গত দু’দশকে আরও সবুজ হয়েছে পৃথিবী। ছবি- শাটারস্টক
চার পাশ থেকে যখন একের পর এক আসছে ধ্বংসের খবর, অবলুপ্তির খবর, তখন সৃষ্টির খবর দিল নাসা। জানাল, আগের চেয়ে গত ২০ বছরে আরও সবুজ হয়েছে পৃথিবী। এও জানাল, ধ্বংসের মধ্যে এই সৃষ্টি প্রক্রিয়ার নেতৃত্বে রয়েছে ভারত ও চিন।
উষ্ণায়নের জেরে যখন তিন/চার ফসলি জমিও উত্তরোত্তর হয়ে পড়ছে অনুর্বর, চাষের অযোগ্য, মাঠ শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষার মরসুম, তখন নাসা জানাল, বিশ্বের সবুজায়নে পথ দেখিয়েছে ভারত ও চিন। নাসার ওই সাম্প্রতিক গবেষণায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এক ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিজ্ঞানীর। বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রঙ্গ রামা মায়নেনি। গবেষণাপত্রটি বেরিয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান-জার্নাল ‘নেচার-সাসটেইনেবিলিটি’-র হালের সংখ্যায়।
সেই সবুজায়নের রূপকার মানুষই!
গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন, উষ্ণায়নের জন্য যখন অভিযোগের আঙুল ওঠার বিরাম নেই মানুষের দিকে, তখন এই গবেষণা জানাল, বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দু’টি দেশ, ভারত ও চিনের নাগরিকরাই ফের প্রাণ ফিরিয়েছেন প্রকৃতির। পরিবেশকে গাছপালাদের জন্য করে তুলেছে আগের চেয়ে বেশি বাসযোগ্য। গাছপালাদের বেড়ে ওঠা, বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন যে আবহাওয়া, পরিবেশ ও পুষ্টির, দক্ষিণ এশিয়ার দু’টি প্রতিবেশী দেশেই, গত দু’দশকে তা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। তাতে এলাকা-পিছু শুধু যে গাছপালার সংখ্যা বা তাদের বসতির ঘনত্ব (পপুলেশন ডেনসিটি) বেড়েছে তা-ই নয়; বেড়েছে গাছে গাছে পাতার সংখ্যা। পাতারাও আগের চেয়ে হয়েছে অনেক বেশি হৃষ্টপুষ্ট। গত ২০ বছরে আরও সবুজ হয়ে উঠেছে দেশ ভারত ও চিন।
নাসা জানাচ্ছে, সেই ‘অসম্ভব’ সম্ভব হয়েছে চিন জুড়ে ব্যাপক বনসৃজনের দৌলতে। আর ভারত ও চিনের কৃষিকাজের কর্মযজ্ঞে।
২০ বছরে কতটা সবুজতর হয়েছে পৃথিবী?
অন্যতম মূল গবেষক, বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রঙ্গ রামা মায়নেনি আনন্দবাজার ডিজিটালের ই-মেলে পাঠানো প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন, প্রায় ২৮ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার। বিশ্বের বৃহত্তম বনাঞ্চল, আমাজন বৃষ্টি-অরণ্যও (আমাজন রেনফরেস্ট) রয়েছে প্রায় ৫৫ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে। ২০০০ সালের গোড়ার দিক থেকে ধরলে, সেই বৃদ্ধির হার খুব কম হলেও, হবে ৫ শতাংশ।
বিশ্বকে এক-তৃতীয়াংশ সবুজতর করেছে ভারত, চিন!
মায়নেনি বলেছেন, ‘‘গত দু’দশকে যে ভাবে কেল্লা ফতে করেছে ভারত ও চিন, তা আমাদের রীতিমতো অবাক করে দিয়েছে। কারণ, পৃথিবীর স্থলভাগের যে পরিমাণ জমিতে চাষবাস হয়, তার মাত্র ৯ শতাংশ চাষের জমি রয়েছে ভারত ও চিনে। এত কম চাষযোগ্য জমি হাতে থাকা সত্ত্বেও, বিশ্বে গত ২০ বছরে যতটা সবুজায়ন হয়েছে, তার এক-তৃতীয়াংশই হয়েছে ভারত ও চিনে। তাদের ভৌগোলিক এলাকার তারতম্য না ঘটলেও। যার মানে, ওই দু’টি প্রতিবেশী দেশে আরও অন্তত ১০ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার এলাকা ভরে গিয়েছে নতুন নতুন গাছ আর হৃষ্টপুষ্ট, ডালে ডালে আরও বেশি কাছাকাছি থাকা পাতায়। উপগ্রহের পাঠানো এই তথ্যে আমরা অবাক হয়েছি, কারণ, এত দিন জানা ছিল, জনবহুল দেশে মানুষের পদচিহ্নই উত্তরোত্তর আরও বেশি এলাকা জুড়ে ভূমিক্ষয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছে, নিয়ে চলেছে।
দেখুন কী ভাবে সবুজতর হয়ে উঠেছে পৃথিবী। নাসার ভিডিয়ো
শাপে বর হয়েছে গাছপালার!
গবেষকরা বলছেন, শিল্পোৎপাদনের জন্য বাতাসে গ্রিনহাউস গ্যাস আরও বেশি পরিমাণে মেশায় গাছপালাদের লাভ হয়েছে। গ্রিনহাউস গ্যাসের মধ্যে অন্যতম কার্বন ডাই-অক্সাইড। এই গ্যাসই গাছপালাদের রান্নাবান্নার বা সালোক সংশ্লেষ প্রক্রিয়ার চালিকাশক্তি। জ্বালানি। বাতাসে তার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় রান্নাবান্নাটা ভালই হচ্ছে গাছপালাদের। ফলে, তারা হৃষ্টপুষ্ট হয়ে উঠছে, তাড়াতাড়ি।
১৯৮২ থেকে ২০১৫, যে ভাবে বদলে গিয়ে আরও সবুজ হয়েছে পৃথিবী
ভূপৃষ্ঠের দেড় হাজার ফুট গভীরেও ঢুঁ মেরেছে ‘মোডিস’
মায়নেনি জানিয়েছেন, নয়ের দশকের মাঝামাঝিই প্রকৃতি ও পরিবেশের এই রদবদলটা তাঁর চোখে পড়েছিল। কিন্তু তা হাতেকলমে প্রমাণ করার কোনও হাতিয়ার ছিল না তাঁর হাতে। সেটা এ বার সম্ভব হয়েছে নাসার পাঠানো দু’টি উপগ্রহে রাখা বিশেষ ধরনের একটি যন্ত্র ‘মডারেট রেজোলিউশন ইমেজিং স্পেকট্রোরেডিওমিটার’ বা ‘মোডিস’-এর দৌলতে। মায়নেনির কথায়, ‘‘মহাকাশ থেকে উপগ্রহের ভিতরে থাকা ‘মোডিস’ যন্ত্রটি ভূপৃষ্ঠ থেকে শুরু করে তার নীচে ১ হাজার ৬০০ ফুট গভীরতা বা ৫০০ মিটার পর্যন্ত রেডিও রশ্মি পাঠিয়ে এই অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ করেছে।’’
আমাজন বৃষ্টি-অরণ্য: দেখুন ভিডিয়ো
আরও পড়ুন- অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলে ফের হবে মহাপ্লাবন! হুঁশিয়ারি বিজ্ঞানীদের
আরও পড়ুন- মহাপ্রলয় আসন্ন? আট দশকেই জলমগ্ন হবে অধিকাংশ মহাদেশ: রাষ্ট্রপুঞ্জ
‘মোডিস’ গত দু’দশক ধরে পৃথিবীর সর্বত্র একটি সুনির্দিষ্ট জায়গার ছবি তুলেছে দিনে ৪ বার করে।
মায়নেনির বক্তব্য, ২০ বছরে গোটা বিশ্ব যতটা সবুজতর হয়ে উঠেছে, তার ৪২ শতাংশ সম্ভব হয়েছে চিন জুড়ে ব্যাপক বনসৃজনের সফল কর্মযজ্ঞের দৌলতে। আর ভূমিক্ষয়, বায়ুদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের রথের চাকায় লাগাম পরানো কিছুটা সম্ভব হওয়ায় চিনে গাছপালায় পাতার সংখ্যা বেড়েছে ৩২ শতাংশ। ভারতে সেটা হয়েছে অন্তত ৮২ শতাংশ। আরও বেশি পরিমাণে খাদ্যশস্যের বীজ রোপণের জন্য। অথচ, ২০০০ সালের তুলনায় ভারত ও চিনে চাষযোগ্য জমির পরিমাণে যে খুব একটা হেলদোল ঘটেছে, তা কিন্তু নয়। দু’টি দেশে চাষবাস হচ্ছে এখন ৭ লক্ষ ৭০ হাজার বর্গ মাইলেরও বেশি এলাকা জুড়ে।
গবেষকরা অবশ্য এটাও বলছেন, এর ভিত্তিতেই বলে দেওয়া যাবে না, এই উষ্ণায়নের সময় যাবতীয় উদ্বেগকে দূরে সরিয়ে দিতে পেরেছে এই সবুজায়ন। কারণ, শস্যের ফলন, উৎপাদন, দীর্ঘ সময় ধরে তার সুস্থ, সবল থাকার প্রক্রিয়াটা নির্ভর করে ভূগর্ভস্থ জল, জমির উর্বরতা, তাপমাত্রা-সহ আনুষঙ্গিক কয়েকটি জরুরি বিষয়ের উপরে।
রয়েছে আশঙ্কাও
মায়নেনির কথায়, ‘‘ভারতে ভূগর্ভস্থ জলের পরিমাণের যা অবস্থা আর তার গুণাগুণ যা, তাতে সবুজায়নের রথের চাকা আরে বেশি দূর নাও গড়াতে পারে, অন্তত ভারত বা তার মতো আরও কয়েকটি দেশে।’’
ছবি ও ভিডিয়ো সৌজন্যে: নাসা
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
গ্রাফিক-তথ্য: নাসা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy