Advertisement
১৭ মে ২০২৪

হ্যালো 70’s

তখন দিনগুলো অন্য রকম। নকশাল আন্দোলন চলছে। আবার দেশে এসেছে হিপি কালচারও। হাসাহাসি, আবার রকের আড্ডায় সিরিয়াস আলোচনাও হচ্ছে ওদের নিয়ে। একটা ছবির আউটডোর শুটে কুলু-মানালি গেছি, ওখানে পাইকারি হারে গাঁজার চাষ হত। ও বাবা, যে দিকে তাকাই, শুধু হিপির দল। বুঝলাম, এরা বেশ ভালই ছড়িয়ে গেছে ভারতে। কলকাতার হিপিরা বেশির ভাগই সেন্ট্রাল ক্যালকাটাতে থাকত, কিড স্ট্রিটের ছোট হোটেলে। লম্বা উসকোখুসকো চুল, মুখভর্তি দাড়ি।

তপন সিংহ পরিচালিত ‘এখনই’ ছবিতে হিপির ভূমিকায় চিন্ময় রায়। কিছু একটা গভীর আঁতেল তত্ত্ব বোঝাচ্ছেন। ছবি: সুকুমার রায়

তপন সিংহ পরিচালিত ‘এখনই’ ছবিতে হিপির ভূমিকায় চিন্ময় রায়। কিছু একটা গভীর আঁতেল তত্ত্ব বোঝাচ্ছেন। ছবি: সুকুমার রায়

চিন্ময় রায়
শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৪ ০০:৩৪
Share: Save:

তখন দিনগুলো অন্য রকম। নকশাল আন্দোলন চলছে। আবার দেশে এসেছে হিপি কালচারও। হাসাহাসি, আবার রকের আড্ডায় সিরিয়াস আলোচনাও হচ্ছে ওদের নিয়ে। একটা ছবির আউটডোর শুটে কুলু-মানালি গেছি, ওখানে পাইকারি হারে গাঁজার চাষ হত। ও বাবা, যে দিকে তাকাই, শুধু হিপির দল। বুঝলাম, এরা বেশ ভালই ছড়িয়ে গেছে ভারতে। কলকাতার হিপিরা বেশির ভাগই সেন্ট্রাল ক্যালকাটাতে থাকত, কিড স্ট্রিটের ছোট হোটেলে। লম্বা উসকোখুসকো চুল, মুখভর্তি দাড়ি। ঠিক বোঝাও যেত না, ওরা কী চায়। কিছু টাকাপয়সা নিয়ে নিজের দেশ ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে, পৃথিবী দেখতে। আমার মনে হত যেন ওরা কোনও আশ্চর্য ধর্মীয় কাল্ট, ঘরের বন্ধন ছিন্ন করে বেরিয়ে পড়েছে। রেস্ত সামান্য হলেও কক্ষনও ভিক্ষে করত না। বৈভব থেকে, ভোগ-সমৃদ্ধি থেকে দূরে চলে যাওয়া, এটাই যেন ওদের ব্রত। দিব্যি খালি পায়ে হাঁটছে, ঘাসের ওপর হাত-পা মেলে বসছে। আক্ষরিক অর্থেই মাটির সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। ওই সময়ের পার্ক স্ট্রিট থেকে গঙ্গার ধার, যাদবপুর-নিউ আলিপুর থেকে ডায়মন্ড হারবার, সব জায়গাতেই দেখেছি হিপিদের। কথা কম বলত, জিজ্ঞেস করলে দু’একটা হয়তো। তবে মাঝেসাঝে রাস্তা জানতে চাইত।

ওরা ছিল বোহেমিয়ান পর্যটক-টাইপ। কলকাতাটা দেখা, ঘোরা হয়ে গেল তো চল দার্জিলিং, বা গঙ্গাসাগর। হেঁটে যতটা যাওয়া যায়, হাঁটত। তবে এই ভ্রমণ মানে ভারতীয় সংস্কৃতিকে জানতে-বুঝতে চাওয়া কি না তা বলতে পারব না। ওরা ঈশ্বরে বিশ্বাসী কি না, তা-ও ঠিক পরিষ্কার নয়। আমি তো অন্তত কখনও ওদের ক্যাথলিক ভঙ্গিমায় ক্রস করতে দেখিনি।

সেই সময়, তপন সিংহ একটা ছবি করলেন, ‘এখনই’। এ ছবিতে বিচিত্র এক হিপির চরিত্র পেলাম আমি। নামহীন মানুষ। আমার তো মনে হয় না এই ধরনের কোনও চরিত্র এর আগে কোনও বাংলা ছবিতে হয়েছে। চারপাশের ঘটমান বাস্তবের মধ্যেই বাসা করে নেওয়া ‘হিপি ফেনোমেনন’ কিন্তু মূল কাহিনিতে ছিল না। তপনদার নিজের দেখা, ওঁর নিজস্ব হিপি-ধারণা থেকেই স্ক্রিপ্টে এই চরিত্রটা তৈরি করেছিলেন। এক দল কলেজবন্ধু, সেখান থেকে কারও বিদেশ চলে যাওয়া, ভালবাসার মানুষকে প্রমিস করেও চলে যাওয়া, এগুলো ছিল ছবিতে। আমার করা হিপি-চরিত্রটা এই বিষয়বস্তুর মধ্যে একটা ওয়েলকাম রিলিফ। আবার শুধু কমেডিই নয়, একটা সিরিয়াস সুরও ছিল তার মধ্যে। আমার সংলাপ বাংলায়। তপনদা বললেন, বাংলা ঠিকই, কিন্তু এমন স্টাইলে বলো, যাতে একটা ছদ্ম-আঁতেল ভাব আসে। আমার এক বন্ধু ছিল, তুষার রায়। সে কিন্তু সত্যি সত্যি ইন্টেলেকচুয়াল। কবিতা লিখত দারুণ। ওর চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলার ভঙ্গিটা আমি নকল করে তপনদাকে শোনালাম। উনি শোনামাত্র বললেন, এটাই করো। ও রকম বাঙালি-কিন্তু-সাহেব ব্যাপারটাই থাকুক ভয়েসে। তা-ই করলাম। এমনিতেই তুষারকে নকল করতাম, ওর স্টাইলটা রপ্ত করতে আদৌ বেগ পেতে হয়নি।

একটা দৃশ্যে ক্রিকেট ম্যাচের রিলে চলছে, ব্যাটসম্যান একটা বিগ হিট নেওয়ার পর হিপি বলে ওঠে, ‘প্রায় ধ্যানচাঁদের মতোই মেরেছেন।’ ধ্যানচাঁদ স্বনামধন্য খেলোয়াড়, কিন্তু হকি-র। সেটা না জেনেবুঝেই আলটপকা বলে দেওয়া। সঙ্গে সঙ্গে পাশ থেকে এক চাঁটা। ‘মারলে কেন?’ স্বভাবোচিত নরম প্রতিবাদ। এমন মজা ছিল। আবার, বন্ধুদের কলমের জোরে হারিয়ে দেবে, এই সিরিয়াসনেসও ছিল। শম্ভু ভট্টাচার্য অভিনীত চরিত্রটা সব সময় ওকে চাপড় দিয়ে কথা বলে। হিপি যেহেতু গায়ের জোরে পেরে ওঠে না, তাই কল্পনা করে, একটা বড় কলম নিয়ে সে ওই তাগড়াকে তাড়া করেছে। পরিচালক দেখাতে চাইছেন, এই ছেলেটার মধ্যে কিছু গুণ আছে। কিন্তু দিগ্ভ্রষ্ট, বিভ্রান্ত।

আর একটা দৃশ্যে কর্ণ-কুন্তীর ওপর একটা স্ক্রিপ্ট লিখে হিপি এক হিপিনি-কে শোনাচ্ছে। ‘আকাশে একটা চিল উড়ে বেড়াচ্ছে, নীচে কর্ণ আর কুন্তী। কুন্তী জিজ্ঞেস করল, তুমি আমার সন্তান, না আমি তোমার সন্তান?’ হিপিনি বলল, ‘হোয়াট ডু ইউ মিন বাই দ্যাট?’ হিপির উত্তর, ‘ইটস ফ্রম গোদার, ইউ সি!’ মজা, আবার ব্যঙ্গও। ওপরচালাক ডিরেক্টর-স্ক্রিপ্টরাইটাররা যেমন ত্রুফো-গোদার-কুরোসাওয়া পেড়ে নিজেদের ছবির অর্থহীন সিনগুলো ঢাকেন, সে নিয়ে তপনদা একটা স্টেটমেন্ট দিলেন যেন। অন্যের অনুকরণ-অনুসরণ করতে গিয়ে আবোলতাবোল বোকো না।

একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। একটা দৃশ্যে হিপি একটা কবিতা লিখেছে, পড়ে শোনাচ্ছে হিপিনিকে। সে চরিত্রটা করেছিলেন ব্রিটিশ কাউন্সিলের কর্মী এক জন মহিলা। খাস লন্ডন থেকে আসা, চাকরি করছিলেন কলকাতায়। তো তপনদা বুঝিয়ে দিলেন, তুমি গড়ের মাঠে ওকে কবিতা শোনাতে শোনাতে হাঁটছ, আর কোনও দিকে খেয়াল থাকবে না, হিপিনিও মুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকবে। তুমি একটা সময় বলে উঠবে, ‘এক্সাইটমেন্ট!’ ওই মুহূর্তে মেয়েটির কাঁধে একটু হাত দিতে পারো। শট শুরু হল। আমি ‘আকাশ-বাতাস-ট্রামলাইন, ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ/ ও দিকে চলেছে মেট্রোয় সিনেমা/ হয়তো রবার্ট টেলর, বা উত্তমকুমার...’ আগডুম-বাগডুম বলতে বলতে যাচ্ছি, হঠাৎ দেখি এক পাল ভেড়া। তপনদা বলেছিলেন ‘কাট’ না শুনে শট চালিয়ে যেতে, তাই কবিতা বলতে বলতে আমি মেয়েটিকে একেবারে কাছে টেনে ঢুকে পড়লাম সেই ভেড়ার পালের মধ্যে। সমানে বলে যাচ্ছি, ‘এক্সাইটমেন্ট, এক্সাইটমেন্ট!’, আর হিপিনি বলছে, ‘হোয়াট আর য়ু ডুয়িং, মিস্টার রয়?’ আমার তো কোনও দিকে খেয়াল নেই। খানিক ক্ষণ পর হঠাৎ দেখি তপনদা, আমার কাঁধে হাত দিয়ে গম্ভীর ভাবে বলছেন, শট অনেক ক্ষণ হয়ে গেছে, মেয়েটিকে এ বার ছেড়ে দাও! খুব হাসাহাসি হল এ নিয়ে।

একটা জিনিসে কিন্তু হিপিদের বিশ্বাস ছিল। যুদ্ধবিরোধিতা। ছবির শেষে আমার চরিত্র সিদ্ধান্ত নেয়, অনেক পড়াশোনা হয়েছে, এ বার চলো হিমালয়। বন্ধুদের বলে, ‘ওঁ’ শব্দের আসল মানে জানো? হিরোশিমা-নাগাসাকিতে যে বোম পড়েছিল, ওঁ উচ্চারণ করলে সেই বোম আর পড়ত না। আমি হিমালয় যাচ্ছি, সেই ওঁ-এর খোঁজে, গুডবাই। হিপি-বন্ধুর চলে যাওয়ায় কিন্তু বাকি সবার মধ্যে একটা বেদনা, শূন্যতার জন্ম হয়েছিল। ছবির শেষ দৃশ্য সেটাই। ১৯৭২ সালে বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশন-এর ‘বেস্ট সাপোর্টিং অ্যাক্টর’-এর পুরস্কার পেয়েছিলাম এই হিপির জোরেই।

সত্তরের দশকের কোনও ঘটনার সঙ্গে নাড়ির যোগ আছে?

লিখুন এই ঠিকানায়: হ্যালো 70s, রবিবাসরীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০ ০০১। বা, লেখা pdf করে পাঠান এই মেল-ঠিকানায়: robi@abp.in

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

chinmoy roy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE