Advertisement
০৪ মে ২০২৪

নদীর দু’পারে দাপাল দাঁতাল, ঢল মানুষের

কখনও পাটখেত, মাঠ আবার কখনও নদী পেরিয়ে রেললাইন, বাজারে দিনভর দাপিয়ে বেড়াল দলছুট দাঁতালটি। আর মেঘলা দিনের খিচুড়ি-ডিমভাজা সরিয়ে হাতিদর্শনে ছুটলেন গ্রামবাসী, বনকর্মী, পুলিশ থেকে ভিন জেলার হুলাপার্টিও। রবিবার রাতেই বাঁকুড়া, আউশগ্রাম, কাটোয়া হয়ে পূর্বস্থলী ঢুকে পড়েছিল হাতিটি। তারপর এ গ্রামে উঁকি দিয়ে, ও গ্রামের ধানের বস্তা টেনে সন্ধ্যায় আশ্রয় নিয়েছিল ফলেয়া গ্রামের বাঁশবাগানে।

বাঁ দিকে, হাতির পিছু পিছু চলেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ডান দিকে, দাঁতালটিকে খেদাতে হুলা পার্টির তো়ড়জোড়। নিজস্ব চিত্র।

বাঁ দিকে, হাতির পিছু পিছু চলেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ডান দিকে, দাঁতালটিকে খেদাতে হুলা পার্টির তো়ড়জোড়। নিজস্ব চিত্র।

কেদারনাথ ভট্টাচার্য
পূর্বস্থলী শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০১৫ ০১:২৬
Share: Save:

কখনও পাটখেত, মাঠ আবার কখনও নদী পেরিয়ে রেললাইন, বাজারে দিনভর দাপিয়ে বেড়াল দলছুট দাঁতালটি। আর মেঘলা দিনের খিচুড়ি-ডিমভাজা সরিয়ে হাতিদর্শনে ছুটলেন গ্রামবাসী, বনকর্মী, পুলিশ থেকে ভিন জেলার হুলাপার্টিও।
রবিবার রাতেই বাঁকুড়া, আউশগ্রাম, কাটোয়া হয়ে পূর্বস্থলী ঢুকে পড়েছিল হাতিটি। তারপর এ গ্রামে উঁকি দিয়ে, ও গ্রামের ধানের বস্তা টেনে সন্ধ্যায় আশ্রয় নিয়েছিল ফলেয়া গ্রামের বাঁশবাগানে। তবে রাত পেরোতেই আশ্রয়ও ত্যাগ করে সে। দুলকি চালে হেঁটে পৌঁছে যায় প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরের কোমলনগর গ্রামে। পথে কয়েকটি কলাবাগান তছনছ করা ছা়ড়া বিশেষ কিছু অবশ্য করেনি দাঁতালটি। তারপর সারাদিনই ওই তল্লাটেই ঘোরাফেরা করে। বনকর্মীরা অবশ্য বারবারই নানা ভাবে তাকে ফেরানোর চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু হাতি নট নড়ন-চড়ন। মঙ্গলবার সকালে অবশ্য নিজে থেকেই যাত্রা শুরু করে হাতিটি। থামে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরের রাজারচর এলাকায়। ততক্ষণে ফের হাতিটিকে খুঁজতে লেগে পড়েছেন বনকর্মীরা।
এ দিকে, সাতসকালে আচমকা দাঁতালটিকে দেখে ভয় পেয়ে যান এলাকার অনেকেই। বড় ধরণের দুর্ঘটনা না ঘটলেও হাতির পায়ের আঘাতে অল্পবিস্তুর আহত হন কালনার ফটিক শেখ নামে এক যুবক। ফটিক জানান, দাঁতালটি দেখে পড়িমরি করে পালাতে গিয়ে জমিতে পড়ে যান তিনি। তখনই হাতির পায়ে আঘাত লাগে তাঁর। হাতি অবশ্য ফটিককে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে পা বাড়ায়। কিন্তু হাতির ভয়ে বমি শুরু হয়ে যায় ফটিকের। পূর্বস্থলী ২ ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তিও করানো হয় তাঁকে। এরপরে রাজারচর এলাকার ঘন পাট খেত ধরে চলতে শুরু করে হাতিটি। হাতির পায়ের চাপে, বহু পাটগাছ নষ্ট হয়ে যায় বলেও চাষিদের দাবি। স্থানীয় এক চাষি, অজিত ঘোষ বলেন, ‘‘আচমকা হাতি দেখে ভিমরি খেয়ে গিয়েছিলাম। কোনও রকমে নিজেকে সামাল দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে পালাই। ভাগ্যিস হাতিটি তাড়া করেনি।’’

এরমধ্যেই হাতির যত্রতত্র বিচরণের খবর পৌঁছয় পূর্বস্থলী উত্তর কেন্দ্রের বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। সকাল সাড়ে ৯টা নাগাদ কয়েকজন অনুগামীকে সঙ্গে নিয়ে এলাকায় হাজির হয়ে যান তিনি। হস্তিদর্শন করতে গ্রামবাসীদের সঙ্গে দাঁতালের পিছুও নেন বিধায়ক। পথে টেলিফোনে ক্রমাগত বন দফতরের কর্তাদের সঙ্গে কথা চলতে থাকে তাঁর। হাতির পিছু পিছু কয়েক কিলোমিটার ভেজা পাট খেত পেরিয়ে তপনবাবু সদলবলে পৌঁছে যান নদিয়ার নিদয়া গ্রামে। হাতি ততক্ষণে নদী পেরিয়ে ও পারে। এরপরেই বন দফতরকে কুনকি হাতি এনে দলছুট দাঁতালটিকে নিয়ে যেতে বলেন বিধায়ক। তবে বন দফতরের এক আধিকারিক জানান, জেলায় কুনকি হাতি নেই। উত্তরবঙ্গে খোঁজখবর চলছে। পরে বনমন্ত্রীও দ্রুত এলাকা থেকে দলছুট হাতিটিকে ফিরিয়ে আনার আশ্বাস দেন বলে বিধায়কের দাবি।

এরমধ্যেই হাতি খেদাতে বেলা সাড়ে এগারোটা নাগাদ রাজারচর এলাকায় এসে পৌঁছয় বাঁকুড়ার দুটি হুলা পার্টি। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন গুসকরার রেঞ্জ অফিসার অমিয়বিকাশ পাল। হুলা পার্টির লোকজনেরা যখন মশাল তৈরি, হ্যান্ড মাইক সেট করে অভিযানের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন আচমকা খবর আসে দাঁতালটি নদী পেরিয়ে পৌঁছে গিয়েছে নদিয়ার প্রতাপনগর হাসপাতালের আশপাশে। হুলা পার্টি চলে নদিয়া। অমিয়বাবু জানান, মাস তিনেক ধরে বর্ধমানের বিভিন্ন জঙ্গলে ঘুরছে হাতিটি। এর আগেও একে ফেরানোর বারবার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে হাতিটি ফিরতে চায়নি। তবে এ বার হাতিটি যে পূর্বস্থলী পর্যন্ত এসে যাবে তা ভাবা যায়নি।

বেলা দুটো নাগাদ নবদ্বীপ হয়ে দাঁতালটি ফের পূর্বস্থলীতে ঢুকে পড়ে। এ বার ঢোকে শ্রীরামপুর এলাকায়। তবে জনবহুল এলাকায় যাতে হাতিটি না ঢুকে পড়ে তাই হুলা পার্টির লোকেরা পটকা ফাটিয়ে, আগুন থুঁড়তে শুরু করেন। সঙ্গে টানা বাজতে থাকে মাইক। শব্দেই বোধহয় পথ বদলায় হাতিটি। রেললাইন ধরে পৌঁছে যায় নদিয়ার কালীনগর গ্রামে। তবে বন দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, সন্ধ্যা নামার আগে দাঁতালটি পূর্বস্থলী ১ ব্লকের নাদনঘাট এলাকায় পৌঁছে গিয়েছে।

জেলার অতিরিক্ত বনাধিকার সুজিত দাস বলেন, ‘‘আশা করছি রাতের মধ্যে হাতিটি বর্ধমানে পোঁছে যাবে। ওকে পুরানো ঠিকানায় পাঠিয়ে দেওয়াই আমাদের লক্ষ্য।’’ তাঁর আরও দাবি, ‘‘হাতিটি স্বভাবে অন্যরকম। এত দিন বিভিন্ন এলাকায় ঘুরলেও খাবারের জন্য কিছু কলা গাছ খাওয়া ছাড়া তেমন কিছু নষ্ট করেনি।’’ বন দফতরের এক আধিকারিকের দাবি, মাঝে ঘুমপাড়ানি গুলি ছোঁড়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু হাতিটি নির্দিষ্ট জায়গায় না দাঁড়ানোয় সে ভাবনা থেকে সরে আসতে হয়। তাছাড়া গুলি গায়ে লাগার পর ঘোর থাকে ঘণ্টা চারেক।এই সময়ের মধ্যে ঘুমন্ত হাতিটিকে জঙ্গল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া ঝুঁকির হতো।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE