অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।
এত দিন যা করা হচ্ছিল
সেই কঠিন কাজটা এত দিন করা হচ্ছিল একটি তড়িৎ- রাসায়নিক (ইলেক্ট্রো-কেমিক্যাল)পদ্ধতিতে।
যেখানে প্ল্যাটিনাম ধাতুর একটি অনুঘটক ব্যবহার করা হচ্ছিল কার্বন ডাই-অক্সাইড অণু ভেঙে কার্বন মনোক্সাইড অণু বানানোর জন্য। তাতে দুটি কাজ হয়। কার্বন ডাই-অক্সাইড অণু ভেঙে যাওয়ার ফলে বাতাসে বিষের বোঝা কমে। আবার সেই ভাঙার পর তৈরি হওয়া কার্বন মনোক্সাইড অণু অনেকের সঙ্গেই চটপট বিক্রিয়া করে আমাদের রোজকার জীবনে লাগে এমন নানা পদার্থের জন্ম দিতে পারে। তৈরি করতে পারে প্লাস্টিক আর গ্যাসোলিনের মতো বহু প্রয়োজনীয় পদার্থ। যা আমাদের রোজকার জীবনে খুব কাজে লাগে।
অসুবিধাটা কোথায়?
কিন্তু মুশকিলটা হচ্ছে অন্য জায়গায়। যে প্ল্যাটিনাম অনুঘটক দিয়ে এখন কার্বন ডাই-অক্সাইড অণু ভাঙার কাজটা আমরা চালিয়ে যাচ্ছি, সেই প্ল্যাটিনাম খুব দামি। চট করে পাওয়াও যায় না। ফলে, ‘ওঝা’দের কাজটা মোটেই সহজ হচ্ছিল না। আমাদের জীবনে কাজেও লাগানো যাচ্ছিল না তেমন ভাবে।
এই গবেষণার কৃতিত্ব
নতুন গবেষণার কৃতিত্ব, এ বার সেটা করা যাবে খুব সহজে। আরও দ্রুত। অনেক কম খরচে। শুধু তাই নয়, যে ব্যাটারির মাধ্যমে সেটা করা হবে তার আয়ুও হবে অনেক বেশি।
বেঙ্গালুরুর ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স’-এর রসায়নবিদ্যার অধ্যাপক পার্থসারথি মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, সেই অনুঘটক বানানো হয়েছে নিকেল আর লোহার অক্সাইড কার্বোনেট একটি যৌগ দিয়ে। যার মধ্যে অসংখ্য ক্ষুদ্র ছিদ্র আছে। তার মধ্যে দিয়ে বিষে ভরা বাতাস গেলে তা বিষ কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসকে টেনে নিয়ে তাকে ভেঙে কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসে বদলে দেবে।
এই কাজটা করতে অবশ্য গবেষকদের প্রচুর বিদ্যুৎশক্তি ব্যবহার করতে হয়েছে। তবে সুবিধেটা এই যে নিকেল আর লোহা, দুটি পদার্থই খুব সহজলভ্য। দামেও প্লাটিনামের তুলনায় খুবই সস্তা।
মোহনপুরে ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স এডুকেশন এন্ড রিসার্চ (আইসার-কলকাতা)’-র রসায়নবিদ্যা বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা। এই পদ্ধতিকে বলা হয় অক্সিজেন ইভোল্যুশন রিঅ্যাকশন বা ‘ওইআর’। আরও নানা ধরনের অনুঘটক ব্যবহার করে এই পদ্ধতিতে বাতাসের বিষকে আমাদের রোজকার জীবনে কাজে লাগার পদার্থে বদলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। তবে নিকেল আর লোহার মতো সস্তা ধাতু দিয়ে অনুঘটক বানিয়ে অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ দেখালেন গবেষকরা।’’
বিদ্যুতের বদলে আলো হলে ভাল?
রাহুলের মতে, আরও ভাল হত যদি বিদ্যুৎ না ব্যবহার করেই বাতাসের বিষ কার্বন ডাই-অক্সাইড অণুকে ভেঙে ফেলা যেত। সে ক্ষেত্রে বিদ্যুতশক্তি ব্যবহারের খরচটাও আর লাগত না।
রাহুলের কথায়, ‘‘কাজটা ইলেক্ট্রো-কেমিক্যাল না হয়ে আলোক-রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে(ফোটো-কেমিক্যাল) করা সম্ভব হলে তা সাধারণ মানুষের কাজে আরও বেশি করে লাগানো যেত। তাই এখন দেখতে হবে সূর্যালোক ব্যবহার করেও এই ধরনের অনুঘটক দিয়ে কার্বন ডাই-অক্সাইড অণুকে ভাঙা যায় কি না। তা হলে সেটা আক্ষরিক অর্থেই হয়ে উঠবে যুগান্তকারী।’’
বাজারে আসছে কতটা সময় লাগবে এই প্রযুক্তির?
গবেষকরা জানিয়েছেন, খুব শীঘ্রই এই প্রযুক্তির বাণিজ্যিকিকরণের চেষ্টা হচ্ছে। মূলত শিল্প কারখানা থেকেই তো বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসের মতো বিষ এসে মেশে, তাই প্রযুক্তিকে প্রাথমিক ভাবে মূলত শিল্প সমৃদ্ধ এলাকাগুলিতেই ব্যবহার করা হবে। সেখাকার বাতাসে মিশে থাকা কার্বন ডাই অক্সাইডের বিষের বোঝা কমাতে ওই গ্যাসকে কার্বন মনোক্সাইডে বদলে দেওয়ার চেষ্টা চালানো হবে। গবেষকদের আশা, আগামী এক-দেড় দশকের মধ্যেই এই প্রযুক্তির বাস্তবায়ন সম্ভব।