ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
রিতঙ্কর তখন ক্লাস ফাইভে পড়ে। নতুন স্কুল, অনেক বই, নতুন নতুন টিচার, অনেক বন্ধু। সব মিলিয়ে রিতঙ্করের বেশ ভাল লাগে স্কুলে যেতে। তার ডাকনাম রিকি। সবাই এই নামেই ডাকে।
রিকি যখন আরও ছোট ছিল তখন থেকে তার অনেক কিছু গুছিয়ে রাখার শখ। কোনও ভাঙা কলম সে ফেলত না। নিজের ভাবনায় প্লাস্টিক কৌটো কেটে সে তৈরি করেছে কলমদানি। তাতে জমা পড়েছে পনেরোখানা কলম। আর আছে একটা কাঠের ছোট্ট আলমারি। সামনের দিকে কাচ লাগানো। বাইরে থেকে সব দেখা যায়। তাতেই সে জমিয়ে রেখেছে পুরনো বই-খাতা, জামা-প্যান্টের কয়েকটা, ছোট বোনের ফেলে দেওয়া মাথার ক্লিপ, রঙিন ফিতে, খেলনা-পুতুল, বাবার পুরনো ডায়েরি, তার নিজের লেখা ডায়েরিও। এখন তার আলমারি যেন জিনিসের পাহাড়। বাবা এক বার বলেছিল, ‘তোর আলমারি তো ছোট একটা সংগ্রহশালা হয়ে উঠেছে।’ সেই থেকে সে আলমারির উপরে একটা কাগজ চিপকে দিয়েছে, তাতে লেখা ‘রিকির সংগ্রহশালা’। মা বলেছে, ‘মন্দ নয়।’
এই ঘরটা রিকির পড়ার জন্যে। বোন অনেকটাই ছোট। যাতে রিকির পড়ার না অসুবিধে হয় তার জন্যে এ রকম ব্যবস্থা। রিকিরও পছন্দ খুব নিরিবিলি একটা ঘর। তবেই না মন দিয়ে সে পড়বে, আঁকবে, মাঝে মধ্যে ছড়া-কবিতাও লিখবে। সে একা একা পড়ে আর ভাবনার জানলাগুলো অবাধ খুলে দেয়। অন্য জগতে চলে যায়। যেখানে শুধুই ছোটরা মনের ভাবনাগুলোকে সাজায়।
অনেক সময় পুতুলগুলোকে রিকি প্রশ্ন করে, ‘তোমরা ভাল আছ তো?’ পুতুলগুলোর কারও হাত ভাঙা, কারও পা নেই। কেউ চোখ বোজাতে পারে না, কারও জামা নেই। তারা যেন কেঁদে বলে, ‘আমরা সুখে নেই। এই চেহারা নিয়ে কি কেউ সুখে থাকতে পারে?’
রিকি সব বুঝতে পারে। ওরা কোনও কিছু হারিয়ে এখানে ঢুকেছে। ভাল থাকলে কেউ তাকে ওগুলো দেবে না। খারাপ খারাপ জিনিসগুলোই তার সঞ্চয়ের বস্তু। তাই বলে, ‘দুঃখ কোরো না। বড় হয়ে তোমাদের জন্যে নতুন জামা, কারও হাত-পা এনে সাজিয়ে দেব। দেখবে তোমরাও কেমন জীবন্ত হয়ে উঠেছ।’ শুনে পুতুলগুলো যেন নড়েচড়ে ওঠে।
সে দিন বাবা এনে দিয়েছে একটা বড় সাইজের পুতুলবাঘ। নরম তুলোর মতো শরীরের ভিতর থেকে জ্বলজ্বলে চোখ দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। অনেকটা ছবিতে দেখা সুন্দরবনের বাঘের মতো। সোনালি রঙের উপর কালো ডোরাকাটা। সেই বড় আকারের বাঘকে আলমারির মধ্যিখানে বসিয়ে দিয়েছে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে বাঘটা বুঝি সত্যি বসে আছে লেজ গুটিয়ে।
রিকি সে দিন থেকে তার যত্ন নিতে আরম্ভ করল। গায়ের লোমগুলো চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে মোলায়েম করে দেয়। ডোরাকাটা দাগগুলো আরও বেশি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তার পরিচর্যায়।
টেবিলের যে দিকে বসে রিকি পড়ে ঠিক তার উল্টো দিকে রাখা আছে তার সংগ্রহশালা। একেবারে মুখোমুখি। কেননা, রিকি সেই সব সংগ্রহ দেখতে দেখতে পড়ে আর খুশিতে মন ভরে ওঠে। রিঙ্কুম্যাডাম পড়াতে এলেও বসে আলমারির সামনের চেয়ারে। সংগ্রহশালাকে চোখের আড়াল করতে চায় না!
ক্লাসের বন্ধুরা অনেকে দেখতে আসে রিকির সংগ্রহশালা। বেশ মজা পায়। এমনকী অনেকে ও রকম সংগ্রহে মনও দিয়েছে।
অনেকগুলো দিন পেরিয়েছে। রিকি ভাবে গল্পের বাঘেরা এ দিক ও দিক করতে পারে, কিন্তু এরা তো নড়তেই পারে না। এক জায়গায় যেমনটি রাখা আছে, তেমনটাই রয়ে যাবে জীবনভর। একটু নড়াচড়া করতে পারলে এরাও হয়তো কত কী মনের কথা বলতে পারত। বইতে পড়েছে ওদের নাকি অনেক দুঃখ। বনে বাঘের সংখ্যা কমে আসছে। খাবার মিলছে না সময়মত। তাই তো যখন-তখন লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে বাঘেরা। তার পর যা হয়। মানুষের মার খেয়ে কেউ কেউ মরছে, নয়তো আবারও সেই না খেতে পাওয়া বনে ফেরত যেতে হচ্ছে। তা হলে কী হবে এদের ভবিষ্যৎ?
সে দিন বেশ রাত করে পড়ছিল রিকি। সামনে পরীক্ষা। মা বলেছে, ‘রাতে পড়লে অসুবিধে নেই। তবে বারোটা পর্যন্ত। তার পর শুতে আসতে হবে।’ কিন্তু রিকির ভাবনারা যে ডালপালা মেলে দেয় বিস্তর। পড়াশোনার সময় বাঁচিয়ে সংগ্রহশালার প্রতি নজর দিতে দিতে অনেকটা সময় পেরিয়ে যায়। একটু যেন ঘুম ঘুম পেয়েছিল রিকির। টেবিলে মাথা রেখেছে, অমনি পুতুলবাঘটা মানুষের গলায় বলে উঠল, ‘তোমার ঘুম পেয়েছে বুঝি!’
রিকির ঘুমছুট চোখ গেল বাঘটার উপর। যেন নড়েচড়েও উঠল। কিন্তু কী ভাবে সম্ভব! সত্যি সে দেখল এবং শুনলও। বাঘটা আবার বলে উঠল, ‘আজ থাক। এ বার ঘুমোতে যাও। সকাল সকাল উঠে পড়লেও পড়া মনে থাকে।’
বাঘের এমন কথা শুনে অবাক হয়ে গেল রিকি। ও মানুষের মনের কথাও বুঝতে পারে? কথা বলতে পারে! এমন অদ্ভুত কাণ্ড এর আগে তো কেউ দেখেছে বা শুনেছে বলে মনে হয় না। এক বার ভাবল, দৌড়ে বাবাকে ডেকে নিয়ে আসবে। কিন্তু, তখন যদি না কথা বলে এ রকম ভাবে। তাই রিকি ভাবল, ‘থাক। পরে না হয় বাবাকে জানাব, বিশ্বাস করুক আর না করুক। আমার কানকে-চোখকে তো আর অবিশ্বাস করতে পারব না।’
এ বার বাঘ অনেকটা উঁচু হয়ে উঠল। যেন সে একাই সেই সংগ্রহশালার উত্তরাধিকারী। মাথা তুলে বলল, ‘তোমরা ভাব, আমরা কেন পুতুল হয়ে গেলাম। দিনের পর দিন না খেতে পেয়ে রোগাপটকা হতে হতে এক দিন সত্যি সত্যি মানুষের হাতের পুতুল হয়ে গেলাম। তোমাদের আলমারির শোভা বৃদ্ধি করতে লাগলাম। বিশ্বাস করো, আমরা সত্যিকারের বাঘ। এ রকম ছোট হতে হতে তোমাদের আলমারির ভিতর বা মাথায় জায়গা করে নিতে হচ্ছে। এ বড় দুঃখের, বড় অভিমানের।’
রিকি শুনছিল বাঘের কথাগুলো। যে দিন থেকে বাঘ ঢুকল তার আলমারির সংগ্রহশালায় তার পরেই সে সংগ্রহ করে ফেলেছিল একটা বাঘের বই। বাঘেদের জীবনযাত্রার হদিশ আছে তাতে। সে জেনেছে, বাঘেরা নিরামিষভোজী প্রাণী খেয়ে জীবনধারণ করে। ছোট হোক বড় হোক জীবজন্তুই তাদের আহার। কিন্তু বনে জীবজন্তুর পরিমাণ ভীষণ রকম ভাবে কমে যাচ্ছে। ফলে বাঘেদের খাবারে পড়ছে টান। তাই তারা লোকালয়ে ঢুকছে নদী পেরিয়ে। আর মানুষের হাতে গণধোলাই খেয়ে আবারও ফিরে যাচ্ছে বনে। অনাহার যেন তাদের নিত্য সঙ্গী। কী ভাবে বাঁচবে তারা?
বাঘটা আবার বলে উঠল, ‘তুমি যা ভাবছ ঠিক তাই। খাবার তো মিলছেই না, তার উপর নদীর ভাঙন, গাছ কেটে নিয়ে জঙ্গল ছোট করে দেওয়া। সব মিলিয়ে আমাদের জীবন দুর্বিষহ। এর বিহিত তো মানুষকেই করতে হবে। কেননা, পৃথিবীতে তারাই তো সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিমান।’
খুব সঙ্গত কথাগুলো। ঘড়ির কাঁটা বারোর ঘরে। এ বার মায়ের ডাক পড়বে। কিন্তু বাঘের গলায় তাদের দুঃখ শুনতে মন চাইছে যে। পুতুলবাঘ বলতে লাগল, ‘২০০৪ সালে বাঘসুমারিতে সুন্দরবনে ছিলাম ৩৮৫টি। আমারা রয়েল বেঙ্গল টাইগার। মানুষ তাদের আত্মরক্ষার তাগিদে, আস্ফালনের গরিমায় মেরে ফেলছে। আমরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়ছি।’
রিকি পড়েছে বাঘেরা লম্বায় প্রায় ১১ ফুট হয় আর ওজন প্রায় ৩০০ কিলোগ্রাম। এদের অনেক খাবার লাগে। কিন্তু এরা কমে গেলে সুন্দরবনের সুনাম হারাবে। আগে মানুষেরা বাঘ পুষত। বিখ্যাত বক্সার মাইক টাইসন বাড়িতে বাঘ পুষেছিলেন।
বাঘ বলল, ‘বাঘ হল শৌর্যের প্রতীক। আজাদ-হিন্দ ফৌজের পতাকায় বাঘের ছবি থাকত। টিপু সুলতানের পতাকায় লেখা থাকত ‘বাঘই ভগবান’। স্যর আশুতোষকেও মানুষ চিনত ‘বাংলার বাঘ’ হিসেবে। মনসুর আলি খান পটৌদিকে ডাকা হত ‘টাইগার’ বলে, টিপু সুলতানকে ‘শের-ই মহীশূর’।’
রিকি দেখতে পেল পুতুলবাঘের চোখে জল। তারও চোখ চিকচিকিয়ে উঠল। সত্যিই যদি সে বাঘের দুঃখ না দূর করতে পারে, তা হলে তার এই সংগ্রহশালার সব কিছু মিথ্যে হয়ে যাবে। সে দিন থেকেই সে স্বপ্ন দেখতে শুরু করল, বড় হয়ে সে এক জন পরিবেশবিদ হয়ে উঠবে। সে বাঘেদের বাঁচাবে। আইন করে বাঘ সংরক্ষণ করতে বাধ্য করবে সরকারকে। এমনকী শুধু ভারতেই নয়, সারা পৃথিবীতে সেই আইনকে কার্যকর করাতে হবে। সে প্রতীজ্ঞা করল, বাঘেদের আর মানুষের হাতে বানানো পুতুল করে রাখবে না। ভাবতে ভাবতে শুনতে পেল মায়ের ডাক।
বড় হয়ে রিতঙ্কর দত্তরায় এক জন স্বনামধন্য পরিবেশ বিজ্ঞানী হয়ে উঠেছিলেন। তাঁরই আন্দোলনের ফলে কি না জানি না, সরকার বাধ্য হল শুধু বাঘ নয় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করতে। আইন হল সার্কাসেও বাঘ-সিংহ রাখা যাবে না। ১৯৭২ সালে চালু হল বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন। তৈরি হল ব্যাঘ্রপ্রকল্প। ২০০৭ সালে ৩১,৭৬১ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে ৪০টি ব্যাঘ্র প্রকল্পের সূচনা হয়েছে সারা পৃথিবীতে। এখন বাঘের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে।
রিকির সংগ্রহশালা এখন আছে কি না জানি না, তবে সে দিনই সে স্বপ্নে দেখেছিল, আলমারির ভিতর থেকে পুতুল হয়ে যাওয়া সত্যি বাঘ আবার বনে ফিরে গিয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy