Advertisement
E-Paper

নবাব নেই, তবু নবাবি আম-গল্প আজও সুস্বাদু

তুলোর দস্তানা পরে তুলোর বিছানায় শুইয়ে এ পাশ-ও পাশ করানো হত তাদের। খোসা ছাড়ানো হত রুপোর ছুরি দিয়ে। লিখছেন অনল আবেদিনতুলোর দস্তানা পরে তুলোর বিছানায় শুইয়ে এ পাশ-ও পাশ করানো হত তাদের। খোসা ছাড়ানো হত রুপোর ছুরি দিয়ে। লিখছেন অনল আবেদিন

শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০১৫ ০০:০০

আজ আর নবাব নেই। নেই সেই নবাবিও। তবে নবাবি আমলের আম-কথা কিন্তু বাংলা-বিহার-ওড়িশার একদা রাজধানী লালবাগের মাটিতে আজও দিব্যি আমজনতার মুখে ফেরে। যেমন, নবাব নাজিম ফেরাদুন জাঁ-র ঘটনা। তাঁর মনপসন্দ আমের চারা পেতে নবাব নাজিমকে কি না শেষতক নিজের কর্মচারীর সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়েছিল।

রুপোর থালায় সাজানো গুটিকয় আম নিয়ে নবাব নাজিম ফেরাদুন জাঁ-কে আদাব জানালেন তাঁরই এক কর্মচারী। ‘‘হুজুর গুস্তাকি মাফ করবেন! এগুলি আমার গাছের আম। নবাব নাজিমের যদি পছন্দ হয়...।’’ নবাবের অর্থ দফতরের ওই কর্মী কিন্তু তখনও জানতেন না, অচিরেই কী সাঙ্ঘাতিক কাণ্ড ঘটতে চলেছে। তাঁর দেওয়া আম খেয়ে নবাব এতই মোহিত যে হুকুম দিলেন, ‘‘এই গাছের কলম আমার চাই। নবাবের হুকুম শুনে এতটুকুও বিচলিত হলেন না ওই কর্মী। নবাবের মুখের উপর তিনি বলে দিলেন, ‘‘হুজুর ওই গাছ কেটে সাফ করে দেব। কিন্তু ওই আম আমি অন্য বাগানে হতে দেব না। নইলে আমার বাগানের বিশেষত্ব থাকল কোথায়!’’

দুই প্রান্তে দুই নাছোড়বান্দা। এক দিকে আমগাছের কলমচারা পেতে নবাবের জেদ। অন্য দিকে নবাবকর্মী। তিনি তাঁর আমবাগানের নজিরবিহীন বিশেষত্ব অক্ষুণ্ণ রাখতে একবগ্গা। অবশেষে একটি পথ বার করলেন নবাব নাজিম। নিজের ছেলে ও মেয়ের সঙ্গে মির্জা পদাধিকারী ওই কর্মীর মেয়ে ও ছেলের বিয়ের প্রস্তাব দেন। বিয়েও হয়। মুসলিম বিয়ের রীতি অনুসারে বরের থেকে কনের প্রাপ্যের নাম দেন মোহর। নবাব বললেন তার মেয়ের মোহর কিন্তু অর্থ বা সোনায় নয়। তার বদলে মোহর হিসাবে নেবেন সেই দিলখুশ করা আমগাছের চারা। সন্তানদের বিয়ে দিয়ে তা আদায়ও করলেন। সেই আমের নাম ‘মির্জা পসন্দ’।

এখন নবাব ও নবাবি— কোনওটা না থাকলেও ‘ছোটে নবাব’ কিন্তু আছেন বহাল তবিয়তে। নবাব পরিবারের বর্তমান বংশধর ফুরফুরে মেজাজের অশীতিপর মানুষটিকে লালবাগের মানুষ ছোটে নবাব বলেই চেনেন। ছোটে নবাবও সেটাই পছন্দ করেন। পূর্বপুরুষদের আমপ্রীতির আখ্যান বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি রীতিমতো গর্বিত। ছোটে নবাব বলেন, ‘‘মির্জা পসন্দ আমগাছ নিয়ে এত কাণ্ড! সেই আমগাছই আজ বিলুপ্ত। নবাবদের চেষ্টায় এখানে এক সময় আড়াইশো প্রজাতির আম ছিল। এখন কমে দাঁড়িয়েছে শ’খানেকে। নবাব ওয়াসেফ আলি মির্জার অতিপ্রিয় তোতা আমও আজ বিলুপ্ত। অথচ তোতা আম নিয়ে নবাবের সঙ্গে ইংরেজদের বিবাদ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল।’’

হাজারদুয়ারির স্রষ্টা নবাব হুমায়ুন জাঁ-র স্ত্রী বেগম রইসুন্নেসার নামে আড়াই বিঘার একটি আমবাগান ছিল। সেই বাগানের নাম রইসবাগ। সেই রইসবাগে ছিল নবাব ওয়াসেফ আলি মির্জার বড় প্রিয় তোতা আম। লালবাগের গুলুবাবু নামের এক জনকে রইসবাগ লিজ দিয়েছেন মুর্শিদাবাদ এস্টেট ম্যানেজার। শুনে নবাব রাগে ফুঁসছেন। ব্রিটিশরাজের বোর্ড অফ রেভিনিউ-র সঙ্গে নবাবের দ্বন্দ্ব মেটাতে গঠন করা হল কমিশন। নবাবকে হতাশ করে কমিশনের রায় গেল গুলুবাবুর পক্ষেই। রাগে, ক্ষোভে, হতাশায়, অপমানে আর কোনও দিন তোতা আম ছুঁয়েও দেখেননি নবাব সৈয়দ ওয়াসেফ আলি মির্জা। সেই তোতা আমেরও আজ আর হদিস নেই।

কোহিতুর, হিমসাগর, গোবিন্দভোগ, মধুচূড়, লক্ষণভোগ, রানি, ভবানি, গোলাপখাস বিমলি, রওগনি, চম্পা, নবাবপসন্দ, চন্দন খোসা, বম্বাই, বিড়া, সড়াঙ্গা, আনারস, রানিপসন্দ, পাঞ্জাপসন্দ, সিন্দুরে— এ রকম শ’খানেক প্রজাতির আম আজও টিকে আছে। অবলুপ্ত আরও প্রায় দেড়শো প্রজাতির আম। লালবাগের নবাব পরিবারের অভিযোগ, কংগ্রেস আমলের মন্ত্রী আব্দুস সাত্তার থেকে প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু পর্যন্ত অনেকের কাছে দরবার করা সত্ত্বেও লুপ্তপ্রায় প্রজাতির আমগাছ রক্ষা করার জন্য ম্যাঙ্গো অ্যাম্পোরিয়াম গড়ে তোলা হয়নি।

সরকারি উদ্যোগ চোখে না পড়লেও এ ক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোগ কিছুটা হলেও গড়ে উঠেছে। লালবাগ শিংঘি হাইস্কুলের উদ্ভিদবিজ্ঞানের শিক্ষক মহম্মদ আলি বলেন, ‘‘ঐতিহাসিক আমগাছ রক্ষার উদ্দেশ্যে আমরা ইতিমধ্যে ৪০টি জাতের আমগাছ লাগিয়েছি। ওই সংখ্যা বাড়ানোর ইচ্ছা আছে। ইচ্ছা আছে আমের মিউজিয়াম বানানোর। অবশ্যই জীবন্ত আমাগাছের।’’ নবাব মুর্শিদকুলির জামাই নবাব সুজাউদ্দিনের মাথায় এ জাতীয় কোনও ভাবনা ছিল কি না, জানা নেই। তবে ইতিহাস বলছে, আড়াইশো বছর আগেই আমের গুণমান বিচার, উৎকর্ষ বাড়ানো, পাকা আম ভোজনরসিকদের মনঃপুত করে তুলতে লালবাগের কিল্লা নিজামত এলাকায় তিনি গড়ে তুলেছিলেন একটা বিশাল বাড়ি। সেই বাড়ির নাম আম্বাখানা।

তুলোয় মোড়া জালি দিয়ে গাছ থেকে আম নামানোর পর তুলোর দস্তানা পরে সেই আম নিয়ে যাওয়া হত আম্বাখানায়। তুলোর বিছানায় শুইয়ে রাখা হত সেই গাছপাকা আম। তুলোর বিছানায় শুইয়ে রাখা আম ঘণ্টায় ঘণ্টায় এ-পাশ ও-পাশ করে দেওয়া হত। বিশেষত কোহিতুর আমের ক্ষেত্রে এটা ছিল বাধ্যতামূলক। তার পর লগ্ন এলে রুপোর ছুরি অথবা বাঁশের ছিলকা দিয়ে খোসা ছাড়িয়ে ফালি ফালি করে কেটে আম পরিবেশন করা হত। নবাব পরিবারের বাকের আলি মির্জার মতে, ‘‘ফলের রাজা আম বড় অভিমানী। সামান্য অযত্ন হলেই আমের স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে অত যত্নআত্তি।’’

বর্তমানে মুর্শিদাবাদ জেলায় প্রায় ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে আমবাগান রয়েছে। উদ্যানপালন বিভাগের উপ-অধিকর্তা গৌতম রায় বলেন, তার মধ্যে সিকিভাগ বাগানের বয়স চার বছরেরর কম। সেই বাগানগুলি বাদ দিয়ে বাকি বাগানে এ বছরে মোট আমের ফলন প্রায় ৯৫ হাজার মেট্রিক টন।’’ কিন্তু এ জেলায় সংরক্ষণ কেন্দ্র বা প্রক্রিয়াকরণ শিল্প গড়ে না ওঠায় আমের অভাবি বিক্রি অবশ্যম্ভাবী। গৌতমবাবু বলেন, ‘‘আলফানসো-র মতো বিদেশে রফতানি করারও কিছু অসুবিধা রয়েছে এ জেলার আমের। উত্তরপ্রদেশ বা বিহারের মতো এ জেলার আবহাওয়া শুষ্ক নয়। এখানকার আবহাওয়া আর্দ্র ও গরম। এই আবহাওয়ায় আমে পোকা ধরে বেশি। তার জন্য কীটনাশক বেশি প্রয়োগ করতে হয়। তা ছাড়া এ জেলার পাকা আমের আয়ু ক্ষণস্থায়ী। দ্রুত পচন ধরে। তবুও লক্ষণভোগ আম এ বার রাজ্য বা দেশের বাইরে রফতানি করার পরিকল্পনা রয়েছে।’’

উদ্যানপালন বিভাগের সহ-অধিকর্তা শুভদীপ নাথ বলেন, ‘‘এক বিঘা বাগানে মাঝারি আকৃতির বাটির সমান ২-৩টি ফাঁদ পাতা হয়। তাতে থাকে গন্ধময় ট্যাবলেট। গন্ধের টানে সেই ফাঁদে ধরা দেয় স্ত্রী কীট। এবং মারাও যায়। এ ভাবে কীটনাশক কম ব্যবহার করে পরিবেশ-বান্ধব আমচাষ শুরু হয়েছে। সেই সব আম কলকাতার কিছু রিটেল মলে এ বার বিক্রি করা হবে। এ ছাড়াও ভিন রাজ্যে এ জেলার সুস্বাদু আম রফতানি করার জন্য বেসরকারি সংস্থা ‘মুর্শিদাবাদ হেরিটেজ ডেভেলপমেন্ট কমিটি’ উদ্যোগী হয়েছে।’’ পরিবেশ-বান্ধব আমচাষের ক্ষেত্রে অগ্রণী চাষির নাম হায়াতন নবী। বরফখানার হায়াতন নবী বলেন, ‘‘দুবাইয়ে এক বার আম রফতানি করেছিলাম। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে আমাদের দেশের আমের খুবই চাহিদা। দাম কেজি প্রতি ৪০০ টাকা। এখন মুর্শিদাবাদের বাগানে আমের দাম ১৫-২০ টাকা কেজি। বিদেশে ৪০০ টাকা কেজি দরে আম বেচতে হলে পরিবেশ-বান্ধব আমচাষ করতে হবে। সেই চেষ্টা শুরু হয়েছে গত ২০১০ সাল থেকে।’’

ছবি: গৌতম প্রামাণিক

mango anal abedin bengal bihar odisha
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy