Advertisement
E-Paper

করোনাময়ী ভ্যাকসিন

ভ্যাকসিন ঠিক কী এবং সেটি কী ভাবে কাজ করে, সে সম্পর্কে বেশিরভাগ লোকেরই সম্যক ধারনা নেই৷

দেবদত্ত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০২০ ১৮:৩০
ভ্যাকসিন তৈরি হলে তা কতদিন থাকবে তার ভবিষ্যদ্বাণী করা বস্তুত অসম্ভব৷ ফাইল চিত্র।

ভ্যাকসিন তৈরি হলে তা কতদিন থাকবে তার ভবিষ্যদ্বাণী করা বস্তুত অসম্ভব৷ ফাইল চিত্র।

ঘটনা ১: আমাদের কাজের দিদি সেদিন সকালে প্রশ্ন করলেন, ‘‘আচ্ছা দাদাবাবু, ভ্যাকশিন (তালব্য ‘শ’-ই ছিল) খেলে কি করুণা (করোনা) সেরে যাবে?’’ আমার হতভম্ব দশা দেখে উনি নিশ্চিত হলেন, প্রশ্নের জবাব দেওয়ার মতো জ্ঞানগম্যি দাদাবাবুর নেই৷ উনি দক্ষিণ হস্তে মক্ষিবিতাড়ণ মুদ্রা দেখিয়ে আবার গৃহকর্মে মন দিলেন৷

ঘটনা ২: পদার্থবিদ্যায় গবেষণারত আমার পরম বন্ধু ফোন করে সরাসরিই জানিয়ে দিলেন, ভ্যাকসিন বানানো আমাদের (আমরা যারা ওষুধ কোম্পানিতে কাজ করি) কম্মো নয়৷ কারণ, ক্ষমতা থাকলে এতদিনে আমরা ভ্যাকসিন বাজারে এনে ফেলতাম৷ ওঁর উষ্মার কারণ অনুমান করতে পারি৷ যেখানে আপেল গাছের নীচে বসলেই মাধ্যাকর্ষণ বা বাথটবে স্নান করলেই জলের উচ্চচাপ আবিষ্কার করা যায়, সেখানে ‘সামান্য’ ভ্যাকসিন বানাতে ছ’মাসের বেশি কেন লাগবে?

বর্তমান করোনাপীড়িত বিশ্বে ভ্যাকসিন শব্দটি প্রায় সকলেরই জানা৷ কিন্তু ভ্যাকসিন ঠিক কী এবং সেটি কী ভাবে কাজ করে, সে সম্পর্কে বেশিরভাগ লোকেরই সম্যক ধারনা নেই৷ ফার্মাজগতে বহুদিন কাজ করার সুবাদে এবং একটি ভ্যাকসিনের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে যা জেনেছি, সেটুকুই পেশ করছি৷

ভ্যাকসিন কী এবং কেন?

‘ভ্যাকসিন’ মানে সাধারণ ভাষায় যাকে টিকা বলা হয়, সেটি মূলত রোগের আক্রমণ প্রতিরোধ করতে ব্যবহার করা হয়। রোগ নিরাময়ের জন্য নয়৷ ভ্যাকসিনের সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত৷ ভ্যাকসিন হল আমাদের দেহের সাথে শত্রুর পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পদ্ধতি৷ শরীরের মধ্যে যে জীবাণুর ভ্যাকসিন (বর্তমানে করোনাভাইরাস) সেই জীবাণু বা তার অংশবিশেষ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়৷ প্রশ্ন উঠতেই পারে, ‘‘তাতে তো আরও কেলেঙ্কারি হবে৷ যে রোগ থেকে মুক্তি চাইছি, তাকেই শরীরে ঢোকাব?’’ যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন। আসলে ভ্যাকসিন হিসাবে জীবাণুকে শরীরে ঢোকানোর আগে একটি বাড়তি ধাপ থাকে— জীবাণুটির বংশবৃদ্ধির ক্ষমতা নষ্ট করা৷ ওই অল্পসংখ্যক জীবাণু শরীরের মধ্যে বংশবৃদ্ধি তো করতেই পারবে না। বরং শরীরের অনাক্রম্যতা (ইমিউনিটি) বা রোগ প্রতিরোধ করার সহজাত ক্ষমতা, সেটি ওই জীবাণুটিকে চিনে নিয়ে তার বিরুদ্ধে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে ফেলবে৷

ইমিউনিটি কী ভাবে কাজ করে?

ইমিউনিটির অনেকগুলি ধাপ৷ শরীরে কোনও জীবাণু প্রবেশ করলে শরীর তার বাইরের খোলস দেখে চিনে নিয়ে সেটিকে ধ্বংস করার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে৷ এই যুদ্ধের প্রথম সৈনিক শ্বেতকণিকা৷ জীবাণুটির প্রথম মোলাকাত হয় ডেনড্রাইটিক সেল ও ম্যাক্রোফাজ নামের দু’ধরণের শ্বেতকণিকার সাথে৷ এরা প্রথমে অল্প কিছু জীবাণুকে খেয়ে ফেলে। সেই মৃত জীবাণুদের কিছু অংশ, সাধারণত তাদের খোলসের অংশবিশেষকে নিয়ে নিজেদের কোষপর্দার বাইরে মেলে ধরে৷ শরীরের আরও একধরণের শ্বেতকণিকা (টি হাইপার সেল) এই জীবাণুর অংশটিকে চিনে নেয়৷ পরের ধাপে টি হাইপার সেল আরও দু’ধরণের শ্বেতকণিকা, বি সেল এবং টি সাইটোটক্সিক সেল জানিয়ে দেয়, শরীরে একটি জীবাণু ঢুকেছে আর এই হল তাকে চেনার সংকেত। এরপর বি সেলগুলি ওই জীবাণুকে মারতে অ্যান্টিবডি তৈরি করে৷ সেই অ্যান্টিবডি জীবাণুটিকে চারদিক থেকে বেঁধে মেরে ফেলে৷ আবার কিছু বি সেল ওই সংকেত মনে রাখে। যাতে পরে কখনও ওই একই জীবাণু আক্রমণ করলে চটজলদি অ্যান্টিবডি বানিয়ে ফেলা যায়৷ টি সাইটোটক্সিক সেল অবশ্য এত অ্যান্টিবডির ধার ধারে না৷ তারা ওই সদ্যপরিচিত জীবাণুটি যে দেহকোষকে আক্রমণ করেছে, সেই কোষটিকে জীবাণুশুদ্ধ হজম করে ফেলে৷

ভ্যাকসিন ও ইমিউনিটি

ডেনড্রাইটিক কোষ বা ম্যাক্রোফেজের সাথে জীবাণু বা তার কোনও অংশের পরিচয় করিয়ে দিতে পারলে সেই জীবাণুর আক্রমণ প্রতিরোধ করা সম্ভব৷ ভ্যাকসিন সেই কাজটাই করে৷ ভ্যাকসিন হিসাবে আমাদের শরীরে মৃত জীবাণু বা তার অংশবিশেষ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়৷ জীবাণুর বাইরের খোলসটিই তার মূল পরিচয় হওয়ায় ওই খোলস বা তার অংশ— এমন কোনও প্রোটিনকে শরীরে ঢোকানো হয়৷ করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও মৃত বা বংশবৃদ্ধির ক্ষমতাহীন ভাইরাসটিকে ভ্যাকসিন হিসাবে ভাবা হয়েছে৷ তাছাড়া এর খোলসের কাঁটার মত দেখতে স্পাইক প্রোটিনটিকেও ব্যবহার করা হচ্ছে৷

করোনার ভ্যাকসিন

১. ভাইরাস ভ্যাকসিন: এ ক্ষেত্রে আস্ত ভাইরাসটিকেই শরীরে ঢোকানো হয়৷ কিন্তু তার আগে হয় তার জিনগত পরিবর্তন করে তার রোগ তৈরির ক্ষমতা নষ্ট করে দেওয়া হয় অথবা রাসায়নিকের সাহায্যে ভাইরাসটি নিষ্ক্রিয় করা হয়৷ আমেরিকার কোডোজেনিক্স ও ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া প্রথম পথে এগোচ্ছে৷ চীনের সাইনোভ্যাক এবং ভারত বায়োটেক দ্বিতীয় রাস্তায়৷

২. ভাইরাল-বাহক ভ্যাকসিন: এই পদ্ধতিতে প্রথমে অন্য একটি রোগের (সাধারণত হাম) ভাইরাসকে বেছে নিয়ে তার জিনের মধ্যে করোনা ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের জিন ঢুকিয়ে দেওয়া হয়৷ সবশেষে এই দু’ধরনের জিনওয়ালা ভাইরাসটিকে নিষ্ক্রিয় করা হয়। যাতে সে মানবশরীরে হাম না তৈরি করে৷ এই ভাইরাসটিকে শরীরে ঢোকালে সে তার মতো বংশবৃদ্ধি করে এবং পাশাপাশি ওই স্পাইক প্রোটিনকেও তৈরি করে৷ শরীর যখনই চিনতে পারে যে, স্পাইক প্রোটিনটি মানবশরীরের অংশ নয়, তখনই তার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করে৷

৩. নিউক্লিক অ্যাসিড ভ্যাকসিন: শরীরে প্রোটিন তৈরি হয় জিন থেকে। এই ভ্যাকসিন তৈরিতে স্পাইক প্রোটিনের জন্য দায়ী জিনটিকে শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়৷ শরীরের কোষের মধ্যে ঢুকে জিনটি স্পাইক প্রোটিন তৈরি করতে থাকে৷ তারপর শরীর সেই স্পাইক প্রোটিনটিকে চিনে ফেলে যা করণীয় করে। জাইডাস ক্যাডিলা এই পথেরই পথিক৷

৪. প্রোটিন ভ্যাকসিন: আগের পদ্ধতিতে যে জিন ঢোকানোর কথা বলা হয়েছে, সেই জিনটি স্পাইক প্রোটিনটি তৈরি করবে৷ স্পাইক প্রোটিনটিকে আলাদা করে বানিয়ে ইঞ্জেকশন দিয়ে সরাসরি শরীরে ঢুকিয়ে দিলেও হয়। শরীর তার মোকাবিলায় অ্যান্টিবডি তৈরি করে। হায়দরাবাদের বায়োলজিক্যাল ই এই রাস্তাতেই হাঁটছে৷

ভ্যাকসিন তৈরির বিভিন্ন ধাপ

১. ভাইরাস বা যে জীবাণুর জন্য ভ্যাকসিন ভাবা হচ্ছে, সেই জীবাণুর কোন প্রোটিনটি বাছলে সবথেকে কার্যকর হবে, সে বিষয়ে বিস্তর গবেষণা করতে হয়৷ ভুলবশত এমন কোনও প্রোটিন বাছা হলে, যার যমজ ভাইবোন শরীরে আছে, তাহলে সেই প্রোটিনটিকে শরীর বিদেশি বলে চিনতে পারবে না৷ ফলে অ্যান্টিবডিও তৈরি হবে না৷ করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন আর এম প্রোটিনকে ইতিমধ্যেই কার্যকরী বলে চিহ্নিত করা গিয়েছে৷

২. ভ্যাকসিনটি ইঁদুর বা বাঁদরের শরীরে ঢুকিয়ে দেখা হয় অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে কিনা৷ এদের দেহে কোনও ক্ষতিকর উপসর্গ দেখা যাচ্ছে কিনা৷ সেগুলি প্রি-ক্লিনিক্যাল স্টেজ৷

৩. প্রথম দু’ ধাপে সাফল্য এলে সরকারের অনুমতি নিয়ে মানুষের ওপর পরীক্ষা শুরু হয়৷ যাকে পরিভাষায় বলে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল৷ এর প্রথম পর্যায়ে অল্প মানুষের দেহে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে তাদের কঠোর তত্বাবধানে রাখা হয় ভ্যাকসিনটির কোনও আপাত ক্ষতিকর উপসর্গ আছে কিনা দেখতে৷ দ্বিতীয় পর্যায়ে কয়েকশো স্বেচ্ছাসেবকের শরীরে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে দেখা হয় অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে কি না। হলে তা কতদিন থাকছে৷ তৃতীয় ধাপে আরও বেশি মানুষের শরীরে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে দেখা হয়, কত শতাংশের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে। হতে কতদিন লাগছে। তাঁদের মধ্যে এমন কোনও গোষ্ঠী আছে কি না যাদের দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে না ইত্যাদি৷


অনেকগুলি ধাপ পেরিয়ে তবে ভ্যাকসিন তৈরি হয়। ছবি: এএফপি।

ভ্যাকসিন আসতে দেরি হচ্ছে কেন?

ভ্যাকসিন তৈরি করতে অনেক ধাপ পেরোতে হয়! শুরুতে ধারণাই থাকে না যে, কোন প্রোটিনটি সব থেকে সহজে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারবে৷ অনেক সময় দেখা যায়, যে ভ্যাকসিনটি ইঁদুরের উপর কাজ করল না৷ তখন আবার গোড়া থেকে কাজ শুরু করতে হয়৷ তৃতীয়ত, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা সময়সাপেক্ষ৷ চতুর্থত, মানবশরীরে ভ্যাকসিন তৈরি হলে তা কতদিন থাকবে তার ভবিষ্যদ্বাণী করা বস্তুত অসম্ভব৷ কোনও অ্যান্টিবডি শরীরে দু’মাস থাকলে প্রতি দু’মাস অন্তর ইঞ্জেকশন নিতে হবে৷

কোন ভ্যাকসিন এখন কোন পর্যায়ে?

আপাতত ৩৮টি ভ্যাকসিন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পর্যায়ে আছে৷ এদের মধ্যে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ক্যানসিনো বায়োলজিক্যাল, জ্যানসেন, সাইনোভ্যাক, মডার্না প্রভৃতি কয়েকটি সংস্থা তৃতীয় পর্যায়ে আছে৷ ভারতীয় সংস্থাগুলির মধ্যে জাইডাস ক্যাডিলা ও ভারত বায়োটেক দ্বিতীয় পর্যায়ে আছে৷ আরও ১৪৯টি ভ্যাকসিন প্রি-ক্লিনিক্যাল পর্যায়ে আছে৷

(লেখক অ্যাক্টিং হেড, সেল অ্যান্ড মলিকিউলার বায়োলজি ডিপার্টমেন্ট এবং সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার, জাইডাস রিসার্চ সেন্টার, আমদাবাদ।)

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

Coronavirus Vaccine Covid-19
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy