Advertisement
০২ মে ২০২৪
জা স্ট যা চ্ছি

যেতে পারি তো চলেই যাব

কিছু দিন আগেই বরফ পড়ল কলকাতায়। আমি নিজে দেখিনি। কিন্তু কাগজে বেরল ছোট করে। কয়েক জনের মুখেও শুনলাম। ময়দানের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে বড় ঝুপসি গাছ আছে একটা, অনেক সময় ঘোড়া বাঁধা থাকে সেখানে। ওই জায়গাটা পরিষ্কার ছিল, কিন্তু চার পাশের অনেকখানি জায়গা জুড়ে ঘাসের ওপর পাতলা সাদা বরফের আস্তরণ দেখা গিয়েছিল।

ছবি: শুভময় মিত্র

ছবি: শুভময় মিত্র

শুভময় মিত্র
শেষ আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০৫
Share: Save:

কিছু দিন আগেই বরফ পড়ল কলকাতায়। আমি নিজে দেখিনি। কিন্তু কাগজে বেরল ছোট করে। কয়েক জনের মুখেও শুনলাম। ময়দানের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে বড় ঝুপসি গাছ আছে একটা, অনেক সময় ঘোড়া বাঁধা থাকে সেখানে। ওই জায়গাটা পরিষ্কার ছিল, কিন্তু চার পাশের অনেকখানি জায়গা জুড়ে ঘাসের ওপর পাতলা সাদা বরফের আস্তরণ দেখা গিয়েছিল। রোদ ওঠার পর গলে যাওয়ায় তার আর কোনও চিহ্ন ছিল না। ভোরে যাঁরা ওখানে যান, তাঁদেরই চোখে পড়েছিল ব্যাপারটা। তাঁরাই একে ওকে বলেন, খবরটা ছড়িয়ে পড়ে। আমারও কানে আসে। তবে এটা নিয়ে তেমন হইচই হল না। রুপোর পাত পড়লে কথা ছিল, বরফ নিয়ে কারুরই মাথা ব্যথা নেই।

চায়ের দোকানে রোজই পলিটিক্স নিয়ে আজেবাজে তর্ক হয়, আমি কিছু বলি না, শুধু শুনি। আমি কোনও খবর রাখি না, রেখে লাভ নেই। আজ দেখলাম অন্য ব্যাপার নিয়ে কথা হচ্ছে। ‘বাইরের লোক ঢুকে পড়ছে’ কথাটা কানে এল। এক সময় নাকি কলকাতার খুব রমরমা ছিল। তখন অন্য রাজ্য থেকে অনেক লোক আসত নানা কারণে। অনেকেই থেকে গেছে। মিশেও গেছে। কিন্তু অনেকগুলো বিস্ফোরণ, জঙ্গি হানার ঘটনার পর ব্যাপারটা নিয়ে অনেকেরই মাথাব্যথা হয়েছে। সেই সব কথাই হচ্ছিল। আমি ফস করে একটা প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম, ‘বাইরে মানে? কতটা বাইরে?’ সবাই তাকাল। কেউ কিছু বলল না।

মাঝে মধ্যে আমি কাজ পাই। বাকি সময়টা ঘুরে বেড়াই এ দিক ও দিক। এর ওর কথা শুনি। নর্দার্ন পার্কের পাঁচিলের ধারে দুটো বুড়ো, যেন খুবই গোপনীয়, এমন ভঙ্গিতে কথা বলছিল চাপা স্বরে। যখন তাদের কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালাম তত ক্ষণে ওদের চা শেষ হয়ে গেছে। শেষ হয়ে যাওয়া সিগারেট পা দিয়ে ঘষে নিভিয়ে দিয়েছে। আমি এসে পড়ায় কথাবার্তাও গুটিয়ে নিল তাড়াতাড়ি। তবে শেষ যেটুকু কানে এল, তাতে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। এটা সত্যি হলে একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হয়।

দুপুরের পর থেকেই নন্দন চত্বরে লোকজন আসে রোজ। আড্ডাগুলো বাঁক নিয়ে শেষ হয় অ্যাকাডেমির গেটে গিয়ে। ওখানে কাউকে কাউকে দেখে চেনা লাগে। কিন্তু চেনার কথা নয়। মুশকিল হয় সত্যিকারের চেনা লোককে নিয়ে। হুড়মুড় করে আচমকা এসে পড়ে এরা। তার পর ‘তুমি এখানে কী করছ?’ বলে হনহন করে চলে যায় উত্তরের অপেক্ষা না করে। খারাপ লাগে।

‘আজ তো ভিক্টোরিয়ায় মাল নামছে, ক্রেজি ইয়ার, ছবি তুলতে হবে, তোর তো ভাল ফোন, কত মেগাপিক্সেল রে?’— কানে এল। দাঁড়িয়ে পড়লাম। অল্পবয়সিদের একটা দল, কলেজে পড়া হতে পারে। ‘টাইম বলেনি, কিন্তু আগে যাওয়া ভাল।’ উঠে পড়ল সবাই, এগোল, আমিও ওদের পিছনে। একটু দূরত্ব রেখে। সকালে দুই বুড়ো যা বলছিল তা এদের কথার সঙ্গে মিলছে। নেহাতই কাকতালীয় ভাবে দুটোই কানে এসেছে আমার, দুটোকে না মিলিয়ে পারছি না। ছেলেগুলোর পিছনে দাঁড়িয়ে আমিও টিকিট কেটে সাদা সিংহদের পেরিয়ে ঢুকে পড়লাম ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের বাগানে। নুড়ি-পাথরে শব্দ করে হাঁটছে সবাই। সামনে মহারানির মূর্তি, তার পিছনে ভিক্টোরিয়ার ডোম, মাথায় পরি। দেখেই চমকে উঠলাম। পরির মুখ এই মুহূর্তে একেবারে সামনের দিকে, এমন দেখিনি কোনও দিন!

অনেক ধরনের লোক জটলা করে রয়েছে। দেহাতিরা এসেছে দল বেঁধে। কাপ্ল’রা সরে যাচ্ছে ঘাসের দিকে, গাছের তলায়, জলের দিকে। সায়েব মেমও আছে, হাতে গাইড বই, মন দিয়ে মিলিয়ে নিচ্ছে সব কিছু। প্রায় সকলেই ছবি তুলছে নিজেদের। সবার মোবাইলেই এখন ক্যামেরা থাকে। এ সব দেখতে দেখতে আমি যাদের পিছনে হাঁটছিলাম তাদের হারিয়ে ফেললাম। চার পাশে তাকালাম। ওরা মিশে গেছে ভিড়ের মধ্যে। আর একটা ব্যাপার, বহু লোক আজ চলেছে মূল বাড়িটার দিকে, ভেতরে দারুণ সংগ্রহশালা আছে। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার নানা রকম ব্যাপার-স্যাপার। এ বার নজর পড়ল গলায় আই.ডি কার্ড লাগানো কয়েক জন হোমরাচোমরা লোকের দিকে। ভারতীয় বলে মনে হল না। প্রত্যেকের মাথা কামানো। আর আই.ডি কার্ডে লেখা— নাসা। খুব সাবধানে এগোলাম তাদের দিকে। উত্তেজিত হয়ে কথাবার্তা বলছে নিজেদের মধ্যে। ইংরিজি ঠিকই, কিন্তু অন্য রকম টান। তবুও কান খাড়া করে শোনবার চেষ্টা করলাম।

এরা কিন্তু ক’দিন আগে ময়দানে বরফ পড়া নিয়েই কথা বলছে। আর এটাও বলছে যে ওগুলো বরফ ছিল না। ও সব নাকি সালফার জাতীয় কেমিকাল। কার্বনও আছে। টেস্ট রিপোর্ট যে কোনও সময় আসবে। উত্তেজনা চাপতে না পেরে আমি এক জনকে বলেই ফেললাম, ‘আজ কিছু হবে?’ আমাকে পাত্তা না দেওয়াটাই স্বাভাবিক, কিন্তু তা হল না। চোখ কপালে তুলে আমাকে বলল, ‘হতেও পারে, না-ও হতে পারে, কখন কী ঘটে যায় কিচ্ছু বলা যায় না।’ বলে হাসল। আমিও হাসলাম। একটা উত্তেজনা টের পেলাম নিজের মধ্যে। ভেবে, যে, যা ভাবছি তা সত্যি হতেও পারে। সত্যি হলে, এত মানুষ কেন দলে দলে এসেছে, এগিয়ে চলেছে বিশাল মার্বেলের বাড়িটার দিকে, সেটা আন্দাজ করে নেওয়া যায়।

এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় মানুষ তো আসেই। আবার যারা এসেছে বা আসেনি, আছে বহু দিন ধরে, তাদের থেকে যাওয়ার প্রয়োজনটাও কমে যেতে পারে। তখন তাদের চলে যেতে হয় অন্য কোনওখানে। সবাই নিজেরা যেতে পারে না, কেউ হয়তো হাত বাড়িয়ে দেয়। তাদের হাত ধরেই এরা চলে যায় নিশ্চিন্তে। আমিও যেতে চাই।

সন্ধে হয়ে এল। কেউ কেউ ফিরে যাচ্ছে। এখনও আসছে অনেকে। মন দিয়ে, ভাল করে দেখলাম এদের। বেশির ভাগ লোকেরই মুখে কোনও অভিব্যক্তি নেই। ভাবখানা হল, যেতে পারি তো, চলেই যাব। একেবারে আমার মনের কথা। পকেট থেকে ফোন বের করলাম। যত নাম-নম্বর, মেসেজ রয়েছে, সবই তো অন্য মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগের স্মৃৃতি। আর বোধহয় এ সবের দরকার হবে না। মুছে দেব? মুখ তুলে দেখি, আশেপাশে প্রায় সবাই তাদের ফোন বের করেছে, কী সব যেন দেখছে। এরাও কি সবাই একই কথা ভাবছে? সবাই কেমন যেন স্লো মোশনে, কারুর কোনও তাড়াই নেই। আলো জ্বলে উঠল আমার স্ক্রিনে, মেসেজ এসেছে, ‘সিলেকটেড’। এগোলাম সিঁড়ির দিকে। আরও অনেকেই এগোচ্ছে, আমারই মতো। সেই আই.ডি কার্ড ঝোলানো এক জনকে দেখতে পেলাম, হাতের ইশারায় সে ডাকল আমাকে। সে বুঝতে পেরেছে, আমি মেসেজ পেয়েছি।

সিঁড়ি দিয়ে উঠে বড় হলঘরে দাঁড়ালাম। মাঝখানে মূর্তি। তার চার পাশে আমার মতো আরও বেশ কিছু লোক। আলো জ্বলছে। সবাই তাকাচ্ছে ওপরের ডোম’টার দিকে। এক সময় সবাই চুপচাপ হয়ে গেল। অর্গ্যান বাজতে শুরু করল, খুবই কম ভল্যুমে, চেনা ক্লাসিকাল পিস, নাম মনে নেই। জোয়ার উঠল ভায়োলিনে। এক সময় থেমে গেল, চার পাশ একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে এল। শব্দ নয়, মৃদু কাঁপুনি টের পেলাম ঠান্ডা মেঝেতে। তাকালাম ওপরে। খুলে যাচ্ছে, আস্তে আস্তে উঠে যাচ্ছে সাদা ডোমটা। কালো আকাশ দেখা যাচ্ছে। সেখান থেকে নেমে আসছে সাদা পাউডারের মতো ধুলো। ধুলোয় চন্দনের গন্ধ।

suvolama@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

rabibasariya anandabazar subhamoy maitra
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE