ল্যারি ‘ডক’ স্পোর্টেল্লোকে ওর চেনাজানা সব্বাই ‘ডক’ বলেই ডাকে। ডক লস অ্যাঞ্জেলেস-এর একটা হিপি দলের সর্দার। তার ডেনিম শার্ট, মিলিটারি-মার্কা সবজেটে জ্যাকেট, বিদঘুটে সানগ্লাস, চোয়াল অবধি নেমে আসা ইয়া ঝুলপি আর ঘাড়-কলার ছাপানো রুখুশুখু লম্বা চুলে সত্তরের হিপি ফ্যাশনের জ্যান্ত ছাপ। আর তাদের ঘরোয়া আড্ডা গাঁজা-চরস-কোকেনের ধুমকিতে চনমনে রঙিন, টলমল নেশালু! কিন্তু ডক শুধুই সিগারেটের খোলে গাঁজা পুরে দম মারার পাবলিক নয়। ফেলু মিত্তিরের মতোই সে-ও যাকে বলে রীতিমত অফিসটফিসওয়ালা প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর, মানে পেশাদার ‘টিকটিকি’! তা এই টিকটিকিমশাই নেশায় যতই চুর থাকুক, তার কাছে কেস-টেস কিন্তু মন্দ আসে না! এই তো ছবির গোড়াতেই সমুদ্রের ধারে তাঁর এঁদো রদ্দি অন্ধকার-অন্ধকার ডেরা আলো করে এসেছিল শাস্তা— ডকের পুরনো গার্লফ্রেন্ড।
কিন্তু এ আসা প্রাক্তন প্রেমিকের সঙ্গে কোনও রোম্যান্টিক মোলাকাতের জন্য নয়। শাস্তা আজ এসেছে ডকের মক্কেল হয়ে। কারণ, তার আশঙ্কা, তার এখনকার প্রেমিক— গোটা ক্যালিফোর্নিয়ার রিয়েল এস্টেট ব্যবসার বেতাজ বাদশা— মিকি উল্ফমানকে, পাগল সাজিয়ে অ্যাসাইলামে ভর্তি করে দেওয়ার ছক কষছে মিকির বউ আর বউয়ের আধ্যাত্মিক গুরুদেব-কাম-বয়ফ্রেন্ড। ও দিকে শাস্তা যেতে না যেতেই ডক অফিসে গিয়ে দেখে, আর এক জন মক্কেল বসে আছে। তারিক খলিল নামে এই আফ্রো-আমেরিকান মুসলিম ভদ্রলোক ‘ব্ল্যাক গেরিলা’ নামে একটা গুপ্ত সংগঠনের সদস্য। সে আবার গ্লেন শার্লক নামে একটা লোককে খুঁজছে, যে টাকা ধার করে নিখোঁজ হয়ে গেছে। এই শার্লক হল ভয়ানক বর্ণবিদ্বেষী গ্যাং ‘এরিয়ান ব্রাদারহুড’-এর ঠ্যাঙাড়ে, আবার শাস্তার সেই প্রেমিক মিকির বডিগার্ডও। পাঠকের নিশ্চয়ই এই অবধি পড়েই বেশ মাথা ঝিমঝিম করছে? তা হলে আরও একটু গুলিয়ে দিই। খলিলের দেওয়া অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে শার্লককে খুঁজতে ডক মিকিরই বানানো একটা এস্টেটে যায়, যেটা আসলে কায়দাবাজিওয়ালা একটা বেশ্যাবাড়ি!
সেখানে মাথায় বেসবল-ব্যাটের বাড়ি খেয়ে সে মুচ্ছো যায়। জ্ঞান ফিরলে দেখে, সে বালির ওপর একটা লাশের পাশে শুয়ে— আর সেই লাশটা শার্লকের। লস অ্যাঞ্জেলেসের পুলিশ গোয়েন্দাবাবাজিকেই থানায় নিয়ে যায়। সেখানে সে জানতে পারে, মিকি আর শাস্তাও আপাতত বেপাত্তা! পুলিশের হ্যাপা সামলে ফিরে এসে ডক আর একটা কেস পায়। এক স্যাক্সোফোন-বাজিয়ের একদা হেরোইনখোর বউ এসে বলে, তার বরকেও পাওয়া যাচ্ছে না, খুঁজে দিতে হবে।
তদন্তে নেমে ডক টের পায়, তার হাতের তিনটে মামলাই কোথাও একটা আর একটার সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে। আরও বেশি বেশি জট, আরও নতুন নতুন গিঁট, আরও অনেক অনেক চরিত্র আর ঘটনায় চিত্রনাট্য ভরে যাচ্ছে। টমাস পিঞ্চন-এর একই নামের উপন্যাসটাকে এ ভাবেই পরদায় এনেছেন পরিচালক। ছবির এই থ্রিলার-থ্রিলার ভাবটা আসলে স্রেফ মোড়ক। ’৭০-এর হলিউডি গ্যাংস্টার সিনেমার ফর্মুলা, যেখানে ড্রাগ-মাফিয়া আর ‘গোল্ডেন’ অমুক-তমুক নামের সব সিন্ডিকেট একেবারে অনিবার্য ব্যাপার, সেটা নিয়ে একটা স্পুফ তো আছেই। আর সিনেমার যে সর্বশক্তিমান সুপারস্মার্ট গোয়েন্দা, আমাদের ডক তো ঠিক তার উলটো বাগে দাঁড়িয়ে আছে! সে সমাজছাড়া, চালচুলোহীন একটা হিপি, নেশাখোর মানুষ, সাত জন্মে না-কাচা জামাকাপড়ে পারফিউম লাগিয়ে চালায়, পুলিশ এটা-ওটা কেসে তাকে যখন-তখন ফাঁসিয়ে দেয়! ক্ষমতা তাকে বরাবর ভুরু কুঁচকে সন্দেহের চোখে দেখে।
এই লোকটা একটা বিদঘুটে রহস্যের সুড়ঙ্গ দিয়ে পিছলে গেছে তো গেছেই। সেই রহস্যের লাগাম কক্ষনও তার হাতে থাকেনি। নায়কদের বেলায় যেটা কক্ষনও হয় না! নেশাগ্রস্তের খোয়াবনামার মতোই এ ছবির ন্যারেটিভ এগিয়েছে। একটা ঘটনার ওপর আর একটা ঘটনার পরত চেপেছে। আর ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর-এর মতোই সেই ন্যারেটিভকে ভাসিয়ে রেখেছে ’৭০ দশকের বিভিন্ন অনুষঙ্গ। সেটা কখনও ভিয়েতনাম যুদ্ধ-বিরোধিতা, কখনও ট্যাবলয়েডে হইচই ফেলা কোনও স্থানীয় কেচ্ছা। আর অবশ্যই অজস্র চেনা সুর-গানের ঝলক। উপন্যাসে যেটা ছিল না, ছবির শেষটায় কিন্তু এক মানবিক মোচড়ে ডকের ছন্নছাড়া জীবনে তার হারানো প্রেমকে ফিরিয়ে দেন পরিচালক। একেবারে শেষ দৃশ্যে আমরা ডককে দেখি, সে শাস্তাকে নিয়ে এক ঠিকানাহীন সফরে বেরিয়েছে। ডক অবশ্য বলে, ‘এর মানে এই নয় যে আমাদের সম্পর্কটা আবার আগের জায়গায় ফিরে গেল।’ কিন্তু শাস্তার মতোই আমরা দর্শকরাও সে কথাটা বিশ্বাস করি না। আপাতত।
sanajkol@gmail.com
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy