Advertisement
০৬ মে ২০২৪
আনন্দ মেলা

লুসি

পুটুর কোনও নিজের বোন নেই। বাবার পিসতুতো দিদির মেয়ে সুমি তার একমাত্র দিদি। ভাইফোঁটার দিন সুমিদিদি ফোঁটা দেওয়ার আগেই আম্মা পুটুকে ফোঁটা দেয়। এ বার ভাইফোঁটার উপহারে আম্মা তাকে দিয়েছে লোমওয়ালা একটা বড়সড় সাদা কুকুর। পুটু অবাক হয়ে দেখেছে, কুকুরটা একেবারে লুসির মতো দেখতে। লুসিকে আম্মা, দাদু কেউ চেনে না।

মন্দার মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০১৪ ০৮:৩০
Share: Save:

পুটুর কোনও নিজের বোন নেই। বাবার পিসতুতো দিদির মেয়ে সুমি তার একমাত্র দিদি। ভাইফোঁটার দিন সুমিদিদি ফোঁটা দেওয়ার আগেই আম্মা পুটুকে ফোঁটা দেয়। এ বার ভাইফোঁটার উপহারে আম্মা তাকে দিয়েছে লোমওয়ালা একটা বড়সড় সাদা কুকুর। পুটু অবাক হয়ে দেখেছে, কুকুরটা একেবারে লুসির মতো দেখতে। লুসিকে আম্মা, দাদু কেউ চেনে না।

পুটুর দিদুনের পাশের ফ্ল্যাটে কেয়াদিদুদের বাড়িতে লুসি থাকত। লিফ্ট থেকে নেমে পুটু দিদুন-বাড়ি ঢোকার আগে কেয়াদিদুদের বাড়ি ডোর-বেল দিত। লুসি ঘরের ভেতর থেকেই বুঝতে পারত যে, কে এসেছে। আনন্দে ডেকে উঠত, ‘খোউ-খোউ’। পুটু ভয়ে মাম্মামের কোল থেকে নামত না। কেয়াদিদু দরজা খুলেই বলত, লুসি লুসি এই দেখো তোমার ছোট্ট বন্ধু এসে গিয়েছে। পুটু গোল গোল চোখে তাকিয়ে থাকত, আর লুসি ডেকেই যেত। দিদুনের বাড়ি পুটুর একটা মাত্র পুতুল কুকুর আছে। কালো আর বাদামি রঙের। চকচকে চোখ। ঝোলা ঝোলা কান। গ্যাঁট হয়ে বসে থাকার ভঙ্গি। হঠাৎ দেখলে সকলে সত্যি বলে ভাবে। দিদুন ওর নাম দিয়েছে ভুলু। লুসিও ভয় পায় ভুলুকে। লুসির ডাকাডাকিতে দিদুন যখন দরজা খোলে, পুটু এসে গিয়েছে বুঝতে পেরে, দরজার সামনে বসানো ভুলুকে দেখেই লুসি পালায়। দিদুন তখন ঝপাং করে পুটুকে কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকে আসে। রাস্তার কুকুরগুলোর ডাক শুনে পুটু নকল করে ডাকে, ‘ঘৌ ঘৌ’, ‘ভৌ ভৌ’। আর লুসি কেমন করে ডাকে, জিজ্ঞেস করলেই পুটু বলে, ‘খোউ খোউ’। পুটুও বুঝতে পারে যে লুসি খুব নরমসরম, সাদা, তুলতুলে একটা কুকুর যে পুটুকে চেনে। ভালবাসে। লাফিয়ে লাফিয়ে খেলতে চায়।

পুুটু যে দিন আসে না, সে দিন দিদুনের মন খারাপ হয়। কেয়াদিদুর মন খারাপ হয়। মন খারাপ হয় লুসিরও। দরজা খুললেই লুসি এসে দাঁড়ায়, কিন্তু ‘খোউ খোউ’ করে ডাকেও না, আনন্দেও লাফায় না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। মাঝে মাঝে দিদুনের ফ্ল্যাটে এসে পুটুকে খুঁজতে শুরু করে।

দিদুনের বাইরের ঘরে মাদুরে বসে ভুলুকে নিয়ে খেলে পুটু। দিদুনের পুরনো চশমাটা এক বার নিজে পরে, আর এক বার চশমাটা খুলে ভুলুকে জিজ্ঞেস করে ‘পরবি? পরবি?’ তাক থেকে দু’চারটে বই নিয়ে বলে, ‘ভুলু বই পড়ো’। কখনও ভুলুর পিঠে চেপে বসে বলে ‘ভুলু, চলো। লুসির বাড়ি চলো।’ দিদুনের কপাল থেকে টিপ তুলে নিয়ে ভুলুর কপালে পরিয়ে বলবে, ‘ভুলু টুপ পরেছে, রেড টুপ’। ভুলুকে গলা জড়িয়ে আদর করে বলবে, ‘ভৌ ভৌ-ঘৌ ঘৌ’। এক দিন পুটু রোজকার মতোই বিকেলে দিদুন-বাড়ি এসেছে, কিন্তু লুসির আওয়াজ শুনতে পায়নি। কেয়াদিদুর বাড়ি ডোর-বেল দিতেই শুনেছে, লুসির অসুখ। লুসি ছোটে না, লাফায় না, ডাকে না। সব সময় শুয়ে থাকে। সে দিন মাম্মাম পুটুকে কোলে নিয়ে লুসিকে দেখতে গিয়েছিল। কেয়াদিদুর খাটের পাশে একটা ঝুড়িতে শুয়ে আছে লুসি। পুটুর দিকে চুপ করে তাকিয়ে থাকল। পুটু কত ডাকল, ‘লুছি, লুছি’। তবু সে ল্যাজও নাড়ল না, খোউ খোউ করল না। একটু কুঁই কুঁই শব্দ করল শুধু। কেয়াদিদুকে কাঁদতে দেখে পুটুও ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল।

এর পর কয়েক দিন আর লুসিকে দেখেনি পুটু। মাম্মাম বারণ করেছে অসুস্থ লুসির কাছে যেতে। দিদুনও আর খবর নেয়নি কোনও। সে দিন বিকেলে পুটুকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার সময় কেয়াদিদুর ছেলে ঝুলনমামাকে জিজ্ঞেস করে দিদুন জেনেছে, লুসি আর বেঁচে নেই। মাত্র দু’দিন আগেই মারা গিয়েছে। পুটু কিন্তু বুঝতে পারল না। দিদুন গম্ভীর হয়ে গেল। মাম্মাম ফিসফিস করে দিদুনকে বলল, পুটুকে কিছু বোলো না।

পর দিন লিফ্টে উঠেই পুটু বলল, ‘লুছি। লুছিকে ডাকো।’ দিদুন ভুল করে বলে ফেলেছে, না বাবা, লুসি নেই। মরে গিয়েছে। পুটু কিছু বুঝল কি না, কে জানে! একটু পরে মাম্মাম আর বাবি পুটুকে দিদুন-বাড়ি থেকে নিতে এলেই পুটু বলে উঠল, ‘লুছি নেই, মলে গেছে’। মাম্মাম কটকট করে দিদুনের দিকে তাকাল। দিদুন মুখ নিচু করে বলল, মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছে। পুটু কি আর অতশত বুঝবে? সেই থেকে যখনই পুটু দিদুন-বাড়ি আসে, লিফ্টের থেকে নেমেই বলে, ‘লুছি নেই, মলে গেছে’। ভুলুকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘লুছি নেই, মলে গেছে’। কেয়াদিদু মাঝে মাঝে পুটু আসার আওয়াজ পেলে দরজা খুলে দাঁড়ায়। হাত নেড়ে বলে, ‘লুসি নেই না, পুটু?’ পুটু কেয়াদিদুর পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। বুঝতে পারে লুসি নেই। দিদুন বাড়ির থেকে ফেরার সময় ‘লুসি’র আস্তানার দিকে তাকায়। ল্যান্ডিংয়ের কাছে এসে পুটু গম্ভীর হয়ে যায়। হাসে না।

সে দিন লিফ্ট থেকে নেমেই পুটু বলল, ‘লুসি টুইঙ্কল স্টাল।’ দিদুন বুঝল, পুটুর মাম্মাম এ ভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছে পুটুকে। মাম্মাম নিজেও বাড়ির সবাইকে বলে দিল, লুসির সম্পর্কে এ ভাবেই পুটুকে বলতে, কারণ ‘মলে গেছে’ ব্যাপারটা পুটু না বুঝতে পারলেও, কষ্ট পাচ্ছে। কিছু একটা অসুবিধে ঘটছে ওর মনে। পুটু নাকি মাঝে মাঝেই বলছে যে লুসি কোত্থাও নেই। এ বাড়িতে এলেই ওর বেশি করে লুসির কথা মনে পড়ছে। আর পুটুকে দেখেও দিদুন আর কেয়াদিদুরও লুসির কথা বেশি বেশি মনে পড়ছে। মনে পড়ছে তার সাদা চেহারাটা, নিঃশব্দে ঘুরে বেড়ানো, মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে বসে কুট কুট করে তাকানো আর আদুরে ডাক খোউ খোউ খোউ।

পুটুর জন্মদিনে দিদুন এ বার বেশ কয়েকটা রংবেরঙের ছবি এঁকে দিয়েছে পুটুকে। যা ভালবাসে, সে সবের ছবি। পুটুর দোলনা, পুটুর সিংহ, হাতি, সাদা আর হলুদ ফুল, বিকেলে বেড়ানোর মাঝারি পার্ক। তবে পুটুর সবচেয়ে পছন্দ হয়েছে, সাদা রং দিয়ে আঁকা লুসি। ছবিটা খুব একটা ভাল না হলেও পুটু ঠিক চিনতে পেরেছে। বার বার ছবিটাতে চুমু খেয়ে, আদর করে বলছে, লুছি খোউ খোউ। দিদুন পুটুকে শিখিয়েছে এল ফর লায়ন, এল ফর লুসি। পুটু এখন এল ফর লায়ন বলেই বলে, ‘এল ফল লুছি খোউ খোউ টুঙ্কিল স্টাল’। কিন্তু ভাইফোঁটায় আম্মার দেওয়া উপহারটা পেয়ে পুটু গম্ভীর হয়ে গেল। পুতুল কুকুরের গায়ে হাত বুলিয়ে আম্মা বলল, ডগিকে কোলে নাও আদর করো। পুটু উৎসাহ দেখায় না।

দিদুন সে দিন পুটুর বাড়ি গিয়ে ব্যাপারটা আন্দাজ করে ফেলেছে। বুঝতেই পেরেছে যে পুতুল কুকুরটা অত সুন্দর, তবু কেন পুটু কাছে যাচ্ছে না। সত্যিই তো একে লুসির মতোই দেখতে। কিন্তু পুটু তো কোনও দিন লুসিকে ছুঁয়ে আদর করেনি। মাম্মার কোলে চড়ে, নীচের দিকে তাকিয়ে পুটু দেখত কেয়াদিদুদের দরজায় লুসি দাঁড়িয়ে আছে পুটুর দিকে তাকিয়ে, আর সমানে খোউ খোউ করে যাচ্ছে। লুসির এসে দাঁড়ানোয় পুটু ভেতরে ভেতরে আনন্দ পেলেও, একটু একটু ভয়ও পেত। তবে, পুটু বড় হওয়ার সময় মানুষ ছাড়া আর যার সঙ্গে তার প্রায় প্রতিদিনের আদানপ্রদান, ভয়-ভালবাসা হয়েছিল সে লুসি। সাদা, তুলতুলে, নরম পুতুল লুসিকে কোলে নিয়ে দিদুন বলল, পুটু এসো, ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দাও। কথা বলো। পুটু প্রথমেই ছুটে পালিয়ে গেল। কিছুক্ষণ বাদে দেওয়ালের পাশ থেকে উঁকি মেরে দেখে, এক পা এক পা করে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিল। ভয়ে ভয়ে মাথাটা ছুঁয়েই হাত সরিয়ে নিল। দিদুন বলল, তুমি ভুলুর সঙ্গে যেমন কথা বলো, ওর সঙ্গেও গল্প করো। পুটু ভয় কাটিয়ে দিদুনের কোলের কাছে এসে লুসিকে আদর করে, আস্তে আস্তে বলল, ‘কিলে? কিলে?’ দিদুন বলল, ওর নাম জিজ্ঞেস করো। ও কিছু খাবে কি না জেনে নাও। তোমার সঙ্গে বেড়াতে যেতে চায় কি? পুটু আদুরে গলা করে একটা হাত এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘নাও নাও, মাংস ভাত, এই নাও খাও।’ আবার ছুটে পালিয়ে গেল। কোথা থেকে একটা লাঠি এনে বলল, ‘মালব কিন্তু’। বলল, ‘আমি পুটু, তোল নাম কী?’ কুকুরটার পায়ে আটকে থাকা কোম্পানির স্টিকারটা নেড়েচেড়ে দিদুনকে জিজ্ঞেস করল পুটু, ‘এটা কী বলো তো?’ দিদুন বলল, ‘এটাতে ওর নাম লেখা আছে।’

পর দিনও দিদুন পুটুদের বাড়ি গিয়ে লুসিকে নিয়ে বসল। পুটুকে বলল, এই দেখো, লুসি ফিরে এসেছে। তারা হয়ে যায়নি। তোমাকে খেলতে ডাকছে। পুতুলটাকে নিয়ে লুসির ভয় কেটে গেছে। মাঝে মাঝে ভুলুর মতো জড়িয়ে ধরে আদরও করে। কিন্তু, পুটু পরিষ্কার করে দিদুনকে বলে দিল, ‘ও লুছি নয়। ও তো ডাকে না, খোউ খোউ’। সে দিন দিদুন-বাড়ির থেকে খেলা সেরে ফেরার পথে কেয়াদিদুদের দরজা দেখিয়ে বলল, ‘লুছি নেই, লুছি নেই’। দিদুন বলল, কেন ও তো এখন তোমাদের বাড়ি থাকে। পুটু বলল, ‘ওটা অন্য লুছি খোউ খোউ লুছি-টুঙ্কিল স্টাল নেই।’ দিদুনের কাঁধে মাথা রেখে বিষণ্ণ পুটু বলল, ‘লুছি ডাকো, লুছি ডাকো খোউ খোউ খোউ।’ সাদা রঙের যে পুতুল লুসি, গাড়ির পিছনে চুপ করে বসে আছে, সে পুটুকে চেনেও না আর পুটুকে দেখে চেঁচাও না খোউ খোউ খোউ।’ এটা সত্যিই তো অন্য লুসি। একেবারে অন্য।

ছবি: সুমিত্র বসাক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

rabibasariya illustration
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE