Advertisement
০৫ মে ২০২৪

সুস্নাত চৌধুরী

জোড়া খুনের বিচার, তাতেও আবার জোচ্চুরি? কাঠগড়ায় উঠেও আইনের ফাঁক দিয়ে পগার পার সেলেব্রিটি? দেশটা কিনা আবার আমেরিকা! সে দিন দশ কোটি মানুষ কাজকম্ম শিকেয় তুলে টিভি, রেডিয়ো খুলে হাঁ করে বসেছিলেন। ফোন-কলের পরিমাণ অর্ধেক, শেয়ার কেনাবেচায় ধাক্কা, এমনকী দেশ জুড়ে জলের ব্যবহারও ভয়ংকর কমে গিয়েছিল। কারণ, বাথরুম যাওয়ার সময়টুকুও অপচয় করতে চায়নি মার্কিন জনগণ। মাত্র এক দিনেই আমেরিকার ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল আটচল্লিশ কোটি মার্কিন ডলার।

শেষ আপডেট: ২৩ মার্চ ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

জোড়া খুনের বিচার, তাতেও আবার জোচ্চুরি? কাঠগড়ায় উঠেও আইনের ফাঁক দিয়ে পগার পার সেলেব্রিটি? দেশটা কিনা আবার আমেরিকা! সে দিন দশ কোটি মানুষ কাজকম্ম শিকেয় তুলে টিভি, রেডিয়ো খুলে হাঁ করে বসেছিলেন। ফোন-কলের পরিমাণ অর্ধেক, শেয়ার কেনাবেচায় ধাক্কা, এমনকী দেশ জুড়ে জলের ব্যবহারও ভয়ংকর কমে গিয়েছিল। কারণ, বাথরুম যাওয়ার সময়টুকুও অপচয় করতে চায়নি মার্কিন জনগণ। মাত্র এক দিনেই আমেরিকার ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল আটচল্লিশ কোটি মার্কিন ডলার।

৩ অক্টোবর, ১৯৯৫। ক্যালিফোর্নিয়ার সুপিরিয়র কোর্টের বিচারকক্ষ থেকেই লাইভ টেলিকাস্ট চলছিল ‘ট্রায়াল অব দ্য সেঞ্চুরি’-র। খলনায়ক ছিলেন: ও জে সিম্পসন। এক কালের বিখ্যাত রাগবি খেলোয়াড়, আবার অভিনয়-জগতেও পরিচিত মুখ। অভিযোগ মারাত্মক নিজের প্রাক্তন স্ত্রী ও তাঁর বন্ধুকে হত্যা। নিকোল ব্রাউন ছিলেন সিম্পসনের দ্বিতীয় স্ত্রী। বিয়ের চার বছরের মাথাতেই সিম্পসনের বিরুদ্ধে বধূ-নির্যাতনের অভিযোগ আনেন নিকোল। তার তিন বছর পর, ১৯৯২ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়। কিন্তু সেই আইনি বিচ্ছেদ হয়তো মুছে দিতে পারেনি সম্পর্কের রেশটুকু। নইলে কি ১৯৯৪-এর ১২ জুন রাতে খুন হতে হত নিকোল ব্রাউন আর তাঁর ‘নিছক বন্ধু’ রোনাল্ড গোল্ডম্যানকে? সন্দেহভাজনের তালিকার প্রথম নামটাই ছিল সিম্পসনের। তাঁর বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে রক্তের চিহ্ন পায় পুলিশ। নিকোলের বাড়িতেও নাকি মেলে সিম্পসনের জুতোর ছাপ! ছিল এমনই আরও বহু ‘প্রমাণ’, যা প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ডও হতে পারত তাঁর। হয়নি। আদালতে সিম্পসন ঠান্ডা গলায় বলেছিলেন, ‘আমি একশো শতাংশ নির্দোষ।’ বেকসুর খালাস হয়ে যান তিনি।

সিম্পসন দোষী ছিলেন কি না, এই বিতর্কের চেয়েও এর পর বড় হয়ে দাঁড়াল অন্য এক কেচ্ছা আমেরিকার বর্ণবৈষম্য। সিম্পসন ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ। এই রায়ে আফ্রো-আমেরিকানরা তোফা তোফা করলেন! সাদা চামড়ার মার্কিনিরা তুলোধোনা করতে লাগলেন গোটা বিচারব্যবস্থারই। স্পষ্ট অভিযোগ বিচারকদের মধ্যে ন’জন কৃষ্ণাঙ্গ আর মোটে দুজন শ্বেতাঙ্গ থাকলে তো এমন রায় হবেই। সার্ভে করেও দেখা গেল, আমেরিকার শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে মাত্র তেরো শতাংশের মত এই রায় ঠিক। আবার উলটো দিকে, কালো চামড়া মার্কিনিদের মধ্যে মোটে এগারো শতাংশ মনে করে, সিম্পসনই আসলে খুনি। মওকা বুঝে এই ব্ল্যাক-অ্যান্ড-হোয়াইট বিতর্কে আর একটু রং লাগাল টাইম ম্যাগাজিন। ১৯৯৪-এর ২৭ জুন কভারে ছাপা হল সিম্পসনের ছবি মুখের কালচে ভাব বেশ কয়েক পোঁচ বাড়িয়ে! ফোটোশপের মহিমায় কেচ্ছা ছড়াল দিগ্বিদিক।

সিম্পসনের কেচ্ছাও সেখানেই থেমে থাকেনি। কোথাও সিম্পসনকে উদ্ধৃত করে ছাপা হল, ‘যদি আমি খুনটা করেও থাকি... এটা তো করতে হতই, কেননা আমি ওকে খুব ভালবাসতাম। তাই না?’ কেউ বললেন, সিম্পসন নাকি নেশায় টং হয়ে আড়ালে স্বীকার করেই নিয়েছেন খুনের ব্যাপারটা। এরই মাঝে ১৯৯৭ সাল নাগাদ নিকোল ও গোল্ডম্যানের পরিবার আবার মামলা ঠুকল সিম্পসনের বিরুদ্ধে। এ বার ক্ষতিপূরণের জন্য সান্টা মনিকার সিভিল কোর্টে। আর পার পেলেন না সিম্পসন। তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে, ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দিল আদালত।

কয়েক বছর যেতে না যেতেই, আবার হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগালেন তিনি। শোনা গেল, প্রকাশ পাচ্ছে তাঁর বই ‘ইফ আই ডিড ইট’। ফের বিতর্ক স্বীকারোক্তি, না কি দুটি হত্যা বেচে মাল কামানোর ধান্দা? আদালতের নির্দেশে তড়িঘড়ি থামানো হল প্রকাশনার কাজ। জানানো হল, সিম্পসন নয়, এ বইয়ের রয়্যালটির টাকা পাবে মৃতের পরিবার। কিছু যোগ-বিয়োগ চালিয়ে নতুন করে প্রকাশ পেল সেই বই। প্রচ্ছদে বড় হরফে লেখা ‘আই ডিড ইট: কনফেশন অব দ্য কিলার’। আর গ্রন্থনামের শুরুতে খুব ছোট্ট হরফে, চোখে না পড়ার মতোই লুকিয়ে রইল একটি ‘ইফ’।

এত কিছুর পরেও বদলালেন না সিম্পসন। শেষমেশ লাস ভেগাস-এ একটি দোকানে ভাঙচুর, চুরি ও অপহরণের অভিযোগ উঠল। ৩ অক্টোবর ২০০৭, তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করল আদালত। আশ্চর্য, ১৩ বছর আগে ঠিক এই দিনই জোড়া হত্যার অভিযোগ থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। এ বার আর হল না। এখনও নেভাডার সংশোধনাগারই অসুস্থ, বিধ্বস্ত সিম্পসনের ঠিকানা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE