দুই নিউট্রন নক্ষত্রের সংঘর্ষ। শিল্পীর কল্পনায়।
আবার একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। ১০০ বছর পর ফের প্রমাণিত হল, আইনস্টাইনের পূর্বাভাসে কোনও ভুল ছিল না।
কনসার্ট হলে বসে এত দিন চোখ বুঁজে গান শুনতে পারছিলেন বিজ্ঞানীরা। একটুও আলো নেই বলে মঞ্চে কারা রয়েছেন, তাঁরা কোন কোন যন্ত্র বাজাচ্ছেন, বিজ্ঞানীদের পক্ষে তা দেখা সম্ভব হয়নি এত দিন।
মহাকাশের কনসার্ট হলের সেই ‘শিল্পী’ আর তাঁদের ‘বাদ্যযন্ত্র’গুলিকেও এ বার দেখতে পেলেন বিজ্ঞানীরা! এই প্রথম। এই আবিষ্কারের সঙ্গে জড়িয়ে রইল ১৩টি ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ৪০ জন বিজ্ঞানীর নামও। যাঁদের মধ্যে রয়েছেন ৪/৫ জন বাঙালি বিজ্ঞানীও।
আমেরিকার হ্যানফোর্ড আর লিভিংস্টোনে বসানো দু’টি লেসার ইনটারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ অবজারভেটরি (লাইগো) আর ইতালির পিসার কাছে ‘ভার্গো’ ডিটেক্টরে একই সঙ্গে ধরা পড়ল ১৩ কোটি বছর আগে মহাকাশের একটি ধুন্ধুমার সংঘর্ষের ঘটনা। দু’টি নিউট্রন তারা বা নক্ষত্রের মধ্যে। যে দু’টি নিউট্রন নক্ষত্রের মধ্যে সেই ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল, সেই দু’টি নক্ষত্র ভরের নিরিখে আমাদের সূর্যের চেয়ে ১০ থেকে ৬০ শতাংশ বেশি। দু’টি অসম্ভব ভারী নক্ষত্রের মধ্যে সেই ভয়ঙ্কর ধাক্কাধাক্কির ঘটনাটি ঘটেছিল গ্যালাক্সি ‘এনজিসি-৪৯৯৩’-তে।
আরও পড়ুন- আইনস্টাইনকে পাশ করিয়ে নোবেল পেলেন তিন পদার্থবিজ্ঞানী
আরও পড়ুন- উষ্ণায়ন কমাতে ‘বিষ’কে বন্ধু বানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা
সেই অসম্ভব জোরালো ধাক্কাধাক্কির ফলে ব্রহ্মাণ্ড যে ঢেউয়ে উত্তাল হয়েছিল, ১৩ কোটি বছর পর তা পৃথিবীর ‘ঘাট’-এ এসে ভিড়েছিল এই সে দিন। গত ১৭ অগস্ট।
দু’টি নিউট্রন নক্ষত্রের মধ্যে সংঘর্ষ: দেখুন ভিডিও
বিস্তর পরীক্ষানিরীক্ষার পর সোমবার সেই আবিষ্কারের কথা আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করল লাইগো-ভার্গো কোলাবরেশন।
জানানো হল, পুকুরে বড় ঢিল ফেললে যেমন ঢেউয়ের জন্ম হয়, তেমনই দু’টি নিউট্রন নক্ষত্রের মধ্যে সেই জোরালো সংঘর্ষের ঘটনায় জন্মানো ঢেউয়ের কম্পনই যে এ বার শুধু অনুভূত হয়েছে, তা-ই নয়; যে নিউট্রন নক্ষত্রদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির ফলে সেই ঢেউয়ের জন্ম হয়েছিল, তাদেরও চাক্ষুষও করা গিয়েছে। এই প্রথম। কারণ, সেই সংঘর্ষের ফলে তৈরি হওয়া আলো বা তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গকেও এই প্রথম চাক্ষুষ করতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা। এই প্রথম চাক্ষুষ করা সম্ভব হল, গামা রে বার্স্টের ঘটনাগুলি ঘটে নিউট্রন নক্ষত্রদের মধ্যে সংঘর্ষের দৌলতে। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে এই আবিষ্কার একটি যুগান্তকারী ঘটনা।
ব্রহ্মাণ্ডের এই ঢেউটাকেই বলা হয়, মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। আজ থেকে ১০০ বছর আগে প্রথম এই তরঙ্গের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন আইনস্টাইন। তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদে।
কিন্তু তার পর কিছুতেই সেই মহাকর্ষীয় তরঙ্গের হদিশ পাওয়া যাচ্ছিল না। কারণ, সেই তরঙ্গ অত্যন্ত ক্ষীণ। কয়েকশো কোটি বছর আগেকার সেই ঢেউ ব্রহ্মাণ্ডে ছড়াতে ছড়াতে যখন পৃথিবীর ‘ঘাট’-এ এসে ভিড়বে, তখন তা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যাবে বলে খোদ আইনস্টাইনও ভেবেছিলেন পৃথিবীতে বসে হয়তো কোনও দিনই চাক্ষুষ করা যাবে না সেই তরঙ্গ।
গত শতাব্দীর সাত আর আটের দশকে সেই তরঙ্গকে অনুভব করার উপায় প্রথম বাতলেছিলেন যাঁরা, সেই রাইনার ওয়েস, ব্যারি সি ব্যারিশ এবং কিপ এস থর্নকে এ বছর নোবেল পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছে।
আর মূলত সেই তিন পথপ্রদর্শক বিজ্ঞানীকে অনুসরণ করেই প্রথম মহাকর্ষীয় তরঙ্গের হদিশ মিলেছিল আমেরিকার হ্যানফোর্ড ও লিভিংস্টোনে বসানো দু’টি লাইগো ডিটেক্টরে। ২০১৫-র সেপ্টেম্বরে। ওই বছরেরই ডিসেম্বরে তা আরও এক বার ধরা পড়ে লাইগো ডিটেক্টরে। সেই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ তৃতীয় বার ধরা পড়েছিল এ বছরের জানুয়ারিতে। লাইগো ডিটেক্টরেই। আর চতুর্থ বার একই সঙ্গে আমেরিকার লাইগো ও ইতালির ভার্গো ডিটেক্টরে। গত অগস্টেই।
লাইগো ইন্ডিয়ার সায়েন্স অপারেশনের প্রধান, পুণের ইন্টার-ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোনমির অধ্যাপক সুকান্ত বসু আনন্দবাজারকে এই খবর দিয়ে জানাচ্ছেন, ২০১৫ সাল থেকে এ বছরের অগস্ট পর্যন্ত যে ৪ বার মহাকর্ষীয় তরঙ্গের হদিশ মিলেছিল, প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার উৎস ছিল কয়েকশো কোটি বছর আগের দু’টি ব্ল্যাক হোলের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা। যেহেতু ব্ল্যাক হোল থেকে সাধারণ ভাবে কোনও আলো বা তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ বেরিয়ে আসতে পারে না তার অত্যন্ত জোরালো অভিকর্ষ বলের জন্য, তাই আগের চার বার মঞ্চে যারা কনসার্টের শিল্পী সেই ব্ল্যাক হোল আর তাদের বাদ্যযন্ত্রগুলিকে দেখা যায়নি। নিউট্রন নক্ষত্র থেকে যেহেতু আলো বেরিয়ে আসতে পারে, তাই এ বার এই মহাকর্ষীয় তরঙ্গের শুধু কম্পনই নয়, তাকে চাক্ষুষ করাও সম্ভব হল।
২০১৫-র সেপ্টেম্বরে প্রথম যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের হদিশ মিলেছিল দু’টি ব্ল্যাক হোলের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির ফলে সেই ঘটনাটা ঘটেছিল ১৩০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে। ওই বছর ডিসেম্বরে ধরা পড়া মহাকর্ষীয় তরঙ্গটির উৎসস্থল ছিল ২৯০ কোটি আলোকবর্ষ। ২০১৭-র জানুয়ারিতে হদিশ মেলা তরঙ্গটির জন্ম হয়েছিল ১৪০ কোটি আলোকবর্ষ দূরত্বে। আর গত ১৪ অগস্ট যে তরঙ্গটির হদিশ মিলেছিল, সেটির উৎসস্থল ছিল ১৮০ কোটি আলোকবর্ষ দূরত্ব।
সুকান্তবাবুর কথায়, ‘‘আগের ৪ বারের ঘটনার তুলনায় গত ১৭ অগস্ট যে মহাকর্ষীয় তরঙ্গটির হদিশ মিলেছে, তা এসেছে সবচেয়ে কাছ থেকে। দু’টি নিউট্রন নক্ষত্রের মধ্যে সেই ধাক্কাধাক্কির ঘটানাটা ঘটেছিল মাত্র ১৩ কোটি বছর আগে। সে দিক থেকেও এই আবিষ্কার রীতিমতো অভিনব।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy