Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Science News

দিল্লির কুয়াশাই দক্ষিণ এশিয়ার উষ্ণায়নের কারণ, জানাল গবেষণা

ওই গবেষণা বলছে, স্থলভাগের উপর থেকে সমুদ্রের দিকে উড়ে যেতে যেতে কুয়াশার মধ্যে থাকা সাবানের ফেনার মতো জলকণাগুলির জাত বদলে যাচ্ছে। তাদের গায়ে লেগে থাকা কার্বন কণাদের গায়ের রং বদলে যাওয়ার জন্য।

দিল্লির কুয়াশা। ছবি- রয়টার্স।

দিল্লির কুয়াশা। ছবি- রয়টার্স।

সুজয় চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১২:১৩
Share: Save:

দিল্লির কুয়াশার ধাক্কায় ‘প্রাণ যায় যায়’ অবস্থা হয়েছে বাংলাদেশের ভোলার। উষ্ণায়নে হাঁসফাঁস করছে মলদ্বীপের হানিমাধু। দিল্লি-সহ উত্তর-পশ্চিম ভারতের সর্বনাশা কুয়াশা আক্ষরিক অর্থেই, দক্ষিণ এশিয়ার আবহাওয়া, জলবায়ুর পক্ষে অভিশাপ হয়ে উঠেছে। বিষিয়ে দিচ্ছে গোটা দক্ষিণ এশিয়ার বাতাস। প্রকৃতি ও পরিবেশ। উৎসাহ দিচ্ছে উষ্ণায়নে। গা আরও গরম করে দিচ্ছে বাংলাদেশ, মলদ্বীপ, মায়ানমার-সহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির।

উড়তে উড়তে গায়ের রং বদলে যাচ্ছে বাতাসের কার্বন কণাদের!

এমনটাই বলছে হালের একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা। ওই গবেষণা বলছে, স্থলভাগের উপর থেকে সমুদ্রের দিকে উড়ে যেতে যেতে কুয়াশার মধ্যে থাকা সাবানের ফেনার মতো জলকণাগুলির জাত বদলে যাচ্ছে। তাদের গায়ে লেগে থাকা কার্বন কণাদের গায়ের রং বদলে যাওয়ার জন্য। তাদের সূর্যালোক শুষে নেওয়ার ক্ষমতার বাড়া-কমায়। কুয়াশায় থাকা কার্বন কণাগুলি কালো থেকে হয়ে পড়ছে বাদামি। গবেষণাপত্রটি বেরিয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘সায়েন্স অ্যাডভান্সেস’-এর ৩১ জানুয়ারি সংখ্যায়।

আরও পড়ুন- ৮০ বছরে গলে যাবে হিমালয়ের অর্ধেক বরফ! শুকিয়ে যাবে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র!

কুয়াশার মধ্যে থাকা ওই কার্বন কণারা সূর্যালোকের সাতটি রংকেই প্রায় পুরোপুরি শুষে নিতে পারে বলে তাদের কালো দেখায়। কিন্তু দিল্লি ও উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে স্থলভাগের উপর দিয়ে সমুদ্রকে লক্ষ্য করে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলির দিকে উড়ে যেতে যেতে কুয়াশার মধ্যে থাকা সেই কার্বন কণাদের আলো শুষে নেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। ফলে, তাদের গায়ের রং আর কালো থাকে না। হয়ে পড়ে বাদামি।

আয়ু বেড়ে যাচ্ছে ৩ থেকে ৫ গুণ!

সাম্প্রতিক গবেষণা জানাল, আলো শুষে নেওয়ার ক্ষমতা কমে গেলেও কুয়াশায় থাকা ওই কার্বন কণারা আরও বেশি দিনের আয়ু পেয়ে যায় সমুদ্রের উপর দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলির দিকে যেতে যেতে। যার অর্থ, ওই বাদামি রঙের কার্বন কণাগুলির যতটা আয়ু (আরও সঠিক ভাবে বললে, অর্ধায়ু বা হাফ-লাইফ) হয় দিল্লি-সহ উত্তর-পশ্চিম ভারতে (৩.৬ দিন), দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলিতে তার আয়ু বেড়ে যায় অন্তত তিন থেকে পাঁচ গুণ (৯ থেকে ১৫ দিন)। ফলে, কুয়াশায় থাকা বাদামি রঙের কার্বন কণাগুলি আরও বেশি দিন থাকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে। গবেষকরা দেখেছেন, এটাই ওই অঞ্চলে উষ্ণায়নকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

আলোকপাত অ্যাটমস্ফেরিক ব্রাউন ক্লাউডে

কুয়াশাকে আবহবিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয়, ‘অ্যাটমস্ফেরিক ব্রাউন ক্লাউড’ (এবিসি)। যানবাহনের ধোঁয়া, জীবাশ্ম জ্বালানি ও অন্যান্য উৎস থেকে যে বিষাক্ত কার্বন মৌল ও যৌগের কণা বেরিয়ে আসে তারাই মূলত থাকে এবিসি-তে। বায়ুমণ্ডলের একটি বিশেষ স্তরে থাকে ওই কার্বন কণারা। যারা সূর্যালোকের সাতটি রঙের বেশির ভাগটাই শুষে নেয়। ব্লটিং পেপারের মতো। বিচ্ছুরণও (স্ক্যাটারিং) করে, তবে তা খুবই সামান্য পরিমাণে।

মূল ‘চক্রী’ ডিজেল থেকে আসা কার্বন কণারা

ওই আন্তর্জাতিক গবেষকদলের অন্যতম সদস্য বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সের অধ্যাপক শ্রীধরন সতীশ আনন্দবাজার ডিজিটালকে জানিয়েছেন, কুয়াশার সময় বাতাসে ‘অ্যাটমস্ফেরিক ব্রাউন ক্লাউড’-এ থাকা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণাদের মধ্যে মূলত আলো শুষে নেয় দু’ধরনের কার্বন কণা। এক ধরনের কার্বন কণার গায়ের রং হয় কালো। অন্য ধরনের কার্বন কণার গায়ের রং হয় বাদামি। কালো রঙের কার্বন কণাগুলি আসে মূলত ডিজেলে চলা যানবাহন বা যন্ত্রাদি থেকে। আর বাদামি রঙের কার্বন কণাগুলি আসে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর জন্য।

আরও পড়ুন- বিশ্বের তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি বেড়েছে শুধু ২০১৮তেই, এ বছরেও দারুণ গরম, জানাল নাসা​

গবেষকরা কাজ করেছেন বাদামি রঙের কার্বন কণাদের নিয়ে। তাঁরা দেখতে চেয়েছিলেন, সমুদ্রের উপর দিয়ে উড়ে যেতে যেতে সূর্যালোক শুষে নেওয়ার ক্ষমতা তাদের বাড়ে-কমে কি না। দেখতে চেয়েছিলেন, সেই বাড়া-কমাটা হয় কতটা।

দিল্লি, ভোলা আর হানিমাধু

শ্রীধরন জানিয়েছেন, তাঁরা তিনটি জায়গা- গাঙ্গেয় সমতলে (ইন্দো-গ্যাঞ্জেটিক প্লেন বা, আইজিপি) থাকা দিল্লি, দক্ষিণ বাংলাদেশের ভোলা (যা আইজিপি-র কিনারে পড়ে) এবং মলদ্বীপের হানিমাধুতে ক্লাইমেট অবজারভেটির বাতাসের নমুনা পরীক্ষা করেছিলেন। দিল্লি-সহ উত্তর-পশ্চিম ভারতের কুয়াশার মধ্যে থাকা কার্বন কণাগুলি সমুদ্রের উপর দিয়ে উড়ে গিয়ে পৌঁছয় ভোলা, হানিমাধু আর তার আশপাশের এলাকায়। তাঁরা দেখেছেন, দিল্লি থেকে ভোলা আর হানিমাধু যাওয়ার পথে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কুয়াশায় থাকা সাবানের মতো জলকণাগুলির (অ্যারোসল) রাসায়নিক গঠন পুরোপুরি বদলে যায়। বদলে যায় তাদের চরিত্র। আচার, আচরণ। বাদামি রঙের কার্বন কণাগুলি কুয়াশার জলকণায় দ্রবীভূত হয়ে যায়। আর সেটা সবচেয়ে বেশি পরিমাণে থাকে দিল্লির কুয়াশায়। সমুদ্রের উপর দিয়ে উড়ে তা বাংলাদেশের ভোলায় পৌঁছলে সেই বাদামি রঙের কার্বন কণার সংখ্যা কমে যায় কুয়াশায়। তা সবচেয়ে কমে যায় মলদ্বীপের হানিমাধুতে। সেই কার্বন কণাগুলির সূর্যালোক শোষণের ক্ষমতাও উত্তরোত্তর কমে যায় দিল্লি থেকে ভোলা হয়ে হানিমাধুতে পৌঁছে গিয়ে।

মরসুমের রদবদলেও এর ভূমিকা আছে কি?

গবেষকরা জানিয়েছেন, তাঁরা শুধু শীতের আবহাওয়া ধরেই করেছেন কাজটা। তাঁরা দেখতে চাইছেন বাতাসে থাকা ওই কার্বন কণাদের সূর্যোলোক শুষে নেওয়ার ক্ষমতার তারতম্যে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষার মতো মরসুমগুলি কতটা বদলাচ্ছে বা তাদের মেয়াদ কতটা বাড়ছে বা কমছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE