Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

দুই রাম

আটপুরের বাজারে দুটি ছেলে রোজ সকালে পশরা নিয়ে বসত। এক জন বিক্রি করত পটল, কুমড়ো, বেগুন। অন্য জন বেচত আপেল, পেয়ারা— এই সব। প্রথম ছেলেটির বয়স হবে ষোলো। তার নাম বেশিরাম, অন্য ছেলেটির নাম কমলাল, সে বেশিরামের চেয়ে বছর দুয়েকের ছোট। এরা দু’জনেই স্কুলের পড়া শেষ না করেই নেমে পড়েছিল ব্যবসা করে দু’পয়সা রোজগার করতে।

শৈবাল চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০১৪ ০১:০২
Share: Save:

আটপুরের বাজারে দুটি ছেলে রোজ সকালে পশরা নিয়ে বসত। এক জন বিক্রি করত পটল, কুমড়ো, বেগুন। অন্য জন বেচত আপেল, পেয়ারা— এই সব। প্রথম ছেলেটির বয়স হবে ষোলো। তার নাম বেশিরাম, অন্য ছেলেটির নাম কমলাল, সে বেশিরামের চেয়ে বছর দুয়েকের ছোট। এরা দু’জনেই স্কুলের পড়া শেষ না করেই নেমে পড়েছিল ব্যবসা করে দু’পয়সা রোজগার করতে।

আটপুরের বাজার খুব ছোট নয়। গ্রামে মানুষের সংখ্যাও বাড়ছিল দিন-দিন। তাই বাজারে ভালই ভিড় হত। বেশি আর কম কিন্তু বাজারের ভেতরে নয়, বসত বাইরে, গেটের সামনে। ভেতরে বসলে বাজার কমিটিকে ভাড়া দিতে হবে। সে পয়সা বাঁচানোর জন্যে তারা বসত বাইরে।

কাজ করে পয়সা রোজগার করা তো খারাপ নয়, বহু লোক তাই করে। কেউ চাকরি করে, কেউ স্বাধীন ব্যবসা। তবে তার বয়স আছে। বেশিরাম আর কমলাল যখন এ কাজ শুরু করেছিল, তখন তারা নাবালক। লেখাপড়ায় মন বসাতে পারেনি বলেই তারা বেছে নিয়েছিল এ পথ।

দুটি ছেলের এ রকম নাম হওয়ার পিছনে একটা করে কারণ আছে। বেশিরামেরা ছিল সাত ভাই, সবার নাম রাম দিয়ে— রামচরণ, রামগোপাল— এই রকম। বেশি যখন জন্মাল তখন তার ঠাকুরদা বললেন, ‘বড় বেশি রাম হয়ে গেছে আগে, ওর রামটা পিছনে দেওয়া যাক।’ তাই নাম হল বেশিরাম। ও দিকে কমলালদের পরিবারে ছেলেদের নামের শেষে থাকত লাল— নন্দলাল, হীরালাল— এই রকম। কমলাল ছিল পাঁচ নম্বর ছেলে। সে জন্মাতে তার ঠাকুমা বললেন, ‘বড় বেশি লাল দেখছি চোখে, এ ছেলের নামের লালটা দিয়ে দাও পিছনে।’ তাই নাম হল কমলাল।

কম আর বেশি কিন্তু তাদের নামের মানে বুঝেছিল অন্য ভাবে। মানে তাদের বোঝানো হল। গোপাল বলে তাদের স্কুলের এক ছেলে যে তাদেরই মতো লেখাপড়ায় ইতি দিয়ে ডাংগুলি খেলে বেড়ায়, সে তার বন্ধু বেশিরামকে বোঝাল, ‘দ্যাখ, তোর ঠাকুরদা তোর এই নাম দিয়েছে কেন বল তো? এই জন্যে যে তুই দোকানদারি করবি জিনিসের দাম বাজারদরের চেয়ে বেশি নিয়ে তাই?’ বেশিরাম অবাক হয়ে বলল, ‘তাই বুঝি?’ একগাল হেসে গোপাল জবাব দেয়, ‘হ্যাঁ, তাই তো! দেখবি, এমন করলে তুই দু’দিনে ফুলেফেঁপে উঠবি।’

বেশিরাম তাই করতে লাগল। যে শাকের দাম পনেরো টাকা কিলো, সেটা সে বিক্রি করতে লাগল পাঁচিশ টাকায়। খদ্দের সন্দেহবশে জিজ্ঞেস করলে সে জবাব দিত, ‘এ শাক খুব টাটকা বাবু, তাই দাম একটু বেশি। বাসি শাক আপনি কম দামে পাবেন।’

কমলাল বসত বেশির ঠিক পাশে। সে জিনিসের দাম নিত ঠিক, কিন্তু ওজনে দিত কম। খদ্দের দেখত তার ফল-পাকুড়ের দাম অন্য দোকানের সমান, তাই তার কাছ থেকেই জিনিস কিনত, বুঝত না তাকে কিলোয় দুশো গ্রাম কম দিচ্ছে কমলাল।

কমকে এ বুদ্ধি দিয়েছিল গোপালের ভাই নেপাল। সেও স্কুল পালিয়ে পাড়াময় চক্কর কেটে বেড়াত। সে কমলালকে বোঝাল, ‘দ্যাখ, বেশি কেমন দাম বেশি নিয়ে বাড়তি দু’পয়সা রোজগার করছে, তুই ওজনে ঠকা খদ্দেরকে, দেখবি দু’দিনে লাল হয়ে যাবি।’

এই ভাবেই চলছিল। এক দিন কিন্তু কম, বেশি দু’জনেই ধরা পড়ে গেল। জারিজুরি ফাঁস হয়ে গেল তাদের। বাজারের অন্য দোকানদারদের কেউ কেউ জানত যে ছেলে দুটি এই কারসাজি করে। তারা কোনও দিন এ নিয়ে মুখ খোলেনি। তার একটা কারণ— কম, বেশি দু’জনেই ছেলেমানুষ, দ্বিতীয় কারণ: দুটি ছেলেই বসে বাজারের বাইরে— বাজারের নিয়ম যেখানে খাটে না।

এক দিন হল কী, তুতুনের দাদু বাজার করতে এসে বেশিরামকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার পটল কত করে? বেশি একটুও দেরি না করে জবাব দিল, ‘আজ্ঞে, তিরিশ টাকা।’ দাদু অবাক হয়ে বললেন, ‘সে কী, আমার ছেলে যে রোজ বাজার করে সে যে আজ বলল পটল এখন কুড়ি টাকা দর যাচ্ছে।’ বেশি মুখভঙ্গি করে জবাব দিল, ‘সে বাবু চালানি পটল, তিন দিনের বাসি। আমার এ পটল সদ্য খেত থেকে তুলে আনা।’

‘সদ্য খেত থেকে তুলে আনা’, পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন হরিপদ নামে এক জন বয়স্ক দোকানদার তিনি থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘বাবু ও ডাহা মিথ্যে বলছে। আমি যে ফড়ের কাছ থেকে পটল কিনেছি, ও কিনেছে তারই কাছ থেকে। বরং দশ টাকা বাকি রেখে এসেছে। আমরা কুড়ি টাকায় কিনে সে পটল পঁচিশ টাকায় বিক্রি করছি। ও চাইছে তিরিশ। বাজারের বাইরে বসে এই কাজ করে ও, আজ নয় বেশ কিছু দিন ধরে।’

বেশি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ‘মিথ্যে কথা।’

মিথ্যে কথা, হরিবাবু গর্জে ওঠেন, ‘এই তোমরা কোথা গেলে, এসে বলো তো, আমি মিথ্যে বলছি না ও?’

সঙ্গে সঙ্গে পাঁচ-ছ’জন দোকানি এসে ঘিরে ফেলে বেশিরামকে, তাদের এক জন তুতুনের দাদুকে বলে, ‘হরিবাবু ঠিক কথাই বলেছেন বাবু, এই ছেলেটি বরাবর বেশি দাম হাঁকে। যারা বাজারের ভেতর ঢুকতে চায় না, তারা দাম যাচাই না করে ওর কাছ থেকে জিনিস কেনে। এতে তারা ঠকে, আমরাও। কেননা, এতে বাজারের বদনাম হয়।’

পবনবাবু মাথা নেড়ে বলেন, ‘এ তো ভাল কথা নয়, চলো তুমি বাজারের মালিকের কাছে। এই বয়সে তোমার এমন মতি, এর বিহিত হওয়া দরকার।’

বাজারের মালিকের নাম সাধুচরণ। তিনি সব শুনে বেশিরামের পশরা নিয়ে বাজারে বসা বন্ধ করে দিলেন। চৌকিদারকে হুকুম দিলেন, বেশি যেন গেটের সামনে দোকান দিতে না পারে। শেষে বেশিরাম তাঁর হাতে পায়ে ধরতে শাস্তির মেয়াদ কমিয়ে এক মাস করা হল।

এর দু’দিন পরে বিপদ ঘটল কমলালের। সে দিন তুতুনের মা এসেছিলেন বাজারে, কমের কাছে আপেল কিনে বললেন, ‘এ কী, পাঁচশো গ্রামে মোটে তিনটে আপেল উঠল। আমি অন্য দোকানে কিনি কম করে চারটে ওঠে, কখনও পাঁচটা। দেখি তোমার দাঁড়িপাল্লা।’ পরীক্ষা করে দেখা গেল কমের বাটখারা জাল। কিলোয় দুশো গ্রাম করে কম দেয় সে ওজনে।

মালিকের কাছে নালিশ যেতে তিনি ওই একই শাস্তি দিলেন কমলালকে— এক মাসের জন্যে সে দোকানদারি করতে পারবে না। বাজেয়াপ্ত করা হল তার দাঁড়িপাল্লাও।

পরে রামের সঙ্গে লালের দেখা হতে রাম বলল, আমরাই ঠকে গেলুম রে! এখন এক মাস আধপেটা খেয়ে থাকতে হবে আর বাজারের সবার কাছে যে ছোট হয়ে গেলুম সেটাও কম শাস্তি নয়...।

তার হাপুস নয়নে কান্না শুনে ভিজে উঠল কমের চোখ। হাত দিয়ে চোখ মুছে বলল, ‘আমার খুব দুঃখ হচ্ছে ভাই, লাভের গুড় পিঁপড়েয় খেল। বাবা আমায় খুব বকবে আর মা বোধ হয় কথাটিও বলবে না। মা’র জমানো পয়সা দিয়েই শুরু করেছিলুম এই ব্যবসা।’

এক মাস খুব বেশি সময় নয়, এক দিন তা ফুরিয়ে গেল। নতুন মাসের গোড়ায় আবার দুই বন্ধু বসেছে পাশাপাশি। তবে এ বার বাজারের বাইরে পথের ওপর নয় বাজারের ভেতরে, যেখানে অন্য দোকানিরা বসে সার বেঁধে তাদের পাশে।

বেশিরাম এখন ন্যায্য দাম নিচ্ছে, কমলাল ওজন দিচ্ছে ঠিকঠাক। যেমন ওদের দোকানদারির ধরন বদলে গেছে, তেমনই পাল্টে গেছে দুই ছেলের নামও। বেশিরাম হয়েছে ‘বলরাম’— অর্থাৎ রামই তার বল। রাম যে এক জন সৎপ্রকৃতির মানুষ, এ কে না জানে! আর কমলালের নাম হয়েছে ‘রামবল’— অর্থাৎ অসৎ উপায়ে ব্যবসা করা ছিঃ, রাম বল। বাজার সমিতিই ঠিক করে দিয়েছে এই নাম।

দুই দোকানির লাভের অঙ্ক এখন গেছে কমে, কিন্তু দু’জনের মুখের হাসি কেমন হয়েছে বলো তো? হ্যাঁ, ঠিক বলেছ, একেবারে গড়ের মাঠের মতো চওড়া।

ছবি: দেবাশীষ দেব

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE