরেক। তার থেকে এখনও ঝুলছে ছবিহীন, কাচহীন একটা মৃত, স্বজন-পরিত্যক্ত কাঠের ফ্রেম। ওই পেরেক থেকে অন্য দেওয়ালের আর একটা পেরেক পর্যন্ত বাঁধা নীল নাইলনের দড়ি। তাতে একটা সাদামাটা কাপড় ঝুলছে। ছুঁলাম। ভিজে। বুকটা একটু গুমগুম করে উঠল, ভাবলাম চলে যাই এ বারে। কিন্তু এক পাশের ঘোরানো সিঁড়িটা আমাকে টানছিল।

পা দিয়েই দেখলাম ধুলোয় পায়ের ছাপ পড়ছে। অর্থাৎ, কেউ ওঠে না। ল্যান্ডিংয়ের পরের অংশটা অনেকটা ভাঙা, বাকিটা ঝুলছে। রিস্ক নিয়েই উঠলাম ছাদ পর্যন্ত। আমাকে দেখামাত্র আকাশ ডেকে উঠল, হাওয়া উঠল এলোপাথাড়ি। ন্যাড়া ছাদের কার্নিসের নীচে কেঁপে উঠল গাছপালা। তার পর সব থেমে গেল। দূরে কোথাও বাজ পড়ল। পরমুহূর্তে ফিরে এল পাগলা হাওয়ার স্রোত। সমস্ত জঙ্গল ডাইনে বাঁয়ে প্রবল ভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে আমাকে সাবধান করতে লাগল। কিন্তু কার্নিসটা যে আমাকে টানছিল।

ধারে পৌঁছতেই গাছপালার আড়ালে জল দেখা গেল। সেখানে বৃষ্টির ফোঁটা ফুটে উঠছে বৃত্তাকারে। জলের ধারে পাড়। পাড়ে কাদের যেন নড়াচড়া, কথাবার্তা, গ্রামের পুকুর। চানের ঘাট। চার পাশে জঙ্গলের আব্রু আছে। নিশ্চিন্তে নেমেছে মেয়েরা।

আমার কপালে জল পড়তেই ছিটকে পিছিয়ে এলাম। ভিজে লাভ নেই। ফেরা দরকার। ওরা আমাকে দেখতে পেলে যাচ্ছেতাই কাণ্ড হবে। আদিবাসী এলাকা। বৃষ্টি বাড়ছে, ফেরাটাও মুশকিলের হবে। দাঁড়াব একটু? ভাবতে ভাবতে আবার চোখ গেল পুকুরে। কালো পরিরা উঠছে এ বারে, ধীরেসুস্থে। হঠাৎ জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল সব কিছু। যেতেই ঘামতে শুরু করলাম। দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু বুঝতে পারছি গাছপালার তলা দিয়ে ওরা এ-দিকেই আসছে।

আমি নিশ্চিত জানি বাসটা এত ক্ষণে চালু হয়ে গেছে। এক-দু’বার হর্নও দেবে হয়তো। কেউ বৃষ্টি মাথায় আমাকে ডাকতেও আসবে না। ওরা জাস্ট চলে যাবে। মেয়েদের গলার শব্দটা এখন আরও কাছে, আমার ঠিক নীচে। অন্ধকার, দাগি, ঝুরো দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে আমার, এতটুকু নড়াচড়া করা যাবে না। ওদের কলরবলর ঘসরমসরটা এখন আরও কাছে। স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি ওদের কথাবার্তা, মনে হয় মেয়েলি ইয়ার্কি-ঠাট্টা চলছে। ভাষা না বুঝলেও শব্দ থেকে অনেক কিছু বোঝা যায়। হঠাৎ সবাই চুপ করে গেল।

বাইরেও মেঘের ডাক থেমে গেছে। ওরা কি কিছু বুঝতে পেরেছে? আমার পায়ের ছাপ কি চোখে পড়েছে? জানি না রেখে এসেছি কি না। ওদের কাপড় ছাড়া হয়ে গেছে? পরীক্ষা করার উপায় নেই। ওরা সব চুপ কেন? কেউ কি খুব আস্তে আস্তে, এক জনই, ভীষণ জ্বলজ্বলে চোখে উঠে আসছে সিঁড়ি দিয়ে? ল্যান্ডিং পর্যন্ত না এলে আমাকে দেখতে পাওয়া অসম্ভব। তা ছাড়া যখন-তখন ভেঙে পড়তে পারে এমন সিঁড়িতে এরা পা দেওয়ার সাহসই পাবে না।

চুপ করে, নিশ্বাস চেপে তাকিয়ে রইলাম প্রায় অন্ধকার সিঁড়ির বাঁকটার দিকে। এখনও কোনও শব্দ নেই। আমার মন বলছে ওদের কেউ আসবে না। নেমে যাবে সন্দেহের পারদ। এমনিই হয়তো যে অবস্থায় আছে তাতে ঠিক কথা বলা যায় না। নিশ্চয়ই ভাঙবে নৈঃশব্দ্য, কলবল করে এক্ষুনি বেরিয়ে যাবে ওরা। তার পর ধীরেসুস্থে, খুব সাবধানে, আমি।

ভাঙল অন্ধকার নিস্তব্ধতা। বেজে উঠল হাতুড়ি-পেটা বুকের সঙ্গে লেপটে থাকা আমার মোবাইল ফোনটা।

suvolama@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

subhamoy maitra subhamoy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE