সে গ্রামের ঘরে ঘরে কালীপুজো হয়!
শিয়ালদহ-লালগোলা রেলপথে নদিয়া জেলার ধুবুলিয়া স্টেশন থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে কোতোয়ালি থানার অন্তর্গত সেই গ্রামের নাম বেলপুকুর। সাবেক নাম যদিও বিল্বপুষ্করিণী। এক সময় গঙ্গা তীরবর্তী ছিল বেলপুকুর। পরবর্তী কালে গঙ্গা তার গতিপথ পরিবর্তন করে।
গবেষকদের মতে বাংলাদেশে আগে কেউ কালীমূর্তি গড়ে পুজো করতেন না। ঘটে-পটে-যন্ত্রে কালীপুজো হত। তাও আবার বাড়িতে নয়! মন্দিরে, শ্মশানে, রাস্তার তিন মাথায় কিংবা নদীর ধারে। বাংলায় কালীমূর্তি পুজোর প্রচলন করেছিলেন নবদ্বীপের পণ্ডিত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ। তিনি নিজে কালীমূর্তি গড়ে পুজো করেছিলেন। শুধু তাই নয় বিভিন্ন দেব-দেবীর পুজো পদ্ধতি তিনি লিপিবদ্ধ করেছিলেন তাঁর ‘তন্ত্রসার’ গ্রন্থে। বাঙালির কালীপুজোর ঐতিহ্যের সেই শুরু।
শ্রীচৈতন্যের তিরোধানের পরে বাংলায় বৈষ্ণব ধমের্র প্রভাব ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়ে। ফের মাথা তোলে ব্রাহ্মণ্যধর্ম। এমনই এক সময় বাংলায় শাক্তধর্মের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয়েছিল দুর্গা, কালী, জগদ্ধাত্রী তথা দশমহাবিদ্যার বিভিন্ন রূপের আরাধনা দিয়ে। বিশেষ করে নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে বাংলায় শাক্তধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটে। গবেষকদের মতে, সেই প্রভাবেই নবদ্বীপের শাক্ত রাস ও উলা-বীরনগরে বৈশাখী পূর্ণিমায় বিভিন্ন শাক্ত দেবীর পুজোর প্রচলন ঘটে। এ ছাড়াও রামপ্রসাদ সেন, কমলাকান্ত, শ্রীরামকৃষ্ণ, বামাক্ষ্যাপা প্রমুখ সাধকের প্রভাবে শ্মশানবাসি কালী প্রবেশ করলেন বাঙালি গৃহে এবং সাহিত্যে। শোনা যায় প্রজাদের নদিয়ারাজ কালীপুজো করার নির্দেশ দেন। সেই আদেশ অমান্য করলেই সাজা মিলত। শ্রীরামপুর খ্রিস্টীয় মিশনের পাদ্রি ওর্য়াড সাহেবের তথ্যানুসারে জানা যায়, সেই সময় নদিয়ায় প্রতি বছর কার্তিকী অমাবস্যায় দশ হাজার কালীপুজো হত।
অনেকেই মনে করেন নবদ্বীপের গঙ্গার প্রায় উল্টো দিকের বেলপুকুর কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ প্রবর্তিত কালীপুজোর ঐতিহ্যের ধারক এবং বাহক। নদীয়ারাজের দানভাজন তথা আশ্রিত বেলপুকুরের ব্রাহ্মণ সমাজের উদ্যোগে সপ্তদশ শতকের শেষার্ধে শুরু হয়েছিল ঘরে ঘরে কালীপুজো।
পণ্ডিত রামচন্দ্র ভট্টাচার্য নদিয়ারাজ রুদ্র রায়ের দানভাজন ছিলেন। কিংবদন্তি অনুসারে, রামচন্দ্র এক পুকুরের পাশে বিল্ববৃক্ষের নীচে পঞ্চমুণ্ডির আসনে তন্ত্র সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। সে জন্য জায়গাটির নাম হয় বিল্বপুষ্করিণী বা বেলপুকুর। এই রামচন্দ্রের বংশধরেরা বেলপুকুরের ন’বাড়ি নামে পরিচিত। কার্তিকী অমাবস্যায় আজও ন’বাড়িতে তান্ত্রিক বিধি অনুসারে কালীপুজো হয়। এই পরিবারের জওহরলাল ভট্টাচার্য বললেন “অতীতে এ বাড়িতে এক জোড়া কালীমূর্তি পুজো হত। বর্তমানে একটি মূর্তিই পুজো হয়। আগে মাটির সাজ হলেও, এখন সাজ পরানো হয় শোলার। এখানে বলি প্রথা আজও রয়েছে। এখনও চোদ্দ পনেরোটি পাঁঠা বলি হয়। আজও গঙ্গাজলের পরিবর্তে এখানে পুজো হয় কারনে।” শোনা যায় এ বাড়িতে আজও রয়েছে রামচন্দ্রের ব্যবহৃত ‘মহাশঙ্খের মালা’। জওহরবাবু আরও জানালেন, এই মালায় জপ করেই রামচন্দ্র সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। আত্মঘাতী কিংবা অপঘাতে মৃত চণ্ডালিনীর আঙুলের করের (মতান্তরে ব্রহ্মতালুর) ১০৮টি খণ্ড দিয়ে তৈরি এই মালা। যা সারা বছর রাখা থাকে খুলির তৈরি একটি বাক্সের মধ্যে। কালীপুজোর রাতে এই মালা বের করে তার উপর কারণ ঢালা হয়। সেই মালা কারণ শুষে নেয়।
শোনা যায় পরবর্তী কালে রামচন্দ্রের বংশধরেরা আলাদা ভাবে তাঁদের বাড়িতে পুজো শুরু করেন। সেই থেকেই পুজোর সংখ্যা বেড়েছিল। আগে পাঁচশোর বেশি পুজো হলেও বর্তমানে প্রায় দু’শো বাড়িতে পুজো হয়। কারও মতে সিদ্ধেশ্বরীতলার পুজোটি সবচেয়ে পুরনো। এমনটাই জানালেন বেলপুকুরের প্রবীণ শিক্ষক সমীর ভট্টাচার্য।
মাঝেরপাড়া ভট্টাচার্য বাড়ির প্রাচীন পুজোয় আজ আর পশুবলি হয় না। এই পরিবারের সুধীন ভট্টাচার্য বললেন “বর্তমানে চালকুমড়ো, আখ ইত্যাদি বলি দেওয়া হয়। শোলার সাজের সাবেক প্রতিমা। পুজোয় খিচুড়ি, ভাজা, তরকারি, মাছ, পায়েস ভোগ দেওয়া হয়। আগে বাড়িতেই প্রতিমা তৈরি হত। বর্তমানে কুমোর বাড়ি থেকে প্রতিমা আনা হয়। তবে অতীতের সব প্রথা মেনেই পুজো হয়।”
কবেই তিনশো পেরিয়েছে মাঝেরপাড়ার মুখোপাধ্যায় বাড়ির পুজো। এখানেও ডাকের সাজের সাবেক প্রতিমা। তবে এ বাড়ির পুজোয় আজও পশুবলি হয়। এই পরিবারের ধীমান মুখোপাধ্যায়ের কাছে জানা গেল একই অঞ্চলে অসংখ্য পুজো হওয়ায় একটা আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে পরিবারগুলির মধ্যে। যেমন এক বাড়ির প্রতিমা পাটে (বেদীতে) ওঠার সময় আশপাশের বাড়ির প্রতিবেশীরা এসে সাহায্য করেন। তেমনি, এক বাড়ির পুজোয় দুর্লভ বা অসময়ের কিছু ফলমূল পাওয়া গেলে তা ভাগ করে নেওয়া হয় প্রতিবেশীদের পুজোয়। প্রতিমা বিসর্জনের সময় অতীতে যে বাড়ির প্রতিমা আগে বেরতো, প্রথা মেনে আজও তেমনটাই হয়। শোভাযাত্রা করে সূর্যাস্তের মুহূর্তে ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে সমস্ত প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়।
পুজোর নানা কথা বলতে বলতে মুহুরি পাড়ার ভট্টাচার্য বাড়ির বিশ্ববিজয় ভট্টাচার্য বলছিলেন, “অন্যান্য জায়গায় যেমন ঘরে ঘরে লক্ষ্মী কিংবা সরস্বতী পুজো হয়, ঠিক তেমনই বেলপুকুরের ঘরে ঘরে হয় কালীপুজো।” তাঁদের প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো পুজোয় আজও বলি দেওয়া হয়। পুজোয় কারণ ব্যবহৃত হয়। এই কারণ তৈরি হয় ডাবের জলে লোহা দিয়ে।
সময়ের সঙ্গে বদলায় অনেক কিছুই। আগে বেলপুকুরের ঘরে ঘরে ছিলেন তন্ত্রসাধক। চলত তন্ত্রসাধনা। দীর্ঘ দিন ধরে পৌরোহিত্য করছেন বেলপুকুরের সৌতমকুমার ভট্টাচার্য। তিনি জানালেন, আগে ঘরে ঘরে ছিল পঞ্চমুণ্ডির আসন। সেখানেই চলত তন্ত্র সাধনা। তবে ছবিটা আজ বদলেছে। বেশির ভাগ পঞ্চমুণ্ডির আসন আজ লুপ্ত। কালের স্রোতে যেগুলি টিকে আছে সেখানে নিত্যপুজো-অর্চনা করা হয়। তবে বেশির ভাগ বাড়িতে কালীপুজোর ঐতিহ্য আজও অটুট। সময়ের সঙ্গে পুরনো কিছু পুজো যেমন নানা কারণে বন্ধ হয়েছে, নতুন করে বহু পুজো তেমন শুরুও হয়েছে।
তবে শুধু বাড়ির পুজোই নয়। বেলপুকুরে বিভিন্ন পাড়ায় হয়ে আসছে বেশ কিছু সর্বজনীন কালীপুজো। সেখানেও দেখা যায় বৃহৎ আকারের সাবেক কালীমূর্তি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সর্দারপাড়া, ঘোষপাড়া, বেলতলা ইত্যাদি জায়গার পুজো।
তবে শহুরে জাঁকজমক, থিমপুজো কিংবা চটকদারি নয়। বেলপুকুরের পুজোর সম্বল সাবেক ঐতিহ্য।
ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy