বছর চারেক আগে ‘প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাচারাল অ্যাকাডেমি অব দ্য সায়েন্সেস’ (পিএনএস) জার্নালে একটি গবেষণাপত্র ছাপা হয়, যেখানে ডেনমার্কের আরহাস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দল গবেষক দেখান, ইকুয়েডরের চিমবোরাজো আগ্নেয়গিরির মাথার বরফ গলছে। পাহাড়চূড়ার দখল নিচ্ছে নতুন নতুন গুল্ম ও শৈবালের প্রজাতি। এই ডেনিস বিজ্ঞানী দল ২০১০ সাল থেকে প্রতি বছর চিমবোরাজো আগ্নেয়গিরিতে অভিযান চালিয়েছেন এবং তথ্য সংগ্রহ করেছেন। তাঁরা সেই পথেই হেঁটেছিলেন, ২১৭ বছর আগে যেখানে পা রেখেছিলেন স্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া এক জার্মান প্রকৃতিবিদ, আলেকজান্ডার ফন হুমবোল্ট।
পিএনএস জার্নালে গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই টনক নড়ে বিজ্ঞান মহলের। গবেষণাপত্রে বিশ্ব উষ্ণায়নের ফনে চিমবোরাজোর দ্রুত বরফ গলে যাওয়ার ইঙ্গিত স্পষ্ট। আর সেই তথ্য সংগ্রহে পথ দেখিয়েছেন হুমবোল্টই। আঠারোশো শতকের শেষ বছরে হুমবোল্টের দক্ষিণ আমেরিকা যাত্রা শুরু। ১৮০২ সাল নাগাদ তিনি পৌঁছন চিমবোরাজোর পাদদেশে। সে সময় চিমবোরাজোকেই মনে করা হত, পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ। উচ্চতা ৬,৪০০ মিটার। হামবোল্ট অবশ্য চিমবোরাজোর চূড়ায় ওঠেননি। তবে তাঁর ডায়েরি অনুযায়ী, তিনি ৫,৮৭৮ মিটার পর্যন্ত উঠতে পেরেছিলেন। বরফে হাঁটার উপযোগী জুতোর সুকতলা ছিঁড়ে যাওয়ায় তিনি নেমে আসেন। অবশ্য উনিশ শতকে সেটিই ছিল বিশ্বরেকর্ড। সে সময় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এতটা উঁচুতে আর কোনও মানুষ পা রাখেননি। অদ্ভুত সমাপতন, ঠিক সেই বছরই উচ্চতম শৃঙ্গের খোঁজে ভারতে দ্য গ্রেট ট্রিগনোমেট্রিক সার্ভের কাজ শুরু হয়। চিমবোরাজো নয়, মাউন্ট এভারেস্টই যে পৃথিবীর উচ্চতম শৃঙ্গ, তা জানতে লেগে গিয়েছিল আরও ৫০ বছর। তাই হুমবোল্ট ইকুয়েডর গিয়েছিলেন এই ভাবনা নিয়েই যে, তিনি সর্বোচ্চ শৃঙ্গের জরিপ করছেন। অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিনি পাহাড়চূড়ার বরফ এবং পাদদেশের উদ্ভিদ প্রজাতির তথ্য লিপিবদ্ধ করেছিলেন। পাঁচ বছর পরে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে সংগৃহীত তথ্য ব্যবহার করে হুমবোল্ট একাধিক ছবি আঁকেন, যা প্রকাশিত হয় ‘ফিজিক্যাল ট্যাবলো অব দ্য আন্দিজ অ্যান্ড নেবারিং কান্ট্রিজ’ নামে। এই ছবিগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত চিমবোরাজোর ছবি, যা বর্তমানে প্যারিসের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে সংরক্ষিত।
আরহাস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের অভিযানের প্রাথমিক তথ্যসূত্রই ছিল হুমবোল্টের আঁকা ছবি। সেই ছবির হাত ধরেই তাঁরা চিমবোরাজোর বরফের মাত্রা মাপতে থাকেন। পিএনএস জার্নালে হুমবোল্টের আঁকা ছবি ও বর্তমানে চিমবোরাজো থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি ছবি প্রকাশ হতেই নড়েচড়ে বসে বিজ্ঞান মহল। ‘সায়েন্স’ পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক টিম অ্যাপেনজেলার এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, হুমবোল্টের আঁকা চিমবোরাজোর ছবি ছিল প্রথম জলবায়ু পরিবর্তনের দিকে আঙুল-তোলা তথ্য। কিন্তু দু’শো বছরেরও বেশি সময় সে দিকটা নজরই দেওয়া হয়নি। এমনকি বিজ্ঞানমহল মনেই রাখেনি যে, নিঃশব্দে ২৫০ বছর পেরোতে চলেছেন হুমবোল্ট। ২০১৫ সালের পর গত চার বছরে ইকুয়েডরে একাধিক অভিযান চালায় প্রকৃতিবিদ, বিজ্ঞান সাংবাদিক, বিজ্ঞানী ও চিত্রগ্রাহকদের সম্মিলিত এক দল। অভিযানের পৃষ্ঠপোষক ‘সায়েন্স’ পত্রিকার প্রকাশক আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য অ্যাডভান্সমেন্ট অব সায়েন্স সংস্থা। হুমবোল্টের পরে কী ভাবে প্রতি বছর বরফ হারিয়েছে চিমবোরাজো, সে তথ্য উন্নত সিমুলেশনের মাধ্যমে তুলে ধরে তৈরি করা হয় ছবি। ২৫০-তম জন্মবার্ষিকীতে পৌঁছে ফের বিশ্বজুড়ে পরিবেশ সংরক্ষণকারী ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের কাছে হিরো হয়ে ওঠেন। পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত দু’টি বিজ্ঞান পত্রিকা, ‘নেচার’ ও ‘সায়েন্স’ হুমবোল্টকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে।