মহাত্মা গাঁধী, এখন যেমন। ফোটোগ্রাফারের হাত ভয়ে, শ্রদ্ধায় ও রোমাঞ্চে কেঁপে যাওয়ায়, ছবিটা নড়ে গেছে।
কথাই হয়েছিল রাত দেড়টার আগে উনি আসছেন না। বেলেঘাটা অঞ্চলে রোজ রাতে বোমাবাজি থেমে গেলে, পৃথিবী যখন একটু শান্ত আর অহিংস হবে, শুরু হবে আমাদের ইন্টারভিউ!
প্রতিবেদক: আমরা যে বাড়িটার পেছনের দিকের রোয়াকে বসে কথা বলছি, ’৪৭-এর ১৫ অগস্ট, আপনি দিল্লি না গিয়ে বেলেঘাটার এই বাড়িটাতেই তো অনশন করেছিলেন?
গাঁধীজি: শুধু অনশন নয় রে, মৌনও নিয়েছিলাম। আসলে ওটাই ছিল তখন আমার ডিফেন্স মেকানিজ্ম। নয়তো জওহরলাল, বল্লভভাইরা এসে ‘চলুন না, চলুন না’ বলে ঘ্যানঘ্যান করে কানের পোকা বার করে দিত! পা-ফা ছুঁয়ে ফালতু সব শপথ নিত, আর দিল্লি ফিরে তার সব ক’টাই ভুলে যেত। দেশের ও-রকম হাল— রোজ হিন্দুর হাতে মুসলমান, মুসলমানের হাতে হিন্দুর লাশ পড়ছে! তার মধ্যে ও-সব ন্যাকাপনা আমার আর পোষাচ্ছিল না!
প্রতি: কিন্তু আপনিও তো আপনার কথা রাখতে পারেননি। বলেছিলেন, আমার মৃতদেহের ওপর দিয়ে ভারত ভাগ হবে! কিন্তু ভারত তো দিব্যি ভাগ হয়ে গেল! দেশসুদ্ধ লোক মধ্যরাতের স্বাধীনতা সেলিব্রেট করল! আপনি বেলেঘাটার কোন গোসাঘরে খিল দিলেন, তাতে লোকের ভারী বয়েই গেল!
গাঁধীজি: হ্যাঁ, পারিনি। কিন্তু এটাও তো ঘটনা, ওই কাটাকাটি-ভাগাভাগি-রক্তারক্তির স্বাধীন ভারত আমাকেও সাড়ে পাঁচ মাসের বেশি বাঁচতে দেয়নি? স্বাধীনতাটা তো তা হলে প্রায় আমার লাশ পেরিয়ে এল, তাই না!
প্রতি: কিন্তু আপনি কি জানেন, আপনাকে খুন করার দায়ে যে সংগঠনটাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল, তাদেরই এক জন পোড়-খাওয়া মেম্বার, এ বছরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়ে যেতে পারেন, এবং ইতিহাসের পরিহাসে তিনিও আপনার মতোই গুজরাতেরই মানুষ?
গাঁধীজি: না জেনে উপায় আছে? ‘নমো নমো’ বলে গোটা দেশের মিডিয়া দিনরাত যে ভাবে সাষ্টাঙ্গে নমো করে চলেছে! তবে তাই বলে আর.এস.এস-এর নাম করে আমাকে উসকানি দিয়ে লাভ নেই। আমাকে যে লোকটা গুলি করেছিল তার হাতে পিস্তলটা সেই সংগঠন তুলে দিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু তাতে বুলেট ভরেছিল আমার দেশের লোকের খাঁটি, নির্জলা ঘেন্না। সেই ঘেন্নার খেত-খামার-ফ্যাক্টরি ছিল এ দেশের লাখ-লাখ হিন্দু-মুসলমানের অন্তরমহল। আর সেই অন্তরমহলের ওপর কখনওই স্বয়ংসেবকদের একচেটিয়া দখলদারি ছিল না। হিন্দুদের একটা বিরাট অংশ তখন মনে করেছিল মুসলমানদের ওপর বদলা নেওয়া উচিত। এরা শুধু হিন্দু মহাসভা বা আর.এস.এস-এই ছিল না। কংগ্রেসে ছিল। কংগ্রেস সোশালিস্ট পার্টিতেও ছিল। আর এই সব দলের বাইরেও থেকে গেছে আরও লাখ লাখ হিন্দু জনগণ, যারা তক্ষুনি তক্ষুনি বদলা চাইছিল, এবং তাদের মনে হচ্ছিল, এই বুড়ো-হাবড়া গাঁধীটাই যত নষ্টের গোড়া। ওর জন্যেই আশ মিটিয়ে মুসলমানদের ওপর বদলা নেওয়া যাচ্ছে না! ওদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে, সম্পত্তি লুঠ করে, মেয়েদের ইজ্জত কেড়ে, ঘেঁটি ধরে সীমান্ত পার করিয়ে দেওয়া যাচ্ছে না! তোদের এই কলকাতা শহরেই অনেকে বলেছে, মুসলমানরা যখন হিন্দু মারছিল, তখন গাঁধী কোথাও ছিলেন না, কিন্তু যেই হিন্দুরা পালটা মার দেওয়া শুরু করল, অমনি উনি অনশনে বসে গেলেন!
প্রতি: কিন্তু, কংগ্রেসের বাকি নেতারা যখন দিল্লিতে বসে ক্ষমতার ভাগ-বাঁটোয়ারায় ব্যস্ত তখন আপনি তো একা নোয়াখালির দাঙ্গা-বিধ্বস্ত গ্রামে গ্রামে ছুটে বেড়িয়েছেন। দুর্গত মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আর এই দুর্গতরা তো ছিলেন পূর্ববঙ্গীয় হিন্দু! তার পরেও আপনার সম্পর্কে মুসলিম-তোষণের অভিযোগ ওঠে কী করে?
গাঁধীজি: আমি তো আসলে কাউকেই বাঁচাতে পারিনি। নোয়াখালির হিন্দুদের নয়, দিল্লির মুসলমানদেরও নয়, লাহোরের শিখদেরও নয়। তুই ঠিকই বলেছিস। আমি দাঙ্গা থামাতে পারিনি। দেশভাগ ঠেকাতে পারিনি। আর রাজনীতিতে সাফল্যটাই শেষ কথা। তুমি কোন আড়ালে বসে ঘরপোড়া লোকের হাহাকার, ধর্ষিতা মেয়ের স্তব্ধ মুখ, তলোয়ারে ফালাফালা বা গুলিতে ঝাঁঝরা লাশগুলোর জন্য একা একা নীরবতা পালন করলে, তাতে কী এসে গেল? ১৯৮৪-তে দিল্লির শিখ-নিধনের দু’মাসের মধ্যে কংগ্রেস সংসদে ‘ব্রুট মেজরিটি’ নিয়ে ফেরত আসে! ২০০২-এ গুজরাতে মুসলিম গণহত্যার রক্ত মাড়িয়ে নরেন্দ্র মোদী ড্যাংডেঙিয়ে ভোটে জিতে যায়! এটাই সাফল্য। রাজনীতি সব সময় অ্যাচিভারদের মনে রাখে— হেরোদের নয়! তাই মোহনদাস. কে. গাঁধী নামে বাতিল-হেরো লোকটা কংগ্রেসের ভেতরেই রোজ রোজ একলা হয়ে যায়! আমি কেন জিন্নার পাকিস্তানকে তার পাওনা ৬৭ কোটি টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য ফালতু জেদাজেদি করছি, কংগ্রেসের নেতারাই তাই নিয়ে কত কথা বলেছে! সেখানে আমাকে মুসলমানের দালাল বলবে তাতে আর আশ্চর্য কী!
প্রতি: আপনি কি এ জন্যেই কংগ্রেস পার্টিটা ভেঙে দিতে চেয়েছিলেন? মোদী কিন্তু আপনার সেই কথা ধরেই স্লোগান তুলেছেন— আসুন গাঁধীজীর স্বপ্ন পূরণ করি— এ বারের ভোটে কংগ্রেসকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিই! এ সব দেখে আপনার হাসি পায় না?
গাঁধীজি: এই ৬৫ বছরে তো কম রগড় দেখলাম না! তেমন হলে তো তোদের ‘টুনটুনির বই’য়ের মজন্তালী সরকারের মতো হাসতে হাসতে কবে পেট ফেটে আর এক বার মরে যাওয়ার কথা। আমি যে কারণে কংগ্রেস ভেঙে দিতে চেয়েছিলাম, সেটা নরেন্দ্র মোদীর হজম হওয়ার কথা নয়। স্বাধীনতার আগের ১০ বছরেই বিভিন্ন প্রদেশে শাসক দল হিসেবে কংগ্রেসের যে চেহারাটা আমি দেখেছিলাম, তাতে আমার মনে হয়েছিল এরা যখন দিল্লিতে একচ্ছত্র ক্ষমতা পাবে, তখন প্রতিষ্ঠানের সব অসুখবিসুখগুলোই ওদের গিলে নেবে। কংগ্রেস নয়, আমি আসলে এই প্রতিষ্ঠানটাকেই ভাঙার কথা বলেছিলাম। যে লোকটা উঠতে বসতে নিজেকে ‘রাষ্ট্রবাদী হিন্দু’ বলে ৫৬ ইঞ্চি ছাতি ঠোকে— রাক্ষুসে একটা কেন্দ্রের মুঠোয় দেশের সব ক্ষমতা পুরতে চায়, এই ভাঙার হিসেব তার পোষাবে না। কারণ এরা তো ভাঙা বলতে শুধু কংগ্রেস ভাঙিয়ে বিজেপির দল ভারী করা বোঝে— কিংবা উলটোটা!
প্রতি: কিন্তু আপনার কথামত কংগ্রেসের নেতারা সত্যি যদি দলটা তুলে দিতেন, তা হলে ভারতে গণতন্ত্র টিকত? হয় মিলিটারি, নয় হিন্দু মৌলবাদীরা ক্ষমতা দখল করে নিত না? ঘরের পাশে পাকিস্তান বা মায়ানমারের হাল দেখছেন না?
গাঁধীজি: আমি লোকটা তো কোনও কালেই প্র্যাগমাটিক রাজনীতি বুঝি না! তোদের বলিউডও তো বলেছে গাঁধীবাদ আসলে মগজের মধ্যে কেমিকাল গোলমাল। তবু এটা আমি বিশ্বাস করি, লোকের যদি সত্যের জোর থাকে, তা হলে দেশটা তারা ঠিক চালিয়ে নিতে পারবে। সে জন্য ১৩০ বছরের পার্টি বা লোহার ভীম, থুড়ি লৌহপুরুষ-মার্কা জবরদস্ত নেতার দরকার পড়ে না!
প্রতি: ধুর, আপনি তো সেই রামরাজ্যর ইউটোপিয়াতেই পড়ে আছেন। রামরাজ্যের জি.ডি.পি কত?
গাঁধীজি: জানি না। তবে সেখানে রেকর্ড বিকাশ-এর বড় বড় হোর্ডিংয়ের আড়ালে রোজ আধপেটা থেকে ঘুমোতে যাওয়া বাচ্চাদের করুণ মুখগুলো লুকোতে হত না। গাঁয়ের মেয়েদের রোজ ৩০ কিলোমিটার যাতায়াত করে খাওয়ার জল আনতে হত না! আর খুব যে গণতন্ত্র কপচাচ্ছিস; এই ২০১৪ সালেও তো তোপ দেগে দাঙ্গা করেই ভোট বাড়াতে হয়। ভোটের বাক্সে বদলা নেওয়া, হিন্দু-মুসলমানের মেরুকরণের স্লোগান দিতে হয়! ফুঃ!
sanajkol@gmail.com
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy