শেষ যাত্রায় ইন্দিরা গাঁধী। ৩ নভেম্বর, ১৯৮৪। সারা ভারতই শামিল হয়েছিল, কেউ পাশে হেঁটে, কেউ টিভির পরদায় চোখ রেখে
বার বার বললেও কেউ বিশ্বাস করতে চাইছিল না যে আমাদের বাড়ির টিভি খারাপ। থিয়েটারে যে ভাবে পরদা দু’দিক থেকে এসে মঞ্চ ঢেকে দেয়, ঠিক সে রকমই, আমাদের টিভিটা চালু হওয়ার কিছু ক্ষণের মধ্যেই স্ক্রিনের দু’দিক থেকে কালো হতে হতে পুরোটা কালো হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু শুনে সব্বাই বলল, কক্ষনও টিভি খারাপ না, গুল মারছিস। আমাদের ছোট্ট মফস্সলে তখন মোটে পাঁচটা বাড়িতে টিভি। আর পাঁচটা বাড়িতেই চলছে অগ্রিম সিট বুকিং। না, অমিতাভ বা উত্তমকুমারের সিনেমা দেখার জন্য নয়। ইন্দিরা গাঁধীর অন্তিম যাত্রা দেখানো হবে টিভিতে। লাইভ টেলিকাস্ট। কেউ মিস করতে চাইছে না।
১৯৮৪-র ৩ নভেম্বর। দুপুর একটা নাগাদ শুরু হওয়ার কথা টেলিকাস্ট। বারোটার পর থেকেই বাড়িতে লোকজনের উঁকিঝুকি। দেখলাম বলেকয়ে বিশ্বাস করানো যাবে না। তার চেয়ে হাতেকলমে দেখুক। টিভির সামনে সতরঞ্চি পেতে দেওয়া হল। বন্ধুরা কেউ কেউ খাটে উঠে বসল। এক জন বলল, দরজাটা বন্ধ করে দে। টিভি খারাপ রটিয়ে দিয়ে ভালই করেছিস। বাড়িতে ভিড় কম হয়েছে। ‘মরশুমি ক্লাব’-এ তো শুনলাম টিভি-ঘরের ক্যারমবোর্ড সরিয়ে ফেলতে হয়েছে। জানলার ধারে কে দাঁড়াবে সেটা পর্যন্ত বুক্ড।
মা টিভিকে বেডকভার দিয়ে মুড়ে রাখত। সেই বেডকভার সরিয়ে টিভি চালানো হল। শুরুটা হল ভালই। সবাই তখন মুচকি হাসছে। এই যে বললি টিভি খারাপ! কী ঝকঝকে ছবি। একটুও ঝিলঝিল করছে না। পাঁচ মিনিট যেতে না যেতেই দু’দিক দিয়ে কালো। দৃশ্যগুলো উৎপটাং লম্বা হতে শুরু করল। সবাই হইহই। কী হল? ঠিক করে দে, ঠিক করে দে। বললাম, ঠিক হবে না। কিছু করার নেই। একটু পরেই টাইটানিকের মাঝসমুদ্রে ডুবে যাওয়ার মতো গোটা টিভি অন্ধকারে ডুবে গেল। বন্ধুদের আমাকে গালাগালি দেওয়ারও সময় নেই। ছুট ছুট ছুট। আমিও ছুটলাম। কিন্তু কোথায়? আমাদেরটা বাদ দিয়ে কীর্ণাহারে আর চারটে টিভি-বাড়ি। চারটেই হাউসফুল।
মরশুমি ক্লাবঘরের সামনে এসে বুঝলাম, এখানে ঠাঁই মেলা অসম্ভব। সবাই এত মোহিত যে কাউকে কিছু বললে চড়টড় মেরে দিতে পারে। একটা জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম, একটা কোনা থেকে একটু দেখা যাচ্ছে। ফুলে ঢাকা একটা গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। রাস্তার দু’দিকে জনঅরণ্য। ভাল করে দেখব বলে যেই জানলার রড ধরে ওপরে উঠেছি, লোডশেডিং।
ক্লাবের এক কর্মকর্তা বলে উঠল, বন্ধুরা, হতাশ হবেন না। ব্যবস্থা আছে। লোডশেডিং হতে পারে এই আশঙ্কায় জেনারেটর আগে থেকেই ভাড়া করা ছিল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই জেনারেটর চালু হয়ে গেল। জেনারেল লাইন থেকে জেনারেটর লাইনে গিয়ে যেই না জেনারেটর চালু হল, অমনি কারেন্ট চলে এল। ফের জেনারেটর বন্ধ, জেনারেল লাইন চালু। আবার কিছু ক্ষণ গেল টিভি চালাতে।
ইন্দিরা গাঁধীর শববাহী গাড়ি যাওয়া যেমন দেখছি, সেই সঙ্গে আমাদের কীর্ণাহারের মানুষদের দিল্লি-দর্শনও হচ্ছে। কেউ বলছে, দেখেছিস, দিল্লি কলকাতার থেকে কত বড়? কত পরিষ্কার শহর, কত চওড়া রাস্তা! কত বড় বড় বাড়ি! শুনে কলকাতা ঘুরে আসা ক’জন গ্রামবাসী বলে উঠল, কলকাতা তো যাওনি। এত বড় বড় রাস্তা ওখানে যে গেলে হারিয়ে যাবে। রেড রোডে গেছ কখনও? রেড রোড কী আমরা জানি না। তাই তর্ক থামাতে হল।
সব হোমরাচোমরা বিদেশি রাষ্ট্রনায়কদের মুখ দেখা যাচ্ছে টিভিতে। কাউকেই প্রায় চিনি না। ইংরিজি ও হিন্দি ধারাভাষ্য যে বুঝতে পারছে, সে কিছু কিছু অনুবাদ করে দিচ্ছে বাংলায়। এর মধ্যে দর্শকদের এক জন বলে উঠল, বচ্চনকে কি দেখা যাবে? শুনেছি ও গাঁধী পরিবারের খুব বন্ধু।
কথা শুনে কয়েক জন ইন্দিরা-ভক্ত খেপে উঠল। এক জন বললো, বেরিয়ে যাও এখান থেকে। আজকের দিনেও অমিতা বচ্চনকে (তখন কেউ অমিতাভ বচ্চন বলত না, বলত অমিতা বচ্চন) দেখতে হবে? এত সিনেমা দেখো, তবু মন ভরে না? এক জন ফুট কাটল, দাদা, সে তো দেখি হল-এ গিয়ে টিকিট কেটে। বিনা পয়সায় টিভিতে কী অমিতা বচ্চনকে দেখা যায়?
তিন ঘণ্টারও বেশি সময় লাগল তিনমূর্তি ভবন থেকে শান্তিবন আসতে। এই প্রথম বোধহয় সিনেমা দেখা ছাড়া এত ক্ষণ টিভির সামনে বসে থাকা। কারও কারও আবার আমার মতো জানলার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকা। দূর গ্রাম থেকেও সাইকেল চালিয়ে অনেকে এসেছে। মহিলারা যতটা সম্ভব সামনের সারিতে বসা। ক্লাবে বসে যারা টিভি দেখে, সাধারণত সিনেমা বা অন্য অনুষ্ঠান দেখার সময় মৌজ করে বিড়ি-সিগারেট খায়। এ ক্ষেত্রে ক্লাবের কর্মকর্তারা আগেই বলে রেখেছিলেন, ইন্দিরা গাঁধীর অন্তিম যাত্রা দেখার সময় কোনও রকম নেশা করা চলবে না। নো বিড়ি-সিগারেট।
চারটে বাজতে চলল। ইন্দিরা গাঁধীর দেহ চিতায় ওঠার জন্য প্রস্তুত। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া চলাকালীন অমিতাভ বচ্চনকে টিভিতে দেখিয়েছে, বলিউডের আরও ক’জন নায়কনায়িকাকেও। এ বার কিন্তু অমিতা বচ্চনকে দেখে সেই উন্মাদনা নেই। শীতের নভেম্বর-বিকেলে আমাদের মফস্সলে হঠাৎই যেন একটা শূন্যতা।
আসল চমকটা অপেক্ষা করছিল বাড়িতে। ক্লাবের জানলার রেলিংয়ে ঝুলে পুরো অনুষ্ঠান দেখে বাড়ি ফিরে দেখি, টিভি চলছে! আমাদের বাড়ি থেকে লোকজন বেরচ্ছে। অবাক হয়ে দেখলাম, আমাদের বড় সাদা-কালো টিভিটা কে স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে খুলে দিয়েছে। টিভির পেছনে একটা টেবিল ফ্যান বনবন ঘুরছে। আমি তো অবাক। তোমরা দেখলে, অনুষ্ঠান? জানা গেল, ইলেকট্রিকের কাজ জানা এক মিস্ত্রি টিভি দেখতে এসেছিল। টিভি কালো হয়ে যাচ্ছে শুনে সে বলেছে, ও কিছু না, পিকচার টিউব গরম হয়ে যাচ্ছে। টিভির পেছনটা খুলে দিয়ে একটা ফ্যান চালাতে হবে। তাতেও হয়তো কালো হবে, কিন্তু ছবি অনেক ক্ষণ ঠিকঠাক থাকবে। ওই ভাবেই ওরা মাঝেমধ্যে টিভি বন্ধ করে, কখনও টিভির পেছনে টেবিল ফ্যান চালিয়ে অনুষ্ঠান দেখেছে।
পাড়ার ওই হাতুড়ে মিস্ত্রির টোটকায় আমাদের বাড়িতে বসেও সে দিন অনেকে দেখতে পেয়েছিল ইন্দিরা গাঁধীর অন্তিম যাত্রা।
aryabhatta.khan@gmail.com
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy