Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
Science News

৮০ বছরে গলে যাবে হিমালয়ের অর্ধেক বরফ! শুকিয়ে যাবে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র!

সেটাই হিমালয়ে এত দ্রুত হারে হচ্ছে যে আর ৮০ বছরের মধ্যেই তার এক-তৃতীয়াংশ বরফ পুরোপুরি গলে যাবে।

হিমালয়। -ফাইল ছবি।

হিমালয়। -ফাইল ছবি।

সুজয় চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১৩:৪৫
Share: Save:

খুব দ্রুত বরফ গলে যাচ্ছে হিন্দুকুশ হিমালয়ের পাহাড়, পর্বতে। দ্রুত গলে যাচ্ছে সেখানকার বড় বড় হিমবাহগুলি (গ্লেসিয়ার)। গলছে এভারেস্ট, কারাকোরামের মতো পৃথিবীর দু’টি সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গও। আন্টার্কটিকা ও আর্কটিকের (সুমেরু ও কুমেরু) পর হিন্দুকুশ হিমালয়কেই বলা হয় পৃথিবীর ‘তৃতীয় মেরু’।

হিমালয়ে সেটাই এত দ্রুত হারে হচ্ছে যে আর ৮০ বছরের মধ্যেই তার এক-তৃতীয়াংশ বরফ পুরোপুরি গলে যাবে। আর বিশ্ব উষ্ণায়নের তাপমাত্রার বাড়-বৃদ্ধি যদি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে আটকে রাখা যায়, তা হলেও অর্ধেক বরফই গলে যাবে হিন্দুকুশ পর্বতমালার। উষ্ণায়নের তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লেই গলে যাবে দুই-তৃতীয়াংশ বরফ।

আর ৪০ বছরেই ভেসে যাবে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেকংয়ের অববাহিকা

তার ফলে, ওই অঞ্চলে গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, মেকং-সহ প্রধান যে ১০টি নদী রয়েছে, পুরোপুরি ভেসে যাবে তাদের অববাহিকাগুলি। আর ৪০ বছরের মধ্যেই। তার ফলে, বিপন্ন হয়ে পড়বেন ভারত, পাকিস্তান, চিন, আফগানিস্তান, নেপাল, ভূটান-সহ ৮টি দেশের প্রায় ২০০ কোটি মানুষ। তার পর সেই হিমবাহগুলির বরফ শেষ হয়ে গিয়ে সেগুলি রুখুসুখু পাথর হয়ে যাবে। ফলে, সেই সব উৎস থেকে বেরিয়ে আসা নদীগুলি পুরোপুরি শুকিয়ে যাবে।

ভয়াবহ এই রিপোর্ট দিয়েছে আন্তর্জাতিক পর্বত গবেষণা সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড মাউন্টেন ডেভেলপমেন্ট’ (আইসিআইএমওডি)। সোমবার। এই প্রথম তৃতীয় মেরুর বরফ গলার হারের উপর চালানো হল গবেষণা। টানা ৫ বছর ধরে যে গবেষণার সঙ্গে জড়িত ছিলেন বিভিন্ন দেশের ২০০-রও বেশি বিজ্ঞানী। তাঁদের গবেষণা খতিয়ে দেখেছেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ৩৫০ জন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী।

বিজ্ঞানের নানা জানা, অজানা বিস্ময় নিয়ে কুইজে অংশ নিন

ভয়ঙ্কর বিপদে পড়বে ভারত-সহ ৮টি দেশ!

উষ্ণায়নের খুব বড় প্রভাব পড়েছে হিন্দুকুশ হিমালয়ে। প্রায় সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটারের (২ হাজার ১৭৫ মাইল) ওই সুবিশাল পার্বত্য এলাকার মধ্যে পড়ে যাচ্ছে মোট ৮টি দেশ। ভারত, পাকিস্তান, চিন, নেপাল, ভূটান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও মায়ানমারের বড় একটি অংশ। যেখানে গঙ্গা, সিন্ধু, ব্রহ্মপুত্র, মেকং, আমু দরিয়া, তারিম, ইরাওয়াড়ি, সালউইন, ইয়েলো ও ইয়াংঝের মতো রয়েছে ১০টি প্রধান নদী।

আরও পড়ুন- ৮.৫ তীব্রতার ভূমিকম্পে টালমাটাল হবে হিমালয়! মহাপ্রলয়ের সতর্কবার্তা বিজ্ঞানীদের​

আরও পড়ুন- অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলে ফের হবে মহাপ্লাবন! হুঁশিয়ারি বিজ্ঞানীদের​

আইসিআইএমওডি-র ডেপুটি ডিরেক্টর একলব্য শর্মার কথায়, ‘‘আমরা হিসেব কষে দেখেছি, উষ্ণায়নের ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা যদি আরও ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়ে, তা হলে শুধুই হিন্দুকুশ হিমালয়ের তাপমাত্রা বাড়বে ০.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর তাতে উত্তর-পশ্চিম হিমালয় আর কারকোরাম পর্বতমালার তাপমাত্রা বাড়বে ০.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।’’

আইসিআইএমওডি-র হালের রিপোর্ট জানাচ্ছে, হিন্দুকুশ হিমালয়ে হিমবাহ থেকে জন্মানো হ্রদের সংখ্যা এখনও পর্যন্ত ৮ হাজার ৭৯০টি। তার মধ্যে বরফ দ্রুত গলে যাওয়ার ফলে ২০৩টি হ্রদই ভয়াল বন্যা সৃষ্টি করতে পারে।

পৃথিবীর তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি বাড়লে গলে যাবে দুই-তৃতীয়াংশ বরফ!

পুণের ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর আন্টার্কটিক অ্যান্ড ওশ্‌ন রিসার্চ সেন্টার’ (এনসিএওআর)-এর অধিকর্তা বিশিষ্ট হিমবাহ বিশেষজ্ঞ এম রবিচন্দ্রন জানাচ্ছেন, ১৯৭০ সাল থেকে উষ্ণায়নের খুব বড় প্রভাব পড়েছে হিন্দুকুশ হিমালয়ে। তার ফলে, সর্বোচ্চ শৃঙ্গগুলি-সহ গোটা হিন্দুকুশ হিমালয়ের বরফ যে ভাবে গলছে, যে হারে গলছে, তাতে উষ্ণায়নের তাপমাত্রাকে যদি শতাব্দীর শেষে পৌঁছে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ২.৭ ডিগ্রি ফারনেহাইটের মধ্যে ধরে রাখা সম্ভব হয়, তা হলেও তা হলেও হিমালয়ের বরফ গলার রথের চাকায় রশি পরানো যাবে না। আর ৮০ বছর পর হিমালয়ের এক-তৃতীয়াংশ বরফের পুরোটাই গলে যাবে। আর সেই তাপমাত্রার বাড়-বৃদ্ধি যদি হয় ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৩.৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট, তা হলে গলে যাবে হিমালয়ের অর্ধেক বরফ। ৪ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৭ থেকে ৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট বাড়লে গলে যাবে দুই-তৃতীয়াংশ বরফ।

কী ভাবে গলছে হিমালয়, কেন গলছে? দেখুন ভিডিয়ো

রবিচন্দ্রনের কথায়, ‘‘শুধু হিন্দুকুশের পাহাড়, পর্বতেই থাকেন প্রায় ২৪ কোটি মানুষ। আর ওই অঞ্চলের ১০টি প্রধান নদীর জলের উপর নির্ভর করে আছেন প্রায় ২০০ কোটি মানুষ। জড়িয়ে রয়েছে ভারত, চিন, পাকিস্তান, আফগানিস্তান-সহ ৮টি দেশের অর্থনীতি, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন, কৃষিকাজ, সেচ ও শস্য সংরক্ষণের অত্যন্ত জরুরি ক্ষেত্রগুলি।’’

২০৬০ সাল নাগাদ ভয়াল বন্যা হবে বার বার

রবিচন্দ্রন এও জানিয়েছেন, ১৯৭০ সাল থেকে গত ৫০ বছরে ইতিমধ্যেই হিন্দুকুশ হিমালয়ের ১৫ শতাংশ বরফ গলে জল হয়ে গিয়েছে। এর ফলে, ২০৬০ সাল নাগাদ পরিস্থিতিটা এমন হবে যখন বার বার ভয়াবহ বন্যা হবে ওই এলাকা ও সেখান থেকে বেরিয়ে আসা নদীগুলির অববাহিকা অঞ্চলে।

পরিসংখ্যান বলছে, ১৯০০ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত হিন্দুকুশ হিমালয়ের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে, সেখানকার বরফ দ্রুত গলতে শুরু করেছিল। তার পর ১৯৪০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত, ৩০ বছরে আবার ঠান্ডা হতে শুরু করে হিমালয়। পরে উষ্ণায়নের দৌলতে ১৯৭০ সাল থেকে ফের দ্রুত হারে বরফ গলতে শুরু করেছে হিন্দুকুশ হিমালয়ে।

ঠান্ডার রাত, দিনের সংখ্যা দ্রুত কমছে হিন্দুকুশ হিমালয়ে

একলব্য বলছেন, ‘‘আগের চেয়ে ঠান্ডার পরিমাণ অনেকটাই কমে গিয়েছে হিন্দুকুশ হিমালয়ে। হিসেব কষে দেখেছি প্রতি এক দশকে একটা ঠান্ডার রাত আর অর্ধেক ঠান্ডা দিন কমছে হিন্দুকুশ হিমালয়ে। অন্য দিকে ওই অঞ্চলে প্রতি এক দশকে গড়ে গরম রাতের সংখ্যা বেড়েছে ১.৭টি। আর গরম দিন বেড়েছে ১.২টি।’’

বদলে যাবে জীববৈচিত্র্যও!

একলব্য এও জানিয়েছেন, হিমালয়ের বরফ দ্রুত গলে যাওয়ার ফলে আর ৪০ বছরের মধ্যে বার বার ভয়াল বন্যা হবে ঠিকই। তবে সেই বন্যাও কমে যাবে জলের জোগান কমে যাওয়ায়, এই শতাব্দীর শেষে পৌঁছে। ২০৮০ সালের পর হিন্দুকুশ হিমালয়ের প্রধান নদীগুলির বেশির ভাগই যাবে শুকিয়ে। তাদের উৎস হিমবাহগুলি জলহীন শুকনো পাথরে পরিণত হবে বলে। তার ফলে, কৃষিকাজ, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন, সেচ বেহাল হয়ে পড়বে। যা বিপন্ন করে তুলবে ভারত-সহ এই অঞ্চলের ৮টি দেশের অর্থনীতি। খুব ক্ষতি হবে জীববৈচিত্র্যেরও (বায়োডাইভার্সিটি)।

রবিচন্দ্রন অবশ্য এ কথা মানতে রাজি নন। তাঁর বক্তব্য, নদীর জল তার গতিপথে আরও অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে। তার মধ্যে রয়েছে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ। তা ছাড়াও ওই নদীগুলি শুকিয়ে গেলে আশপাশের এলাকায় নদীর অন্যান্য উৎসেরও জন্ম হওয়াটা অসম্ভব নয়।

আরও একটি আশার কথাও শুনিয়েছেন রামচন্দ্রন। বলেছেন, ‘‘এও দেখা গিয়েছে, হিন্দুকুশ হিমালয়ে মরসুমও দীর্ঘায়িত হয়েছে গত ৫০ বছরে। এক দশকে কোনও মরসুমের আয়ু বেড়েছে সেখানে গড়ে ৪.২৫ দিন। এতে চাষবাসের জন্য বাড়তি সময় মিলবে।’’

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

গ্রাফিক তথ্যসূত্র: ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড মাউন্টেন ডেভেলপমেন্ট

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE