মহাকাশে যেখানে দেখা গিয়েছিল সেই ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ। ছবি- নাসা।
‘অ্যানাকোন্ডা’র দেখা মিলল মহাকাশে! জোরালো নিশ্বাসে দূর থেকে টেনে এনে যে গিলে খাচ্ছে একটা ‘গরু’কে! কয়েক লহমার জন্য নয়, সেই অ্যানাকোন্ডার ভোজনপর্ব চলল টানা তিন দিন ধরে। তার খাওয়ার সময় চার পাশে ছড়িয়ে, ছিটিয়ে পড়ছে সেই গরুর দেহের বিভিন্ন অংশ। উত্তাপে ঝলসে যাচ্ছে। আর তাতে এতটাই আলোয় ভরে উঠেছে মহাকাশ, যা এর আগে দেখা যায়নি কখনও। জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষায় এই ঘটনাটার নাম- ‘এটি-২০১৮-কাউ’। যার ডাক নাম- ‘কাউ’ (গরু)।
মহাকাশে অ্যানাকোন্ডার ওই ভোজনপর্ব দেখল নাসার দু’টি টেলিস্কোপ। নিল গেহরেল্স সুইফ্ট অবজারভেটরি ও নিউক্লিয়ার স্পেকট্রোস্কোপিক টেলিস্কোপ অ্যারে (নিউস্টার)। আর তাকে অ্যানাকোন্ডার মতো যে গিলে খাচ্ছে, তা আদতে একটি অসম্ভব ভারী ব্ল্যাক হোল কৃষ্ণগহ্বর।
এত আলোর ছটা এর আগে দেখা যায়নি
এই নজরকাড়া ঘটনা চাক্ষুষ করার কথা জানানো হয়েছে গত ১০ জানুয়ারি, সিয়াট্লে আমেরিকান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির ২৩৩তম বৈঠকে।
কোনও তারা বা নক্ষত্রের মৃত্যুর সময় যে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ হয় তাকে বলে, সুপারনোভা। সুপারনোভার সময় তীব্র আলোর ছটা দেখা যায় মহাকাশে। কিন্তু সেই ছটার ঔজ্জ্বল্য বেশি দিন থাকে না। অল্প সময়েই তা ফিকে হতে শুরু করে। তার পর তা হারিয়ে যায়।
দেখুন, হাব্ল টেলিস্কোপে ধরা পড়া সুপারনোভার ভিডিয়ো। এই ঘটনা আগেই আঁচ করা গিয়েছিল
এ বার যেটা সকলকে অবাক করে দিয়েছে, তা হল, সাধারণত সুপারনোভা হলে যতটা আলোর ছটা দেখা যায়, মহাকাশে অ্যানাকোন্ডার ভোজনপর্বে তার ১০ গুণ আলো ঠিকরে বেরিয়েছে। আর সেই সুতীব্র আলোর ছটা দেখা গিয়েছে টানা তিন দিন ধরে। সেই আলোর ছটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতেও সময় নিয়েছে বেশ কয়েক মাস।
কত দূরে হদিশ মিলেছে সেই আলোর ছটার?
ঘটনাটা ঘটেছে আমাদের থেকে ২০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে। হারকিউলিস নক্ষত্রপুঞ্জে। হতে পারে, সেই ঘটনা ঘটেছে অত দূরে থাকা ‘সিজিসিজি ১৩৭-০৬৮’ গ্যালাক্সিতে। বা সেই গ্যালাক্সির খুব কাছাকাছি। এমনটাই বলছেন পাসাডেনায় নাসার জেট প্রোপালসান ল্যাবরেটরির (জেপিএল) জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। এই ‘কাউ’-এর হদিশ প্রথম মিলেছিল গত বছরের জুনে। হাউইয়ে বসানো নাসার অ্যাস্টারয়েড টেরেস্ট্রিয়াল-ইমপ্যাক্ট লাস্ট অ্যালার্ট সিস্টেম টেলিস্কোপের নজরে।
ব্ল্যাক হোলের ভোজনপর্ব? নাকি সুপারনোভা? দ্বিধাবিভক্ত বিজ্ঞানীরা
অভূতপূর্ব এই ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কার্যত দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন বিজ্ঞানীরা। একদল বিজ্ঞানী বলছেন, কাছে এসে পড়া একটি মৃত তারাকে গিলে খাচ্ছে একটি রাক্ষুসে ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর। অন্যদের বক্তব্য, না, তা নয়। এটা আদতে একটি সুপারনোভাই। কোনও তারার মৃত্যু-দৃশ্য। মাত্রায় যে বিস্ফোরণটা ভয়াবহ।
কী ঘটেছিল সে দিন মহাকাশে? দেখুন নাসার ভিডিয়ো
পাল্লা ভারী আগ্রাসী অ্যানাকোন্ডার দিকেই!
কলকাতার ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্স (আইসিএসপি)-র অধিকর্তা, বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী সন্দীপ চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘এত উজ্জ্বল আর এতটা সময় ধরে কোনও সুপারনোভার ঘটনা এর আগে ঘটতে দেখা যায়নি। আমার মনে হয়, ওই ঘটনার আদত কারণ, জোরালো অভিকর্ষের টানে খুব কাছে এসে পড়া একটি মৃত তারাকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে খেতে শুরু করেছে একটি অত্যন্ত ভারী ব্ল্যাক হোল। তার ফলে, ওই মৃত তারাটির শরীরের বিভিন্ন অংশ ছিটকে ছড়িয়ে পড়ছে মহাকাশে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলে, টাইডাল ডিসরাপশন ইভেন্ট।’’
আরও পড়ুন- দ্রুত দিক বদলাচ্ছে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র, দিক নির্ণয়ে বিভ্রান্তি স্থলে-জলে-আকাশে
আরও পড়ুন- ভিনগ্রহীদের সঙ্কেত? দু’মাসে ১৩ বার রেডিও তরঙ্গের আলোর ঝলসানির হদিশ একই জায়গায়
চাঁদের অভিকর্ষ বলের জন্য যেমন মহাসাগরের জল ফুলে ওঠে। ফুলে-ফেঁপে ওঠে নদী, সাগরের জল। তা ‘চন্দ্রমুখী’ হয়। জোয়ার আসে। এই ঘটনাও ঠিক তেমনই। ব্ল্যাক হোলের জোরালো অভিকর্ষ বলের টানে মৃত তারাটির শরীর থেকে বেরিয়ে আসে অত্যন্ত গরম গ্যাস বা তাতে ভেসে থাকা ধুলোবালি। কাছেপিঠে থাকা কোনও সুপার ম্যাসিভ (প্রচণ্ড ভারী) ব্ল্যাক হোলের টানে সেই গ্যাসের লেজটা মহাকাশে খসে পড়ে তারার শরীর থেকে। আর বাকি অংশটা পাক মারতে থাকে ব্ল্যাক হোলের চার পাশে। রাক্ষুসে ব্ল্যাক হোলের প্রচণ্ড খিদের মুখে পড়ে ওলটপালট হয়ে যায় মৃত তারার শরীর ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা গ্যাসের স্রোতের বড় অংশটি। তা ব্ল্যাক হোলের চার পাশে এক রকম মেঘের মতো জমাট বেঁধে থাকে। আর সেই মেঘটাকে তার অত্যন্ত জোরালো অভিকর্ষ বলের টানে তার দিকে যেন বেঁধে রাখে ব্ল্যাক হোল। এমনই একটি ঘটনা ঘটেছে ‘কাউ’-এর ক্ষেত্রে। সেই গ্যাসের মেঘকে গিলে খাচ্ছে অ্যানাকোন্ডার মতো একটি দৈত্যাকার ব্ল্যাক হোল।
কেন টানা ৩ দিন ধরে দেখা গেল সেই আলোর ছটা?
‘‘এতটা সময় ধরে ব্ল্যাক হোলের ভোজনপর্ব এর আগে দেখা যায়নি। এটাই আমাদের অবাক করে দিয়েছে। মনে হচ্ছে, যে মৃত তারাটিকে গিলে খাচ্ছে ওই ব্ল্যাক হোল, সেটা আদতে একটি হোয়াইট ডোয়ার্ফ স্টার বা শ্বেত বামন নক্ষত্র। একেবারে অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছলে যে কোনও তারারই যে অবস্থা হয়’’, বলছেন আমেরিকার কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ধ্রুবজ্যোতি বসুচৌধুরী।
সন্দীপ বলছেন, ‘‘অতটা সময় ধরে যেহেতু অনেক বেশি উজ্জ্বল ওই ঘটনা দেখা গিয়েছে, তাই মনে হচ্ছে, টাইডাল ডিসরাপশন ইভেন্টের জন্যই কাছেপিঠে থাকা খুব ভারী একটি ব্ল্যাক হোলের চার পাশে একটি অস্থায়ী চাকতি বা ডিস্ক তৈরি হয়েছিল। আর তা যদি হয়, তা হলে তা ডার্ক ম্যাটার বা অদৃশ্য বস্তর উপর আলোকপাত করতে পারে।’’
যে ভাবে ঘটতে দেখা গিয়েছিল সেই বিস্ফোরণের ঘটনা। টেলিস্কোপের চোখে
এ ব্যাপারে যে দু’টি গবেষণাপত্র নিয়ে এই সপ্তাহে আলোচনা হয়েছে আমেরিকান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির বৈঠকে, তার একটির দুই মূল গবেষকের অন্যতম বাল্টিমোরের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী রিসার্চ সায়েন্টিস্ট অ্যামি লিয়েন। গবেষণাপত্রে লিয়েন লিখেছেন, ‘‘মৃত তারাটির আকার পৃথিবীর মতোই মনে হচ্ছে। আমরা ওই রাক্ষুসে ব্ল্যাক হোলটির ভরও মেপেছি। তা প্রায় একটা বড়সড় গ্যালাক্সির মতো। আমাদের সূর্যের ভরের অন্তত ১০ লক্ষ গুণ। এও দেখেছি, যা স্বাভাবিক, তা হয়নি এই রাক্ষুসে ব্ল্যাক হোলটির ক্ষেত্রে। এত ভারী ব্ল্যাক হোল সাধারণত থাকে কোনও গ্যালাক্সির কেন্দ্রে। কিন্তু এই রাক্ষুসে (সুপার ম্যাসিভ) ব্ল্যাক হোলটি রয়েছে ওই গ্যালাক্সির (‘সিজিসিজি ১৩৭-০৬৮’) কেন্দ্র থেকে অনেকটা দূরে।’’ গবেষণাপত্রটি বেরতে চলেছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘মান্থলি নোটিসেস অফ দ্য রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি’র আগামী সংখ্যায়।
সন্দীপও বলছেন, ‘‘এই প্রথম এত ভারী কোনও ব্ল্যাক হোলকে কোনও গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে এতটা দূরে থাকতে দেখা গেল। ঘটনাটা খুব আচমকাই ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে। কোনও শ্বেত বামন নক্ষত্র হঠাৎ কোনও প্রচণ্ড ভারী ব্ল্যাক হোলের কাছে এসে পড়লে যা হয়।’’
হতে পারে বিশাল কোনও তারার মৃত্যু-দৃশ্যও!
তারার মৃত্যু-দৃশ্য। সুপারনোভা। ছিটকে ছড়িয়ে পড়ছে মৃত তারার দেহাবশেষ
দ্বিতীয় গবেষণাপত্রে মূল গবেষক, ইলিনয়ের নর্থ-ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিজ্ঞানী রাফায়েল্লা মারগুত্তি লিখেছেন, ‘‘এটা আদতে খুব বড় চেহারার কোনও তারার মৃত্যু-দৃশ্য বা সুপারনোভা। অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছে কোনও তারা ওই বিস্ফোরণের (সুপারনোভা) পর তৈরি করে ব্ল্যাক হোল বা খুব বেশি ঘনত্বের নিউট্রন নক্ষত্র। আমরা বোধহয় সুপারনোভার পর ব্ল্যাক হোল বা নিউট্রন নক্ষত্রের জন্ম-প্রক্রিয়াই চাক্ষুষ করেছি।’’
এই গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হবে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘দ্য অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল’-এ।
ছবি ও ভিডিয়ো সৌজন্যে: নাসা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy