Advertisement
০৪ মে ২০২৪

সারপ্রাইজ

তিন্নির আর তর সইছিল না। বাবা তার জন্যে কী সারপ্রাইজ এনেছেন বোঝা যাচ্ছে না। গিফ্ট প্যাকের ভিতরে বস্তুটা কী হতে পারে? তিন্নির বাবা প্রতিমবাবু বললেন, ‘উঁহু, না, এখন নয়। প্যাকটা এখনই খোলা যাবে না। ওতে তোমার জন্যে একটা সারপ্রাইজ আছে। অফিস থেকে ফিরেছি। আগে আমি ফ্রেশ হয়ে নিই। চা-জলখাবার খেয়ে গুছিয়ে বসি। তার পর।’ বছরে দু’বার বাবার কাছ থেকে গিফ্ট পায় তিন্নি। নিজের জন্মদিনে, আর ক্লাসে ভাল রেজাল্ট করার জন্য।

ছবি: সুমন চৌধুরী

ছবি: সুমন চৌধুরী

প্রদীপ আচার্য
শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০১৪ ০১:০৮
Share: Save:

তিন্নির আর তর সইছিল না। বাবা তার জন্যে কী সারপ্রাইজ এনেছেন বোঝা যাচ্ছে না। গিফ্ট প্যাকের ভিতরে বস্তুটা কী হতে পারে?

তিন্নির বাবা প্রতিমবাবু বললেন,

‘উঁহু, না, এখন নয়। প্যাকটা এখনই খোলা যাবে না। ওতে তোমার জন্যে একটা সারপ্রাইজ আছে। অফিস থেকে ফিরেছি। আগে আমি ফ্রেশ হয়ে নিই। চা-জলখাবার খেয়ে গুছিয়ে বসি। তার পর।’

বছরে দু’বার বাবার কাছ থেকে গিফ্ট পায় তিন্নি। নিজের জন্মদিনে, আর ক্লাসে ভাল রেজাল্ট করার জন্য। বাবা বলেন, ‘ভাল রেজাল্ট মানে ফার্স্ট-সেকেন্ড হওয়া নয়। ফার্স্ট-সেকেন্ড না হলে জীবন ব্যর্থ হয়ে যায় না। তবে টার্গেটটা সেরকমই রাখতে হয়। তার জন্যে লড়াই করতে হবে। রীতিমত যুদ্ধ।’

বাবা বলেন, ‘মনে ভয় নিয়ে কখনও যুদ্ধে জয় করা যায় না। বীরেরাই যুদ্ধে জয়ী হয়। ভিতুগুলোর আর যুদ্ধে জেতা হয় না। আগে মনের ভয়টাকে তাড়া করে পগার পার করতে হবে। তবে তো তুমি ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই।’

বাবার কাছে ঝাঁসির রানির গল্প শুনেছে তিন্নি। বাবার কথাগুলো বেশ মজার। বাবা বলেন, ‘ঝাঁসির রানি ব্রিটিশদের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন। রানির ঘোড়ার নাম ছিল ‘বাদল’। সেই বাদলের পিঠে চেপে তরোয়াল নিয়ে ব্রিটিশ শত্রুদের তাড়া করেছেন তিনি। আর তোর শত্রু হল, তোর অঙ্কের ভয়। হাতে পেন নিয়ে সেই শত্রুকে তুই তাড়া কর। রোজ কমপক্ষে তিনটে অনুশীলনী প্র্যাকটিস কর। দেখবি, তোর অঙ্কের ভীতি কেমন ল্যাজ গুটিয়ে পালায়। আরে ভয়ের মতো ভিতুর ডিম আর আছে নাকি? ভয় সবাইকে ভয় দেখায়। আসলে নিজেই একটা কেঁচো।’

তিন্নি দুপুরে স্কুল থেকে ফিরে টেলিফোনে বাবাকে সুখবরটা জানিয়েছে। বাবা বলেছেন, ‘দেখলি তো অঙ্কের ভয় কেটে যাওয়ার ফলটা কেমন হাতে নাতে ফলল? আমি জানতাম তুই এ বার তোর পরিশ্রমের ফল পাবি। যাকগে, বেশি আনন্দে নাচিস না। সামনে আরও বড় চ্যালেঞ্জ।’ তিন্নি বলল, ‘বাবা, আমার গিফ্ট?’

‘গিফ্ট নয়, তোকে এ বার আমি একটা প্রাইজ দেব।’

‘কী প্রাইজ বাবা, বলো না।’

‘সেটা সারপ্রাইজ। চমকের জন্য অপেক্ষা কর।’ বলেই বাবা ফোন কেটে দিয়েছেন। সেই থেকে ঘড়ির কাঁটা যেন আর ঘুরতেই চায় না। সবে ক্লাসের রেজাল্ট বেরিয়েছে। মা বলেছেন, ‘আজকের দিনটা নেচে গেয়ে কাটাও। কাল থেকে ক্লাস এইটের অঙ্ক নিয়ে বসবে। ব্যস, তিন্নিকে আর পায় কে? এক ছুট্টে বইয়ের আলমারি খুলে টেনিদা, ফেলুদাদের টেনে নামাল। কিন্তু, মন বসল না। বইয়ের পাতা থেকে টেনিদা যেন বার বার বলছে, ‘কনগ্র্যাচুলেশন তিন্নি, তুমি ফার্স্ট হয়েছ।’ ফেলুদা বলল, ‘তুমি খুব ভাল মেয়ে। আই লাইক ইউ।’

তিন্নি বলেছে, ‘ধ্যাত। মা বলেছে, ফার্স্ট হয়েছি বলে কি আমার দুটো ডানা গজিয়েছে নাকি?’ মুখটাকে একটু ভার করে, ঠোঁট দুটোকে ফুলিয়ে তিন্নি বলে, ‘জানো তো, মা বলেছেন, আজকের দিনটা নেচে গেয়ে কাটাও’ তিন্নির কথা শেষ হতে না হতেই টেনিদা আর ফেলুদা সমস্বরে বলে উঠল, ‘তিন্নি একটা নাচ করো না। আমরা দেখি।’ আসলে টেনিদা, ফেলুদা ও সব কিছু না। তিন্নিরই মনে মনে এখন একটু নাচতে ইচ্ছে করছিল। তাই গল্পের বইতেও আর মন বসছিল না। একটু নাচ করার ছুতো খুঁজছিল। অনুরোধেই যেন তাকে নাচতে হচ্ছে, এমনই একটা ভান করে তিন্নি নাচতে শুরু করল। ঝুমুরদি এ বারের রবীন্দ্রজয়ন্তীতে যে নাচটা শিখিয়েছিল, সেই ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে...’ তিন্নি সবে নাচটা শুরু করেছে, অমনি ডোরবেলটা বেজে উঠল, ডিং ডং ডিং ডং ডিং ডং।

ছুট্টে গিয়ে দরজা খুলে দিল তিন্নি। বাবা এত তাড়াতাড়ি এসে পড়বেন ভাবেনি সে। বাবার হাতের গিফ্ট প্যাকটা টেনে নিতে যাচ্ছিল তিন্নি। বাবা তখনই বললেন, ‘উঁহু, না। এখন নয়। আগে ফ্রেশ হয়ে গুছিয়ে বসি, তার পর।’ বাবার অবশ্য বেশি দেরি হল না। প্রতিমবাবু সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বসলেন। তিন্নি বসল বাবার মুখোমুখি। প্রতিমবাবু বললেন, ‘তিন্নি, তোর মনে আছে, আমাদের এই দক্ষিণপাড়ায় এক বার একটা হনুমান কেমন মা-মরা কুকুরছানাকে কোলে তুলে নিয়েছিল?’ তিন্নি বলল, হ্যাঁ, মনে আছে।

ওই তো বাবুকাকুদের বাড়ির পাঁচিলে কুকুরছানাটাকে কোলে নিয়ে বসে থাকত হনুমানটা।’

‘আর তোর নিশ্চয়ই এ কথাও মনে আছে যে, গল্পটা তুই তোর স্কুলের বন্ধুদের কাছে করেছিলি। কেউ বিশ্বাস করেনি। বাড়ি এসে তুই খুব কেঁদেছিলি, বন্ধুরা তোকে মিথ্যেবাদী বলে হাসাহাসি করেছিল বলে!’

‘হ্যাঁ, মনে আছে।’

‘মনে থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ, তোর মনে সে দিন একটা যন্ত্রণা হয়েছিল, বন্ধুদের তুই তোর কথাটাকে বিশ্বাস করাতে পারিসনি বলে। আজ থেকে বহু বছর আগে সেই একই যন্ত্রণা পেয়েছিলেন এক সাহেব শিকারি। উত্তরাখণ্ডের নৈনিতালেই থাকতেন সেই সাহেব। অনেক বাঘ ও চিতা মেরেছিলেন তিনি। সেই সাহেবের নাম জিম করবেট। তাঁর জীবনেও ঠিক তোর মতো একটা ঘটনা ঘটেছিল।’

বাবার কথা শুনে তিন্নি সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘আমার মতো!’

‘হ্যাঁ, তোর মতো। জিম করবেট এক দিন বাঘ মারতে জঙ্গলে গিয়েছেন। গভীর জঙ্গল। হঠাৎ তিনি দেখলেন, বেশ খানিকটা দূরে একটা পাথরের চাঁই চাতালের মতো পড়ে আছে। সেই পাথরের উপর এক হরিণী তার তিনটি শাবককে নিয়ে শুয়ে আছে। শাবকগুলো হরিণীর দুধ খাচ্ছে। আর মা হরিণী তাদের গা চেটে দিচ্ছে। আচমকা বাঘ এসে লাফিয়ে পড়ল সেখানে। হরিণী প্রাণের ভয়ে শাবকদের ফেলে রেখেই ছুটে পালাল। সাহেব বন্দুকে তাক করে থাকেন। বাঘ হরিণ শাবকগুলোর দিকে থাবা বাড়ালেই তিনি গুলি করবেন। কিন্তু মুহূর্তে সব ওলটপালট হয়ে গেল। ওটা বাঘ নয়, ছিল বাঘিনি। আর সেই বাঘিনি অবিকল সেই হরিণীর মতো শাবকগুলোর গা চেটে চেটে আদর করতে লাগল। সাহেব নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তিনি তখন দাঁড়িয়ে থর থর করে কাঁপছিলেন। ভাবছিলেন, তিনি কত বড় পাপ করতে যাচ্ছিলেন। পৃথিবীর এই আশ্চর্য মাকে তিনি গুলি করে মারতে যাচ্ছিলেন! পৃথিবীর সেই বিরলতম দৃশ্যের সাক্ষী একমাত্র ওই সাহেব একাই। সেই দৃশ্য দেখার রোমাঞ্চ যে কী, তা তিনি কাকে বোঝাবেন? কেমন করে বোঝাবেন? কাকে বিশ্বাস করাবেন? কে বিশ্বাস করবে? সে দিন যদি সাহেবের হাতে বন্দুকের বদলে ক্যামেরা থাকত, তা হলে তিনি পৃথিবীকে দেখাতে পারতেন হিংস্র বাঘিনির মধ্যেও কেমন লুকিয়ে থাকে মমতাময়ী এক মা। সেই আপশোসেই সাহেব সে দিন থেকে বন্দুক ফেলে হাতে তুলে নিলেন ক্যামেরা। সে দিন থেকে ক্যামেরা দিয়েই শিকার শুরু করেন জিম করবেট। পশুশিকারি হয়ে গেলেন পশুপ্রেমী। তোমার হাতেও সে দিন যদি ক্যামেরা থাকত, তা হলে তোমাকেও স্কুলের বন্ধুরা মিথ্যেবাদী বলে হাসাহাসি করত না।’

কথা শেষ করে প্রতিমবাবু তিন্নির হাতে একটা ক্যামেরা তুলে দিলেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

rabiamela anandamela pradip acharya
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE