Advertisement
০২ মে ২০২৪

ট্রেনে গান

‘প্যাসেঞ্জারমহলে উপস্থিত যাঁরা বসে, দাঁড়িয়ে, আপনাদের যাত্রা শুভ হোক, বাংলা আধুনিক গান দিয়ে শুরু করব, শুনতে থাকুন সঙ্গে আছি—’ লিথছেন নীলার্ণব চক্রবর্তীসংসারটাকে বড় ভালবাসি দাদা। তাই আমার কিছু হল না। ট্রেনে গান গাইতে গাইতেই এক দিন মুম্বইয়ের অফার পেয়েছিলাম। এই বাক্স (সামনে রাখা একটা বক্স দেখিয়ে, সেখানে মিউজিক ট্র্যাক বাজে) নিয়ে গেছিলাম সেখানে। কিন্তু সংসারের টানে থাকতে পারিনি। মালদায় একটা বার-এ গাইবারও অফার পেয়েছিলাম এক দিন ট্রেনেই। সেখানে ছিল এলাহি ব্যবস্থা। ওয়েটাররা আমায় স্যালুট করত। যা চাইব, সামনে হাজির।

ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

সংসারটাকে বড় ভালবাসি দাদা। তাই আমার কিছু হল না। ট্রেনে গান গাইতে গাইতেই এক দিন মুম্বইয়ের অফার পেয়েছিলাম। এই বাক্স (সামনে রাখা একটা বক্স দেখিয়ে, সেখানে মিউজিক ট্র্যাক বাজে) নিয়ে গেছিলাম সেখানে। কিন্তু সংসারের টানে থাকতে পারিনি। মালদায় একটা বার-এ গাইবারও অফার পেয়েছিলাম এক দিন ট্রেনেই। সেখানে ছিল এলাহি ব্যবস্থা। ওয়েটাররা আমায় স্যালুট করত। যা চাইব, সামনে হাজির। একটা টেলিফোন কোম্পানিতে ভাল টাকার চাকরি পেয়েছিলাম, কিন্তু সেখানেও বাইরে বাইরে থাকতে হবে। সংসার ছেড়ে থাকতে পারব না দাদা। ব্যাটাছেলের আসল কাজ সংসার সামলানো, গান করাটা তো অনেক পরে। তাই ট্রেনেই গান করে যেতে হচ্ছে। তবে, কত প্রশংসা পাই, এমনও হয়েছে গলা থেকে সোনার চেন খুলে দিয়ে দিয়েছে!’ কথা বলতে বলতে হঠাত্‌ থেমে গিয়ে, ‘চলতে চলতে মেরে ইয়ে গীত ইয়াদ রখনা...’ গুনগুন করে উঠলেন ট্রেনের দাপুটে কিশোরকণ্ঠী সিঙ্গার কুমারজিত্‌ ওরফে রঞ্জিত ভট্টাচার্য। পিয়ালিতে বিদ্যাধরী নদীর (বিদ্যাধরী কবে হেজে-মজে গেছে) চরে বাড়ি তাঁর। এক দিন ট্রেনে আলাপ হতেই বললেন, চলে আসুন বাড়িতে, কথা হবে চায়ে চুমুক দিতে দিতে। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে হাজির হয়েছি এখানে।

‘তখন ক্লাসিকালে এইট্‌থ্‌ ইয়ার কমপ্লিট করেছি। টাকাকড়ির অভাবে আর এগোনো হবে না, পড়াশুনোও ছাড়তে হয়েছে, ঘরে অভাব, চাকরিবাকরি পাচ্ছি না। ’৯০-’৯১ সাল। ট্রেনে অসীম চক্রবর্তী নামে একজন ক্যাসিয়ো বাজাত, গান করত রাজু সিংহ। মহম্মদ রফির গান। আমরা দু-একজন কামরায় কামরায় ঘুরে ওদের গান মন দিয়ে শুনতাম। আমি এমনি এ দিক-ও দিক গাইতাম কিশোরজির গান, লোকজন প্রশংসাও করত। আর ভাবতাম, রাজুদার দলে গান গাইলে কী ভালই না হয়! এক দিন সাহস করে গিয়ে আলাপ করে ফেললাম, ওরা আমায় দলে নিতে রাজি হয়ে গেল। আমি কিশোরকণ্ঠী, রাজুদা রফি। জমে ক্ষীর হয়ে গেল! তার পর ’৯৬ নাগাদ এল ‘কারাওকে’, মানে ট্র্যাক ক্যাসেট। আমাদের গানে পরিবর্তন হয়ে গেল দাদা। এখনও মনে আছে, ‘আনন্দ আশ্রম’ ছবির ‘আশা ছিল, ভালবাসা ছিল’ গানের ট্র্যাক প্রথম এসেছিল বাজারে! তবে একটা কথা, ট্র্যাক আপনাকে কোনও সময় দেবে না, টাইমিংয়ে একটু এ দিক-ও দিক হয়ে গেলেই গান বেসুরো শোনাবে!

‘অনেকে ভাবে আমি গাইছি না, রেকর্ড গাইছে। এক বার এক জন এসে বলল-- এই যে ভাই, কী ইয়ার্কি করছ, ক্যাসেটে গান বাজিয়ে বলছ নিজে গাইছি, তার পর মাইক্রোফোন চেপে ধরল— সত্যি যদি গাইতে পার, পাঁচশো টাকা দেব! তখন আমি ‘প্রেমনগর’ ছবিতে কিশোরজির গাওয়া ‘ইয়ে লাল রং কব মুঝে ছোড়েগা’ গাইছিলাম— থামিয়ে দিলাম! ব্যস, শুধু ট্র্যাক এমনি বেজে যেতে লাগল... লোকটা বুঝতে পারল ওর ভুল। মাইক্রোফোন ছাড়তেই, আমি বললাম, এ বার পাঁচশো টাকা দিন আর সবাইকে বলুন আপনার ভুল হয়ে গেছে!

‘আমার সঙ্গে আমার বউও ট্রেনে প্রোগ্রাম করে। একসঙ্গে গাইলে ঠিক যেন কিশোর-আশা! কিশোরকুমারের আত্মাটাই ঢুকে গেছে ভিতরে। ট্রেনে উঠলেই সবাই বলে, ওই যে কিশোরদা এসেছে। কিশোরকুমারই আমাকে ভাত জুটিয়ে দিচ্ছে দাদা, আমি কিছু না!’

কথায় কথায় বেলা পড়ে এল। কুমারজিত্‌ আমাকে দুপুরে ভাত খাওয়ানোর জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন, আমি ওঁকে গান শোনানোর জন্য। বছর চল্লিশের কিশোরকণ্ঠী দু’কলি গাইলেন রফিসাহেবের গান: আজ মও...সম বড়া, বেইমান হ্যায়... বড়া—

সোনারপুর স্টেশনে বাবুলালের চায়ের দোকান। কাজে যাওয়ার আগে ট্রেন-সিংগারদের অনেকের আড্ডা-এলাকা। হাস্যমুখ বাবুলালের সঙ্গে অনেকেরই দুরন্ত দোস্তি। এঁদের অনেক কিস্‌সাও জানেন বাবু: ‘এই ট্রেন লাইনে দেশলাইবাক্স বাজিয়ে গান করত এক জন। রফির গান। অবিকল রফিসাবই যেন নেমে আসতেন। তার নাম বাপি ভট্টাচার্য। কেউ বলত আংকল, কেউ জ্যাঠামশাই, সিনিয়র বলে সম্মান দিত আর কী! ট্র্যাক নেই কিছু নেই, দেশলাই বাজিয়ে গান করে ফাটিয়ে দিত। কিন্তু এক দিন ওর ব্রেন ক্যানসার ধরা পড়ল। কেমন একটা হয়ে গেল, মাঝেমাঝেই নেশা করত, বলত, গানবাজনা করি বাবুলাল, একটু নেশাটেশা না করলে চলে!’ কথা থামিয়ে দোকানের ক্যাশবাক্স হাতড়ে বাবুলাল বের করলেন একটা হাতঘড়ি, ‘দেখুন, এটা আংকলের ঘড়ি। আমার কাছে জমা রেখে টাকা নিয়ে গেছিল, জলের মতো খরচা হচ্ছিল ওর...তার পর এক দিন মরে গেল দাদা...অমন সুন্দর গলা শেষ হয়ে গেল...’

বাবুলাল এসব যখন বলছেন, আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন এক জন, প্রায় নিঃশব্দেই, চোখাচোখি হতেই ‘নমস্কার দাদা, আমার নাম কুমার শুভাশিস, মানে শুভাশিস অধিকারী, আমিও ট্রেন লাইনে গান করতাম, থাকি সোনারপুরের ফুলরহাটে...’ আমি তখন আংকলের কথা ভাবছিলাম, একটু যেন আনমনে জিজ্ঞেস: ‘এখন কি আর...’ ‘না না, আর গাই না, পারি-ও না’, একটু গোপন গলায় ‘বাঁচব না বেশি দিন...’ ‘কেন বলুন তো?’ হুঁশ পুরোপুরি ফিরল।

একটা সুরেলা হাস্কি গলা শুরু করল, ‘ট্রেনে গান করতে করতে এক দিন মুম্বইতে অফার পেয়ে গেলাম। সেখানে একটা বার-এ গাইতাম। অনেক টাকা কামাতাম। কিন্তু এক দিন জানতে পারলাম, দুটো কিডনিই ড্যামেজ হয়ে গেছে। মুম্বই ছেড়ে চলে আসতে হল। এখন প্রতি মাসে ডায়ালিসিস! জমানো সব টাকা খরচ হয়ে গেছে। হাত পাততে হচ্ছে!’ বাঁ-হাতটা বাড়াতেই দেখা গেল ডায়ালিসিসের থাবা, ফোলা ফোলা শিরা হাতটাকে ঢেকে ফেলেছে!

ট্রেনে এক দিন গান গাইছিল একটা বছর ষোলো-সতেরোর ছেলে। কী ভাল সুর খেলছে গলায়! মুখে একটা বিষণ্ণ ভালবাসা মাখানো। আলাপ জমালাম। আদিত্য শিকারী, বাড়ি ক্যানিং নদীর ও-পারে, আমঝাড়া গ্রামে। বাবা-মা মনসার গান করেন। বাবা-মা’র সঙ্গে পঁুচকে বয়সেই তার জায়গায় জায়গায় যাওয়া শুরু। যখন ওঁরা মেক-আপ নিচ্ছেন, স্টেজে গান জমাত আদিত্য। হিন্দি গান। ‘পচুর হাততালি পইড়ত জা়নেন! সক্কলে বইলত আবার হোক আবার হোক... এক দিন ভাবি, বাবামা ছা়ড়ো, নিজের পায়ে দাঁইড়ে পড়ো। তখন টেরেনে যা়ওয়া-আসার পথে দেখতাম সব গায়ক লোকজনকে। ভাল্লাগত। এক দিন ওদের সঙ্গে কথা কইলাম, ওরা পেথমে গানটান শুনল, তার পর বইল্ল, কালেকশোন কর। বইল্ল, টেরেনে গান করার চ়েয়ে কালেকশোন করা ঢের শক্ত কাজ। কইরে দেখাতি হবে। একটা দাদা গান গাইল, ওদের শেখানো বুলি প্যায়েঞ্জারদের কাছে গিয়ে বইল্লাম। অনেকে টাকা দিল, অনেকে আবার নমো। দাদারা জবাব দিলেন, পাশ হই গেছি।’

তার সঙ্গী আর এক ট্রেন-সিংগার বছর পঁয়ত্রিশের যুবক হঠাত্‌ এই কথাবার্তায় ঝাঁপ কাটল, ‘কত যে প্রণাম পেয়েছি গুনে বলা যাবে না দাদা। ভগবানও এত প্রণাম পায় না। টাকা চাইতে গেলেই প্রণাম দেয়। মানে এ বার আসুন! সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত গান করেও কোনও কোনও দিন পকেট ফাঁকা। কী ভাবে বাড়ি যাব? বাচ্চার দুধ কিনতে হবে। আলু কিনতে হবে। কী করে কিনব? স্টেশনে বসে থাকি, ‘ইয়ে দুনিয়া ইয়ে মেহফিল কোই কাম কি নেহি’ গানটা ভিতরে পাক খায়, কান্না আসে। আগে কিন্তু এমন ছিল না, ভালই রোজগার হত, এখন অনেক বেকার ছেলে এসে গেছে এ লাইনে। তাই রোজগার অনেক কমে গেছে। ট্রেনে আলাপ করে কত লোক চাকরি দেওয়ার কথা বলে, ভিজিটিং কার্ড দিয়ে যায়। কার্ডের ঠিকানা ধরে গিয়ে দেখি লোকটা চিনতেই পারছে না। ফোন করে দেখি, কেটে দিচ্ছে। দু-তিনশো ভিজিটিং কার্ড জমে গেছে দাদা!’ যুবকের নাম বিভাস চক্রবর্তী। সোনারপুরের কামরাবাদে বাড়ি। ‘আবার ভালবাসা যে পাইনি, তা নয়। এক বার ‘মেরা জীবন কোরা কাগজ’ গানটা গাইবার পর এক জন পাগলের মতো এসে পা জড়িয়ে ধরল! কিছুতেই ছাড়াতে পারি না। দেখি পায়ের পাতা দুটো চোখের জলে ভিজে গেছে। ট্রেনে গান গাওয়া ছাড়তে পারব না দাদা, ভালবেসে ফেলেছি।’

ট্রেনে এক জনের সঙ্গে আলাপ হল, যিনি শুধু ধুঁয়াধার গায়কই নন, ট্রেন-সিংগারদের লিডারও। বাপি বন্দ্যোপাধ্যায়। ফরসা, বেঁটেখাটো চেহারা। তখন সবে শেষ করেছেন— ‘ফিরে এল না সে চলে গেল দিন...’ আমি কথা বাড়াতে যেতেই বললেন, চলে আসুন না এক দিন আমাদের ঘরে। অনেকেরই দেখা পাবেন। বাপির ডিরেকশন মেনে বাঘা‌যতীন স্টেশনে হাজির হলাম। সেখান থেকে মিনিট পাঁচেক হেঁটে, বাপিদের আড্ডা। ছোট ঘুপচি ঘর। একটা ততোধিক ছোট বিছানা। মেঝেতে ঘেঁষাঘেঁষি পাঁচ-ছটা মিউজিক বক্স, আলো-অন্ধকারে কয়েকজন সিংগার বসে, পা ফেলার জায়গা প্রায় নেই। এক জন মিউজিক বক্সে ট্র্যাক টিউন করে যাচ্ছে। বাপি বললেন, ‘এটা গায়কদের ঘর। কয়েক জন মিলে এই ঘরটা ভাড়া নেওয়া হয়েছে। মিউজিক বক্সগুলো এখানে রাখা হয়। গলা সাধা হয়। এক একটা বক্স-পিছু তিন জন থাকে। এক জন গান করে, দুজন কালেকশন। ‌যারা কালেকশন করে তারাও কিন্তু গায়ক। কোনও প্রোগ্রামে তাদের কেউ গান করে, অন্য দুজন কালেকশন। ‌কালেকশন তিন ভাগ করে নেওয়া হয়। এই ভাবে চলছে...’ কথাবার্তার মধ্যে আমার জন্য কাচের গ্লাসে শরবত। সবুজ রঙের। একটু ইতস্তত করতেই বাপি বললেন, ‘খান, ধনেপাতার শরবত, শরীরের পক্ষে ভাল।’ আলাপ হল এক সিনিয়র গায়কের সঙ্গে। অশোক দাস ওরফে কুমার অশোক। ‘সেল্‌স-এর কাজ করতাম, আর গানবাজনা। চায়ের দোকানে টেবিল ঠুকে, গুনগুন করে, বাথরুমে, রাস্তায় চলতে চলতে। আমার বন্ধু ছিল রঞ্জিত। রঞ্জিত এক দিন অসীমদাদের দলে ঢুকে গেল। আমি বুঝতে পারছি না কী করব! তার পর এক দিন আমিও সেল্‌স-এর চাকরি ছেড়ে দিয়ে অসীমদার সঙ্গে শুরু করে দিলাম ট্রেনে গানের সফর! জীবন বদলে গেল।

‘ভালই সাড়া পাই, জানেন। কিশোর-রফি-মুকেশ-লতা-আশা-শানু, এঁদের আশীর্বাদে চলছে। তবে কম্পার্টমেন্টের হাওয়া বুঝে গান করতে হয়। যদি অনেক বয়স্ক মানুষ থাকে, তবে স্যাড গান, যেমন ‘চিঙ্গারি কোই ভড়কে’। অনেক সময় রবীন্দ্রসংগীতও গাই, বা বাংলা আধুনিক। ছাত্রছাত্রীরা থাকলে ‘খাইকে পান বনারসওয়ালা’ বা এখনকার হিট হিন্দি গান। আবার যাত্রাশেষের দিকে, ধরুন পার্কসার্কাস ছাড়লে জমাটি গান ধরতে হয়— ‘কে পাগ ঘুংরু বান্ধ মীরা নাচি থি’ আপনাকে পার্কসার্কাস থেকে শিয়ালদা পৌঁছে দেবে। হিসেব না মেনে গান গাইলে ভাল রোজগার হতে চায় না, বুঝলেন?’

মিউজিক বক্সগুলো নিয়ে কৌতূহলী হতেই কুমার অশোক বললেন, ‘সাউন্ড মিক্সার, ডিজিটাল ইকো, ৪০-৪৪ বোর্ড, ব্যাটারি এই সব দিয়ে এই সাউন্ড বক্স বানানো, মালগুলো চাঁদনি থেকে এনে আমরাই বানাই। পেনড্রাইভে গানের ট্র্যাকগুলো নিয়ে গুঁজে দেওয়া হয়, ব্যস। ট্র্যাক বাজাও, গান গাও, কোনও হ্যান্ডসের গল্প নেই...’

ঘরের এক পাশে টুলে বছর বাইশ-তেইশের একটি মেয়ে বসে। বাপি আলাপ করিয়ে দিলেন। প্রিয়াংকা রায়। মানে মিস প্রিয়াংকা। আলাপ হতেই একটু চোখ নিচু করে হাসলেন মিস। বাপি বললেন, ‘ট্রেন লাইনে প্রিয়াংকা রায়, পিঙ্কি হেলা এ রকম হাতে গোনা কয়েক জন ফিমেল সিংগার রয়েছে। ফিমেল না থাকলে ডুয়েট হয় না, তাই এরাই ভরসা!’ একটু থেমে কী ভেবে নিয়ে: ‘প্রিয়াংকা দুবাইতে চলে ‌যেত জানেন, ‌যদি সে দিন... বছর তিনেক আগের কথা...’ বাপির মুখ থেকে কথা কাড়লেন মিস প্রিয়াংকা— ‘দুপুর বারোটা সাড়ে বারোটা হবে। শ্যালদা বারো নম্বরে এক কোনায় বসে বসে কাঁদছিলাম। তখনই বাপিদা এসে...

‘থাকি গোবরডাঙায়। বাবা নেই, বাড়িতে খুব অভাব। এক জন চাকরি দেবে বলল, তার সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। টেরেনে আসতে আসতে শুনি সে ফোনে কার সঙ্গে যেন দুবাইয়ের কথা বলছে। দুবাই শুনেই ভয় পেলাম। শ্যালদা স্টেশনে নেমে বললাম, যাব না। সে অনেক বোঝাল, কিন্তু আমার তখন গোঁ ধরেছে! লোকটা আস্তে আস্তে কেটে গেল। আমি কী করব! আমার খুব কান্না পেয়ে গেল।’

বাপি বললেন, ‘দুটো আটান্নর বারুইপুর লোকালে তখন শিয়ালদা নেমেছি। সাউন্ডবক্স নামাচ্ছি, টাকাপয়সা গুনব, দেখতে পেলাম ওকে... সব জানতে পেরে জিগ্যেস করলাম, গান গাইতে পারবে? ও মাথা নাড়ল। ওর বাড়ি গিয়ে মাকে বোঝালাম, বললাম, ভাল লাইন, চেষ্টা করলে দু’বেলা ডালভাত জুটে যাবে। ব্যস, প্রিয়াংকা ঢুকে পড়ল গানের টিমে।’

সিংগারদের বিদায় জানিয়ে ঘর থেকে যখন বেরতে যাচ্ছি, বাপি পিছু ডাকলেন— ‘দাদা যাওয়ার আগে শুনে যান আমরা প্রোগ্রামের সময় কী বলি—’ আমি ঘুরে দাঁড়াতেই— ‘প্যাসেঞ্জারমহলে উপস্থিত যাঁরা বসে আছেন, বা দাঁড়িয়ে আছেন, আপনাদের যাত্রা শুভ হোক, সর্বপ্রথম বাংলা আধুনিক গান দিয়ে শুরু করব, শুনতে থাকুন সঙ্গে আছি-- বেশ কিছু গানের সঙ্গে বেশ কিছু দূর পৌঁছে দেব... এর পর দু-তিনটে গান করি, তার পর যখন কালেকশন শুরু হয়, বলি— অনেকে হয়তো মনে মনে ভাবছেন, এরা গানবাজনা করে ট্রেন কম্পার্টমেন্টে হাত পাতছে, কী করব স্যর, বর্তমানটা চালাচ্ছি এই ভাবে। বেকারির যা অবস্থা! অনেক ভাইবোন ইন্টারভিউ দিতে দিতে নিজেদের জুতোগুলো ছিঁড়ে ফেলেছেন। চাকরি নেই, পজিশন নেই, মানি নেই। কেউ কেউ অসত্‌ পথে চলে গিয়ে নিজেদের সংসারটা চালাচ্ছে। আমরা ও রকম কোনও অসত্‌ কর্ম নিয়ে আসিনি। সত্‌ প্রচেষ্টা, সত্‌ কালচার নিয়ে এসেছি। যদি মনে করেন ছেলেটা সত্‌ ভাবে বাঁচতে চাইছে, ওকে কিছু দেওয়া উচিত, তাহলে সামথিং আশা রাখব স্যর। মানি লস সামথিং লস স্যার, ক্যারেকটার লস এভরিথিং লস! টাকা হারিয়ে গেলে টাকা পাওয়া যায়, মানুষের চরিত্র হারিয়ে গেলে কোনও দিন পাওয়া যায় না স্যর, তাই এই লাইনটা বেছে নিয়েছি। পুলিশে ধরল না, মারও খেতে হল না, গান গাই, তার বিনিময়ে পয়সা নিই...’ শুনতে শুনতে কেমন মনে হল, ব্যাকগ্রাউন্ডে একটা ট্র্যাকে অনবরত ট্রেনের সাউন্ড চলছে।

nilarnab1@gmail.com

এই প্রচ্ছদকাহিনি কেমন লাগল? মন্তব্য করতে, এই ফেসবুক পেজ-এ যান: www.facebook.com/anandabazar.abp

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE