Advertisement
০২ মে ২০২৪

পৃথিবীতে প্রথম জল এনেছিল কোনও উল্কা?

এই পৃথিবীতে জল এনেছিল কে? কোথা থেকে জলে জলে ভরে গিয়েছিল আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহের সব নদী-নালা-হ্রদ, সাগর-মহাসাগর? কী ভাবেই বা সুদূর অতীতে জলে টইটম্বুর হয়ে গিয়েছিল এই সৌরমণ্ডলের আরও দু’টি গ্রহ- মঙ্গল, শুক্র? জল কি একেবারেই ‘বহিরাগত’?

সুজয় চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০১৬ ১২:১৬
Share: Save:

এই পৃথিবীতে জল এনেছিল কে? তিন ভাগই জল। আদিগন্ত, অতলান্ত জলে ভরে আছে পৃথিবী।

কোথা থেকে জলে জলে ভরে গিয়েছিল আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহের সব নদী-নালা-হ্রদ, সাগর-মহাসাগর?

কী ভাবেই বা সুদূর অতীতে জলে টইটম্বুর হয়ে গিয়েছিল এই সৌরমণ্ডলের আরও দু’টি গ্রহ- মঙ্গল, শুক্র?

সেই অতলান্ত, আদিগন্ত জল এই পৃথিবীতে এসেছিল কি ব্রহ্মাণ্ডের কোনও আন্তর্নাক্ষত্রিক মাধ্যম (Interstellar Medium) থেকে? জল কি তা হলে একেবারেই ‘বহিরাগত’?

আর সেই ‘বহিরাগত’ জলেই কি এক দিন টইটম্বুর হয়ে গিয়েছিল ‘লাল গ্রহ’ মঙ্গল আর শুক্রও?

আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহ কিন্তু জলে ভাসতে শুরু করেছিল সেই তার শৈশবকাল থেকেই। মানে, আজ থেকে ৪৪০ কোটি বছর আগে।

কিন্তু কী ভাবে তা সম্ভব হয়েছিল?

কে সেই জল নিয়ে এসেছিল আমাদের এই গ্রহে? কার ‘দাক্ষিণ্যে’ এক সময় জলে টইটম্বুর হয়ে গিয়েছিল মঙ্গল আর শুক্রের মতো এই সৌরমণ্ডলের আরও দু’টি গ্রহ?

‘ইন্টারস্টেলার’ ফিল্মে ভিন গ্রহে সাঁতরাচ্ছেন মহাকাশচারীরা। ছবি- নাসা।

বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, এ দেশে ভিন গ্রহ নিয়ে গবেষণায় পুরোধা বিজ্ঞানী সুজন সেনগুপ্ত জানাচ্ছেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত যেটুকু তথ্যপ্রমাণ মিলেছে, তাতে এটা মোটামুটি নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়, কোনও এক বা একাধিক উল্কাই পৃথিবীতে জল এনেছিল। জল এনেছিল এক সময় মঙ্গল ও শুক্র গ্রহেও। তখন সবকটা গ্রহই তেতে-পুড়ে যাচ্ছিল। আর জলে ভরা উল্কাগুলো অসম্ভব রকমের গরম গ্রহগুলোয় আছড়ে পড়ার পর তার ভেতরের জলের পুরোটাই বাষ্পীভূত হয়ে গিয়ে বিশাল মেঘের জন্ম দিয়েছিল। কোটি কোটি বছর পর গ্রহগুলো ঠাণ্ডা হয়ে এলে ওই বিশাল মেঘের জন্যই গ্রহগুলোয় শুরু হয়েছিল তুমুল ঝড়, বৃষ্টি। আর তাতেই জলে ভরে যায় গ্রহগুলো। প্রায় পুরোটাই কার্বনে গড়া ওই উল্কাগুলোকে বলা হয় ‘কার্বনেশিয়াস মেটিওরাইট’। ওই ধরনের উল্কাগুলোই এই সৌরমণ্ডলের প্রাচীনতম মহাজাগতিক বস্তু। যার অর্থ, এই সৌরমণ্ডলে সূর্য আর গ্রহগুলোরও জন্মের আগে জন্ম হয়েছিল ওই কার্বনে গড়া উল্কাগুলোর। সৌর-মেঘ বা সোলার ক্লাউড থেকে। যে মেঘ থেকেই পরে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল সূর্য আর গ্রহ-উপগ্রহগুলোর শরীর।’’

কিন্তু কী ভাবে অত জল পেল ওই উল্কাগুলো?

পৃথিবীর ৫০ শতাংশ জল এসেছিল সূর্যের শরীর গড়ে ওঠার আগে। ছবি-নাসা।

জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণার সাম্প্রতিক ফলাফল জানাচ্ছে, ওই বিশেষ ধরনের উল্কাগুলোর মাটিতে মিশে থাকা খনিজ ও জৈব পদার্থ থেকেই ওই জলের জন্ম হয়েছিল। আর উল্কাগুলোয় থাকা সেই সুপ্রচুর জল আর জৈব যৌগগুলোতে ছিল অফুরন্ত হাইড্রোজেনের আইসোটোপ- ‘ডয়টেরিয়াম’। যাকে আমরা ‘ভারী জল’ বলে জানি। আরও মজার ঘটনা হল- আমাদের এই তিন ভাগ জলের গ্রহে ডয়টেরিয়াম ও হাইড্রোজেনের অনুপাত যতটা, ওই উল্কাগুলোতেও সেই অনুপাত ততটাই মিলেছে। এর মানে, উল্কাগুলোয় ডয়টেরিয়াম ছিল প্রচুর পরিমাণে। অথচ, সূর্য বা বৃহস্পতির মতো গ্যাসীয় গ্রহে ওই ডয়টেরিয়াম নেই বললেই হয়।

আরও পড়ুন- ধু ধু মরুভূমিই এ বার বাতাসে ফেরাবে প্রাণ!

কিন্তু, প্রশ্নটা উঠেছে অন্যত্র। তা হল- জল তো কম নেই ধূমকেতুগুলোতেও। আর ধূমকেতুদেরও জন্ম হয়েছিল এই সৌরমণ্ডলে সূর্য আর গ্রহ-উপগ্রহগুলোর জন্মের আগে। তা হলে কেন ধূমকেতু থেকে এই পৃথিবী বা মঙ্গলে জল আসার সম্ভাবনাকে ততটা আমল দিচ্ছেন না জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা?

সুজনবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘এটা ঠিকই যে, ডয়টেরিয়াম প্রচুর পরিমাণে রয়েছে ধূমকেতুগুলোতে। কিন্তু, কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে ধূমকেতুগুলো সূর্যের কাছে এলেই তার জমানো জলের প্রায় সবটুকুই সূর্যের গনগনে তাপে জলীয় বাষ্প হয়ে উড়ে যায়। ধূমকেতুর জলের সামান্য একটা অংশ যে পৃথিবীতে আসেনি, তা নয়। এসেছে। কিন্তু তা পরিমাণে খুবই অল্প। পৃথিবীর আদিগন্ত জলের মাত্রই দশ ভাগ।’’

পুরোপুরি কার্বনে গড়া বা কার্বনেশিয়াস উল্কা। ছবি-নাসা।

একেবারে হালে পাওয়া গিয়েছে আরও চমকে দেওয়ার মতো তথ্য। প্রকাশিত হয়েছে ‘নেচার’ জার্নালে। তা হল- গত কয়েক দশকের বিস্তর অনুসন্ধান ও খননের পরে মার্কিন ভূতাত্ত্বিকরা সম্প্রতি ভূপৃষ্ঠের (ক্রাস্ট) ৪১০ থেকে ৬৬০ কিলোমিটার নীচে একটা সুবিশাল জলাধারের হদিশ পেয়েছেন। পৃথিবীর সাগর ও মহাসাগরগুলোয় মোট যে পরিমাণ জল রয়েছে, তার তিন গুণ জল রয়েছে ভূপৃষ্ঠের ৪১০ থেকে ৬৬০ কিলোমিটার নীচে থাকা ওই সুবিশাল জলাধারে।

ভূপৃষ্ঠের নীচে সেই জলাধার, যা একদা এই গ্রহকে জলে ভরিয়েছিল। ছবি-নাসা।

কিন্তু, সেই জল রয়েছে কী ভাবে?

সুজনবাবু জানাচ্ছেন, ‘‘রিংউডাইট (Ringwoodite) নামে এক ধরনের শিলার খাঁজে ভযঙ্কর চাপে আটকে রয়েছে ওই বিপুল পরিমাণে জল। অগ্ন্যুৎপাতের সময় ওই রিংউডাইট শিলা ওপরে উঠে আসার পর দেখা গিয়েছে, একটা ছোট্ট হিরের আকারের রিংউডাইট শিলায় জল রয়েছে প্রায় দেড় শতাংশ। তা হলে ভাবুন, ভূপৃষ্ঠের অত নীচে রিংউডাইট শিলার খাঁজে খাঁজে কী বিপুল পরিমাণে জল রয়েছে। যদিও সেই জল তরল অবস্থায় নেই। রয়েছে হাইড্রক্সাইড ও হাইড্রক্সিল আয়ন হিসেবে। এই আবিষ্কার কিন্তু আমাদের অন্য ভাবেও ভাবাচ্ছে। তা হল, হয়তো ধূমকেতু, উল্কা বা গ্রহাণু বাইরে থেকে জল আনেনি আমাদের এই বাসযোগ্য গ্রহে। সেই জল বোধহয় পৃথিবীর অন্তস্থল থেকেই কোনও এক সুদূর অতীতে ওপরে উঠে এসে আমাদের সাগর-মহাসাগর টইটম্বুর করে দিয়েছিল।’’

সেই বিরলতম হিরে, যার মধ্যে মিলেছে জলবাহী রিংউডাইট শিলা। ছবি-নাসা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

water on earth came from outside
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE