১৯৭৫ সালের ২৬ জুন ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই অনেকেই প্রতিদিনের অভ্যাসে রেডিয়োর নবটি ঘুরিয়েছিলেন। আকাশবাণী কলকাতা। এই মন্ত্র উচ্চারণ শুনে তখন ঘুম ভাঙত। হঠাৎই সে দিন শোনা গেল, This is All India Radio. The Prime minister will now address the nation. তার পর জানা গেল সেই খবর: রাষ্ট্রপতি দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন, কিন্তু ভীত সন্ত্রস্ত হবেন না, বিরাট ষড়যন্ত্র রুখতে দেশে এ ব্যবস্থা করতে হয়েছে।
তখন আমি ছাত্র। ছোটকা বলল, ‘মাসের শেষ, এ মাসের মাইনে পাব তো?’ বাবা বললেন, ‘তুই তো সরকারি চাকরি করিস না, মাইনে কেন পাবি না!’ সরকারি চাকুরেরা বেতন পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু সেই সত্তরের দশক জরুরি অবস্থার নামে কী ছিনিয়ে নিয়েছিল, তা আজ আমরা সবাই জানি।
ঠিক ওই সময়েই আর একটি অলটাইম ব্লকব্লাস্টার ঘটনা ঘটল। জরুরি অবস্থা জারির ঠিক দেড় মাসের মধ্যেই। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগস্ট। মুক্তি পেল একটি বলিউডি ছবি। তখনও অবশ্য বলিউড নামটা সে ভাবে জন্মায়নি। ছবির নাম ‘শোলে’। প্রথম দু’সপ্তাহে ছবিটি চলেনি। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাস থেকে তুমুল বক্স অফিস সাফল্য। তিন কোটি টাকা অর্থ ব্যয় করে প্রথম পর্যায়েই ১৫ কোটি টাকা লাভ করে।
জরুরি অবস্থা এবং ‘শোলে’— এই দুই বিপরীতের ঐক্য রচনার চেষ্টা আজও কোনও সমাজতাত্ত্বিক করেছেন বলে জানা নেই। কিন্তু সরল ভাবে একটা কথা মনে হয়, ২৬ জুন যে আসমুদ্রহিমাচলব্যাপী ক্ষুব্ধ ব্যথিত ভারতীয় চিত্তে জরুরি অবস্থার দণ্ডনীতি কার্যকর করা হয়, সেই মানুষ, সেই দর্শক, সেই বাজার, সেই উপভোক্তাই তো শোলে-র বাণিজ্যিক সাফল্যের প্রধান কারণ।
সিনেমা ভার্চুয়াল রিয়েলিটি। বাস্তবে আমাদের অবদমিত বাসনা-অসন্তোষ-বিদ্রোহের-স্বপ্নপূরণের আদর্শ পীঠস্থান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গ্লানি ও হতাশার মধ্যে যেমন লন্ডনের স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে অবতীর্ণ হন জেমস বন্ড, ঠিক সে ভাবেই ভারতের তীব্র আর্থিক ও রাজনৈতিক সংকটে গব্বর সিং নামের এক ভয়াবহ জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে আম আদমি ঠাকুরকে ব্যবহার করে দুষ্টের দমন সম্ভব করেছিলেন। তা হলে সে দিন কি গব্বর সিং আসলে ছিলেন ইন্দিরা গাঁধীর স্বৈরতন্ত্রের প্রতীক? ঠাকুরও হয়তো সেই দর্শকদের চোখে আর নিছক জাতপাতের নেতা নন, সমগ্র হিন্দি বলয়ের গ্রামের নেতা। আর বীরু এবং জয় পরিত্রাতা। হতে পারে।
‘কিস্সা কুর্সি কা’ ছবির স্থিরচিত্র। ১৯৭৫ সালে অমৃতলাল নাহাতা নির্দেশিত এই ছবি নিষিদ্ধ হয়েছিল,
সঞ্জয় গাঁধী ও অন্য কয়েকজন কংগ্রেস নেতাকে ব্যঙ্গ করার ‘অপরাধে’।
জরুরি অবস্থা নিয়ে এক গ্রাফিক উপন্যাস বিশ্বজ্যোতি ঘোষের: ‘দিল্লি কাম’। সেখানে নায়ক বিভূতি প্রসাদ এক জন লেখক। তিনি বলছেন, জরুরি অবস্থার পর দিল্লি রাইটার্স সাসপেনডেড, কিন্তু সিচুয়েশন পিসফুল। সে সময় বাসে ট্রামেও মানুষ বেশি কথা বলত না। দেওয়ালেরও কান আছে!
সে সময় দিল্লি তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ত। নিবু-নিবু আলোয় মধ্যবিত্ত দিল্লিবাসী মহম্মদ রফির গান শুনত, সাদাকালো পুরনো ছবি দেখতে দেখতে হুইস্কি পান করত। জরুরি অবস্থায় অরাজনৈতিক সত্তা হয়ে উঠতে চাইছিলেন নাগরিক সমাজ। সংবাদপত্রের উপর খড়্গহস্ত প্রশাসন। প্রতি দিন সন্ধ্যায় সংবাদের তালিকা জমা দিতে হত সরকারি তথ্য অফিসারদের কাছে। কী খবর প্রকাশিত হবে, কী হবে না, ঠিক করে দিতেন সরকারি প্রভুগণ।
’৭৫ সালের ২৫ জুন মধ্যরাত্রে জরুরি অবস্থা জারি হয়। রাষ্ট্রপতিকে বিষয়টি নিয়ে কোনও আলাপ-আলোচনার সুযোগ দেওয়া হয়নি। সে দিন রাতেই বন্দি করা হয় সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিরোধী নেতাকে। সরকারি নির্দেশে বাহাদুর শাহ জাফর মার্গে দিল্লির প্রতিটি সংবাদপত্রের অফিসে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়, ফলে সে দিন অধিকাংশ খবরকাগজ প্রকাশ করাই সম্ভব হয়নি। ইন্দিরা গাঁধী ভুলে গিয়েছিলেন, দ্য স্টেটসম্যান আর হিন্দুস্তান টাইম্স-এর অফিস বাহাদুর শাহ জাফর মার্গে নয়, কনট প্লেসে। ফলে ওই দুটি কাগজ ছাপাখানায় চলে যায়। প্রথম পাতায় ছবি ছিল ‘বিরোধী নেতাদের গ্রেপ্তার’, কিন্তু প্রেস ইনফর্মেশন ব্যুরোর নির্দেশ জারি হয়, ছাপার আগে কাগজ দেখাতে হবে। একে বলা হত প্রি-সেন্সরশিপ। অনুমতি না মেলায় ছবি আর ছাপা হল না, প্রথম পাতায় সাদা কাগজ ছাপা হয় ছবি ছাড়া। ইন্দ্রকুমার গুজরাল তখন তথ্যমন্ত্রী, কিন্তু সংবাদপত্রের প্রতি তাঁর ‘দুর্বলতা’ দেখে সঞ্জয় গাঁধী তাঁকে সরিয়ে দেন, তথ্য ও প্রচারমন্ত্রী হন বিদ্যাচরণ শুক্ল।
সঞ্জয় গাঁধী অবশ্য জরুরি অবস্থায় নিজের ও সরকারের ভাবমূর্তি দ্রুত বদলাতেও সচেষ্ট হন। জনপ্রিয় হওয়ার চেষ্টায় কড়া প্রশাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তিনি রাতারাতি রাস্তা থেকে ভিখারিদের সরিয়ে দিলেন, ধর্মঘট প্রত্যাহার করতে বাধ্য করলেন, ধর্মঘট নিষিদ্ধ করে কর্মসংস্কৃতি ফেরাতে চাইলেন— তুর্কমান গেট-এ ’৭৬ সালের ১৩ এপ্রিল এক পুরনো বুলডোজার এসে ভেঙে দিল বিস্তীর্ণ বস্তি। দিল্লি ডেভেলপমেন্ট অথরিটি-র তহশিলদার কাশ্মীরিলাল খুব উদ্বিগ্ন। তিনি বলেছিলেন, যা করার ধাপে ধাপে করব, যাতে মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়া না হয়। কিন্তু তা কী করে হয়!
মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। প্রতিবাদের পরিচয় পাওয়া গেল ’৭৭ সালের ভোটের ফলাফলে। মানুষ অসন্তোষ অ্যাকাউন্টে জমা করে রাখে, সুযোগ মতো সুদে-আসলে ফেরত দেয়। অনেকে বলেন, বুদ্ধিমতী রাজনৈতিক নেত্রী হয়েও পুত্র সঞ্জয়ের এই অদূরদর্শিতাকে এতটা কেন প্রশ্রয় দিলেন ইন্দিরা? কেউ বলেন, অন্ধ স্নেহ।
সাংবাদিক বিনোদ মেটা বলেন, সঞ্জয় উচ্ছে খেতে ভালবাসতেন না, তবুও উচ্ছে রান্না করায় এক দিন শুধু ডাল দিয়ে রুটি খাচ্ছিলেন সঞ্জয়। তা দেখে মা ইন্দিরা রাঁধুনিকে এতটা বকেছিলেন, ভাবা যায় না। এমন স্নেহের দাস ছিলেন ইন্দিরা।
আমার মনে হয়, আসলে ইন্দিরার রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দুর্বল হচ্ছিল আর্থ-সামাজিক কারণে ও প্রশাসনিক ব্যর্থতায়। জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র কখন হিটলারের পথে হাঁটবেন তারও একটা বিজ্ঞান আছে— সেই ইতিহাস-বিজ্ঞানের পথে হেঁটেছিলেন ইন্দিরা। সে দিন তিনি বোঝেননি, একটি জরুরি অবস্থা ভারতের রাষ্ট্রকে অনেকটা দুর্বল করে দিল। গণতন্ত্রের শক্তিই রাষ্ট্রকে শক্তিশালী করে, ফ্যাসিবাদ নয়।
আবার অনেকে মনে করেন, গণতন্ত্রের দাম ঠিক মতো বোঝার জন্যে ওই একুশ মাসের অন্ধকারটা জরুরি ছিল আমাদের। তাঁদের মতটাকেই বা উড়িয়ে দিই কী করে?
সত্তরের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?
লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 70s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy