Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ৩

সু ম না মি

কবীর সুমনছেলেবেলায় মোহনবাগানের সাপোর্টার ছিলাম। আমার হিরো ছিলেন চুনী গোস্বামী। সে সময়ে আমার নাম ছিল সুমন চ্যাটার্জি (ইংরিজি করে বললে)। সংক্ষেপে এস চ্যাটার্জি। উফ, মোহনবাগানের গোলকিপার ছিলেন এস চ্যাটার্জি। শুনেছিলাম তিনি লাল রঙের জার্সি পরেন। অত অল্প বয়সে তো আর মাঠে যাওয়ার জো ছিল না, খবরের কাগজের ছবি ছিল সাদা-কালো। ফলে রংবেরং সম্পর্কে কানে যা আসত বিশ্বাস করতাম।

ছবি: সুমন চৌধুরী।

ছবি: সুমন চৌধুরী।

শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০১৪ ০০:১৫
Share: Save:

ছেলেবেলায় মোহনবাগানের সাপোর্টার ছিলাম। আমার হিরো ছিলেন চুনী গোস্বামী। সে সময়ে আমার নাম ছিল সুমন চ্যাটার্জি (ইংরিজি করে বললে)। সংক্ষেপে এস চ্যাটার্জি। উফ, মোহনবাগানের গোলকিপার ছিলেন এস চ্যাটার্জি। শুনেছিলাম তিনি লাল রঙের জার্সি পরেন। অত অল্প বয়সে তো আর মাঠে যাওয়ার জো ছিল না, খবরের কাগজের ছবি ছিল সাদা-কালো। ফলে রংবেরং সম্পর্কে কানে যা আসত বিশ্বাস করতাম।

১৯৫৮ সালে (আমার তখন ন’বছর) আকাশবাণী কলকাতার শিশুমহলে প্রথম গান গেয়ে (রবীন্দ্রনাথের ‘বাদল-ধারা হল সারা’) পারিশ্রমিক বাবদ পাঁচ টাকা পেয়েছিলাম। বাবা নিয়ে গিয়েছিলেন আমায়। ফেরার পথে ট্রাম থেকে কালীঘাটে নামলাম। সেখানে বীণাপাণি স্টোর্স নামে একটি খেলার সরঞ্জামের দোকান ছিল। বাবাকে সেখানে নিয়ে গিয়ে আমার মাপের লাল রঙের গোলকিপার-জার্সি কিনেছিলাম। দাম পড়েছিল পনেরো টাকা। আমার রোজগার করা পাঁচ, বাবার পকেট থেকে দশ। সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে বাঁচতে চাওয়ার পালা বোধহয় সেখানেই শুরু। সে সময়ে ৭৮ আরপিএম গ্রামোফোন রেকর্ডের দাম ছিল সাড়ে চার টাকা মতো। এখন ভাবলে অদ্ভুত লাগে— গানের লোক, গান গেয়ে জীবনের প্রথম রোজগার, সেই টাকায় গানের রেকর্ড না কিনে জার্সি কিনলাম! আমার প্রিয় শিল্পী সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের কোনও রেকর্ড নয়, আমার হিরো-দল মোহনবাগানের গোলকিপার এস চ্যাটার্জি যে রঙের জার্সি পরেন বলে শুনতাম, সেই রঙের জার্সি কিনে বাড়ি ফেরা।

বাপ-জ্যাঠার গড় আয়ু যদি আমার নিয়তি হয় তো এখন থেকে আমার ঠিক পনেরো বছর বাকি। মামাদের গড় আয়ুর হিসেবে, ওরে বাবা, দশ-বারো বছর। মানে, হয়ে এল প্রায়। এই সময়ে, দেখছি, মন চলে যাচ্ছে খালি ছেলেবেলার দিকে। ফুটবলের হিরো চুনী গোস্বামী। হিরো-দল মোহনবাগান। ক্রিকেটের হিরো আব্বাস আলি বেগ, পলি উমরিগড়, সায়েবদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার নিল হার্ভে। আহা। মানুষ হিসেবে হিরো সুভাষচন্দ্র। তাঁর মতো কটকে জন্মেছি বলে একটা আলাদা গর্বও ছিল। গায়ক-গায়িকাদের মধ্যে হিরো?

সতীনাথের গান ছিল পছন্দ। কিন্তু সব গান নয়। তবু, আমার কট্টর হেমন্তপন্থী বড় ভাই-এর সঙ্গে ঝগড়া করার সময়ে আমি বেজায় সতীনাথবাদী। মোহনবাগান, চুনী, আব্বাস, উমরিগড় আর হার্ভে যে রকম থাক-প্রাণ-যাক-প্রাণ ছিলেন, গানে কিন্তু সেই অর্থে কেউ ছিলেন না। যে গান ভাল লাগছে, সেই গানে আছি, গায়ক যিনিই হোন না কেন। আজ, আয়ুর কোটা বেশ খানিকটা শেষ করে এনে, ভাবতে বসে আবিষ্কার করছি— এক জন হিরো অবশ্যই ছিলেন আমার, আমার দাদারও, যাঁর কথা হিরো হিসেবে ভাবিনি, কিন্তু মনের ভেতরে ছিল তাঁর কণ্ঠ ও গায়কির অনন্য অবদান।

অনেক প্রিয় গানের শিল্পীই ছেলেবেলা থেকে যৌবন পর্যন্ত কখনও না কখনও নিরাশ করেছেন, মোটেও ভাল লাগছে না এমন একখানা গান গেয়ে। অথবা, একটি বিশেষ গানে তাঁর গায়কি পছন্দ হয়নি। কিন্তু যাঁর কথা বলতে চাইছি, গান যেমনই হোক, গায়কিতে তিনি সতত স্মার্ট। দাদাঠাকুর যেমন সাধারণ একটি ধুতি আর চাদর গায়ে সুপার-স্মার্ট, ইনিও তেমনি। ‘কাজল নদীর জলে’র মতো (বাঙালি মধ্যবিত্তদের মধ্যে অনেকে আমায় ঠ্যাঙাতে চাইবেন) সেন্টিমেন্টাল, দুখী-দুখী, বেচারা-বেচারা, আঁখিজল-ভরিয়া-সম্বলিত গানেও গায়কিতে তিনি— কলকাতার রাস্তায় নিজের পত্রিকা ‘বিদূষক’ নিজে হাতে বিক্রি করা দাদাঠাকুর, শরৎ পণ্ডিত: স্মার্ট। আর এক স্মার্ট মানুষ, সুভাষচন্দ্র, এক বার দাদাঠাকুরকে ওই অবস্থায় দেখতে পেয়ে গাড়ি থেকে নেমে সেই প্রবীণের হাত থেকে ‘বিদূষক’এর পাঁজা কেড়ে নিয়ে নিজে বিক্রি করেছিলেন। লড়াই আর সভ্যতার ব্যাটন এক কালে এই শহরেই এই ভাবে প্রবীণের হাত থেকে নবীনের হাতে যেত। হায় রে, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের খোলামেলা ও প্রত্যক্ষ স্বরপ্রক্ষেপ, ঝকঝকে উচ্চারণ, আর স্মার্ট গায়কির ব্যাটন নেবার মতো কেউ আর এলেন না।

চল্লিশের দশকে যিনি লাহৌর বেতারে সংগীতের দায়িত্ব ছিলেন এবং যাঁর অধীনে কাজ করে নৌশাদ আলির মতো যুগন্ধর সুরকার এক সাক্ষাৎকারে ‘দ্য মিউজিকাল জিনিয়াস’ বলে যাঁর নাম উল্লেখ করেছিলেন, সেই অনুপম ঘটকের সুরে পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘পাখি বলে কারে দেব এ-গান ভাবি তাই’ গানটি রেকর্ড করেছিলেন— আকাশবাণীর রম্যগীতিতে। ভৈরবী রাগে গানটির স্থায়ী, কিন্তু তার পরেই খরজ পরিবর্তন করে (ভাবা যায়? সেই যুগে, সলিল চৌধুরীরও আগে) গানের সুরটি আর রাগানুগত্য করছে না। সম্পূর্ণ অন্য স্বরবিন্যাস, যেখানে ভৈরবীর নামগন্ধও নেই। অথচ সুরের এই রং পালটানো সত্ত্বেও কোথাও কোনও ধাক্কা নেই। তার কারণ কিন্তু শুধু সুরকারের জাদু না, গায়কেরও দক্ষতা। অন্তরার শুরুতে ‘হাওয়া বলে’-তে হাওয়ার ওপর তারসপ্তকের শুদ্ধ মধ্যম ও শুদ্ধ গান্ধার, এই স্বর দুটিকে নিয়ে যে সূক্ষ্ম খেলাটি আছে, আজকের দিনে কেউ ওই জিনিসটি করে দেখাতে পারবেন কি না সন্দেহ। আমার কথা তো ছেড়েই দিন। আমি কিছুই পারিনি, পারিও না।

ছ’মাত্রার ‘ধা-ধিনা-না-তিনা’ নয়, ওয়াল্ৎস-এর (Waltz) চলনে অনুপম ঘটকের ওই সুর হিমাংশু দত্তর গানের মতো আদর্শ আর্ট সং। জানি না ইউ টিউব-এ আছে কিনা। না থাকলে কী করে শোনাই বলুন তো আপনাদের?

কাঠামোর দিক দিয়ে ভাবতে গেলে অন্তত তিনটি পৃথক পর্বে বিভক্ত, অথচ সাবলীল ভাবে জোড়া লাগানো গোটা গানটি একটি সম্পূর্ণ কম্পোজিশন। এই রচনা সামলাতে গেলে গায়ককে অন্তত আড়াই সপ্তকে অনায়াসে খেলানোর মতো তৈরি গলা থাকতে হবে। ছোট-মাঝারি কাজ স্বচ্ছন্দে, সূক্ষ্মতা বজায় রেখে করে ফেলার ক্ষমতা রাখতে হবে— অর্থাৎ, রীতিমত সংগীত শিখতে ও চর্চা করতেই হবে। এ ছাড়াও মেধা থাকা দরকার কণ্ঠশিল্পীর। সার্বিক ভাবে শিক্ষিত হতে হবে তাঁকে। গায়নশৈলী, দক্ষতা, মেধা, কল্পনা ও সার্বিক শিক্ষা— এতগুলি গুণ না থাকলে অনুপম ঘটকের সুর সামলানো অসম্ভব। গানটি, গানের আশ্চর্য যন্ত্রানুুষঙ্গ যেমন স্মার্ট, ঠিক তেমনই স্মার্ট তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গায়কি। এ গান শুনে ছেলেবেলাতেই এই গায়ককে একটা আলাদা স্থান দিয়েছিলাম, কিন্তু তখনও বুঝিনি ইনিই আমার গানের হিরো।

কাব্যে উপেক্ষিত এই দুর্দান্ত কণ্ঠশিল্পীকে নিয়ে আমি সামনের সুমনামি’তেও লিখব। বিস্মৃত কবি নরেশ গুহ-র ‘শান্তিনিকেতনে ছুটি’ কবিতায় পড়েছিলাম— ‘দেরি হোক, যায়নি সময়।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kabir suman
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE