Advertisement
১০ মে ২০২৪
Robot

শতবর্ষে যন্ত্রমানব

মানুষ এবং রোবট কোনও দিন এক হবে? বিজ্ঞান মহলের একাংশের আশঙ্কা ভবিষ্যতে রাজত্ব করবে যন্ত্র রোবটেরাই।

সৌভিক চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০২১ ০৪:৫৬
Share: Save:

চেকোস্লোভাকিয়ার প্রাগ শহরে ঐতিহ্যশালী ন্যাশনাল থিয়েটারের বাইরে কৌতূহলী মানুষের ভিড়। দিনটা ২৫ জানুয়ারি, ১৯২১। মঞ্চস্থ হতে চলেছে চেক নাট্যকার ক্যারেল ক্যাপেক-এর নাটক, রসামভি ইউনিভার্সালিনি রোবটি, সংক্ষেপে ‘আরইউআর’। ১৯২০ সালে লেখা এই নাটকের বিষয়বস্তু বেশ অদ্ভুত। একটা কারখানায় কৃত্রিম ভাবে সংশ্লেষিত জৈবরাসায়নিক পদার্থ দিয়ে তৈরি হয় কৃত্রিম মানুষ। এদের নাম রোবটি (ইংরেজিতে রোবট)। কাজ, মানুষের অনুগত হয়ে কায়িক পরিশ্রম। প্রথম দিকে বাধ্য অনুচরের মতো মানুষের সব কথা মেনে চললেও এক সময় এই রোবটরা তাদের মালিকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বিক্ষোভ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর সর্বত্র, এক সময় এর আঁচ এসে পৌঁছোয় রসাম-এর দ্বীপেও। অনায়াসে কারখানার দখল নেয় রোবটরা। চিফ ইঞ্জিনিয়ার বাদে বাকি সব মানুষ খুন হন। নাটকের শেষে দেখা যায়, সম্পূর্ণ ভাবে বিনাশের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে মানুষ, সবুজ গ্রহে রোবটদের রাজত্ব স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।

আরইউআর লেখার ক্ষেত্রে ক্যারেল ক্যাপেক-এর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল, যন্ত্রসভ্যতার মোহে আচ্ছন্ন মানবসভ্যতাকে তার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সাবধান করা। তাঁর রোবটরা আদতে রূপক— বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বেলাগাম উন্নতি কী ভাবে মানুষকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে, তারই প্রতীক। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। বিপুল ক্ষতি এবং মৃত্যুর বিভীষিকাময় স্মৃতি তখনও বিশ্ববাসীর মনে টাটকা। এমতাবস্থায় এমন নৈরাশ্যময় একটা নাটককে দর্শকরা কী ভাবে গ্রহণ করবেন, সে প্রশ্ন ছিলই। কিন্তু সবাইকে আশ্চর্য করল আরইউআর, অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই বিপুল জনপ্রিয়তা পেল। ইংরেজি-সহ বিশ্বের ৩০টি ভাষায় অনূদিত হল। ১৯২২ সালে নিউ ইয়র্কের গ্যারিক থিয়েটারে, ১৯২৩ সালে লন্ডন শহরের সেন্ট মার্টিনস থিয়েটারে প্রিমিয়ার-এর গৌরব অর্জন করল। ক্যাপেক-এর নাম ছড়িয়ে পড়ল ঘরে ঘরে। সাহিত্যের পাতায় এবং নাটকের মঞ্চে রোবটের জনক হিসেবে আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেলেন তিনি।

‘রোবটি’ বা ‘রোবট’— দুটো শব্দেরই উৎপত্তি গ্রিক ‘রোবোটাস’ থেকে, যার অর্থ ‘দাসত্ব’। মানুষের অনুচরবৃত্তি করার জন্য তার হাতে সৃষ্ট যান্ত্রিক দাস— এই হল রোবট। এই প্রসঙ্গ নতুন নয়। ইহুদি উপকথায় আমরা মাটি দিয়ে গড়া মানবাকৃতি মূর্তি ‘গোলেম’-এর বর্ণনা পাই। গ্রিক পুরাণে রয়েছে দানবাকৃতি ব্রোঞ্জের মানুষ ট্যালোস-এর কথা, যার দায়িত্ব ছিল ক্রেট দ্বীপকে বহিরাগত শত্রুর আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত রাখা। তবে ক্যারেল ক্যােপক-এর আরইউআর-ই প্রথম মানুষর মতো দেখতে, মানুষের মতো ভাবনাচিন্তা, এমনকি অনুভূতি প্রকাশেও সক্ষম কৃত্রিম মানুষের কথা বলেছে। আর এখানেই এই নাটক বাকি সবার চেয়ে আলাদা।

আরইউআর নাটকে রোবট সৃষ্টির নেপথ্যে ক্যাপেক-এর উদ্দেশ্য ছিল, যন্ত্রসভ্যতার মোহে আচ্ছন্ন মানুষকে সাবধান করা।

আরইউআর নাটকে রোবট সৃষ্টির নেপথ্যে ক্যাপেক-এর উদ্দেশ্য ছিল, যন্ত্রসভ্যতার মোহে আচ্ছন্ন মানুষকে সাবধান করা।

ক্যাপেক-এর রোবটদের নাম রোবট হল কেন, তা নিয়ে একটা মজার গল্প আছে। আরইউআর নাটক লেখার শুরুর দিকে ক্যাপেক ফ্যাক্টরিতে সৃষ্ট কৃত্রিম মানুষদের নাম দিয়েছিলেন ‘লেবরি’। স্লাভিক ভাষায় ‘লেবরি’ শব্দের অর্থ ক্রীতদাস, কারখানায় কাজ করা শ্রমিক বোঝাতেই এই নাম। কিন্তু ভাই জোসেফের পরামর্শে শেষ পর্যন্ত ‘রোবটি’ শব্দ ব্যবহার করেন ক্যাপেক। বাকিটা ইতিহাস।

আগে কলকব্জা নির্মিত, মানুষের নির্দেশমতো কাজ করতে পারা স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রদের ইংরেজিতে বলা হত ‘অটোমেটন’। ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত অ্যামরোজ় বিয়ার্স-এর ‘মক্সন’স মাস্টার’ ছোটগল্পে এমনই এক বুদ্ধিমান অটোমেটন-এর সঙ্গে পরিচয় হয় আমাদের। এদের কাজ ছিল মানুষের সঙ্গে দাবা খেলা। অন্য দিকে কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দিয়ে গড়া, কৃত্রিম চামড়ায় ঢাকা হুবহু মানুষের মতো দেখতে যন্ত্রদের ডাকা হত ‘অ্যান্ড্রয়েড’ নামে। অগস্টে ভিলিয়ার্স অ্যাডাম-এর টুমরোজ় ইভ (১৮৮৬) উপন্যাসে হ্যাডালি বলে এক যন্ত্রমানবের দেখা আমরা পাই। কিন্তু ক্যাপেক-এর নাটক এসে সব কিছু উলটপালট করে দিল; রাতারাতি প্রায় বাতিলের খাতায় চলে গেল ‘অটোমেটন’ শব্দটা। অন্য দিকে ‘হিউম্যানয়েড’, ‘সাইবর্গ’-এর সঙ্গে সঙ্গে ‘অ্যান্ড্রয়েড’-শব্দটারও স্থান হল ‘রোবট’ নামের বড় ছাতার আশ্রয়ে।

১৯৩০-এর পর থেকে আমেরিকান পাল্প ম্যাগাজিনগুলোয় সায়েন্স ফিকশন সাহিত্যধারার জোয়ার আসে। ক্যাপেক-এর নাটকের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ প্রভাবে জনপ্রিয়তা পায় রোবটের কাহিনিও। রোবট নিরীহ না ক্ষতিকর, শান্ত না হিংস্র— এই নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে দ্বন্দ্ব ছিল যথেষ্ট। জনমতের পাল্লা ভারী ছিল ‘বিপজ্জনক রোবট’ তত্ত্বের দিকেই। মেরি শেলি-র ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন উপন্যাসের নায়ক ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের ক্ষেত্রে যেমনটা হয়েছিল, তাঁর হাতে প্রাণ পাওয়া দানবই তাঁকে ধবংসের দিকে ঠেলে দিয়েছিল, তেমনই মানুষের হাতে সৃষ্ট রোবটরা এক দিন মানবসভ্যতাকে শেষ করে ফেলবে, এমনটাই ধারণা পোষণ করতেন অধিকাংশ মানুষ। পত্রিকার পাতাতেও তাই ভয়ঙ্কর রোবটের গল্পই বেশি ছাপা হত। তবে মুষ্টিমেয় কয়েক জন কল্পবিজ্ঞান লেখক সেই সময়ও স্রোতের বিপরীতে গিয়ে রোবটদের নিয়ে মন ছুঁয়ে যাওয়া গল্প লিখেছেন, যেমন লেস্টার ডেল রে। তাঁর ‘হেলেন ও’ লয়’ গল্প, যেখানে এক মিষ্টি, গৃহকর্মনিপুণা মহিলা রোবটের প্রেমে পড়ে নায়ক, আজও অনেকের মুখে মুখে ফেরে।

১৯৪১ সালে আমেরিকান সায়েন্স ফিকশন লেখক আইজ়্যাক আসিমভ, অ্যাস্টাউন্ডিং পত্রিকার সম্পাদক জন ক্যাম্পবেল-এর সঙ্গে আলোচনা করে রোবটদের আচরণবিধি নিয়ন্ত্রক কাল্পনিক তিনটে সূত্র কল্পনা করেন, যা পরবর্তী কালে ‘থ্রি ল’জ় অব রোবোটিক্স’ নামে খ্যাত হয়। এই তিন সূত্র অনুযায়ী— ১) রোবট কখনও মানুষের ক্ষতি করবে না, অথবা ক্ষতির সম্ভাবনা দেখে নিষ্ক্রিয় থাকবে না, ২) প্রথম সূত্র বিঘ্নিত হচ্ছে না, এমন পরিস্থিতিতে রোবট সব সময় মানুষের সব আদেশ মেনে চলবে, এবং ৩) প্রথম ও দ্বিতীয় সূত্র বিঘ্নিত হচ্ছে না, এমন পরিস্থিতিতে রোবট সব সময় নিজের অস্তিত্ব রক্ষার চেষ্টা করবে। পাশ্চাত্য কল্পবিজ্ঞানের আঙিনায় যুগান্তর এনে দেয় এই তিনটে সূত্র। দানবিক রোবটের বদলে মানবিক রোবটের গল্প লেখার দিকেই মন দিতে শুরু করেন সবাই। আসিমভ-এর রোমাঞ্চকর কেভস অব স্টিল, রে ব্র্যাডবেরি-র আবেগঘন আই সিং দ্য বডি ইলেকট্রিক থেকে শুরু করে ফিলিপ কে ডিক-এর অন্ধকারাচ্ছন্ন ডু অ্যান্ড্রয়েডস ড্রিম অব ইলেকট্রিক শিপ— রোবটদের নবরূপে সামনে আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।

বাংলা সাহিত্যেও বারে বারে এসেছে রোবট। সত্যজিৎ রায়ের শঙ্কু কাহিনিতে একাধিক বার এসেছে তারা— কখনও মজার ছলে (‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’ গল্পের বিধুশেখর), কখনও শুভের প্রতীক হিসেবে (‘প্রোফেসর শঙ্কু ও রোবু’ গল্পের রোবু), কখনও আবার মন্দ অবতারে (‘হিপনোজেন’ গল্পের থর ও ওডিন)। অনীশ দেবের ‘ঝামেলাকে নিয়ে ঝামেলা’ গল্পের ঝামেলা পাঠককে নির্মল আনন্দ দিয়েছে। সিদ্ধার্থ ঘোষের যুধিষ্ঠির-এর গল্প পড়ে আনন্দ পাননি, এমন পাঠকের সংখ্যা হাতেগোনা।

আইজ়্যাক আসিমভ-এর বাইসেন্টিনিয়াল ম্যান উপন্যাসের নায়ক অ্যান্ড্রু রোবট থেকে মানুষ হতে চেয়েছিল। মনুষ্যত্বের সন্ধানে নিজের অমরত্ব বিসর্জন দিতেও পিছপা হয়নি সে। ক্যাপেক-এর আরইউআর নাটকের উপসংহার নতুন করে আশা জাগায় আমাদের মনে, যখন আমরা দেখি প্রেমের মতো মানবিক অনুভূতি স্থান করে নিয়েছে কৃত্রিম মানুষদের মধ্যেও— এতটাই তীব্র সে অনুভূতি যে, রোবট হেলেনা-র জীবন বাঁচাতে নিজেকে উৎসর্গ করতে পিছপা হয় না রোবট প্রাইমাস।

মানুষ এবং রোবট কোনও দিন এক হবে? বিজ্ঞান মহলের একাংশের আশঙ্কা ভবিষ্যতে রাজত্ব করবে যন্ত্র রোবটেরাই। এর বদলে মানুষ কী ভাবে রোবটের সঙ্গে সহাবস্থান করবে, কেউ কারও দাস হয়ে নয়, বন্ধুর মতো মিলেমিশে থাকবে— সে উপায় ভেবে বার করতে হবে মানুষকেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

science Robot
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE