Advertisement
০৭ মে ২০২৪
Science

যেন অ্যালবাট্রসের ডানা! ঈশ্বর বাড়তি কী কী দিয়েছিলেন ফেল্পসকে?

অ্যালবাট্রসের পরেই মাইকেল ফেল্পস। ঈশ্বরের হাতেই ছিল সেই ‘ট্রাম্প কার্ড’টা! সব সময় সবার ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন না তিনি! মাইকেল ফেল্পসের ক্ষেত্রে করেছিলেন! মাতৃগর্ভে থাকার সময়েই ফেল্পসের ভ্রূণে কিছু কারিকুরি করে দিয়েছিলেন ঈশ্বর! আজ, শনিবার চতুর্থ কিস্তি।

সুজয় চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ১৪:৪৩
Share: Save:

অ্যালবাট্রসের পরেই মাইকেল ফেল্পস। ঈশ্বরের হাতেই ছিল সেই ‘ট্রাম্প কার্ড’টা! সব সময় সবার ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন না তিনি! মাইকেল ফেল্পসের ক্ষেত্রে করেছিলেন! মাতৃগর্ভে থাকার সময়েই ফেল্পসের ভ্রূণে কিছু কারিকুরি করে দিয়েছিলেন ঈশ্বর! ভবিষ্যতের সাঁতারের কিংবদন্তীর হাত দু’টোকে এমন ভাবে বেড়ে ওঠার ‘ওষুধ’ (জিন) দিয়েছিলেন ঈশ্বর, যাতে সেগুলো আগামী দিনে হয়ে ওঠে প্রায় অ্যালবাট্রসের ডানা!

ডাইনোসর আর আদ্যিকালের পাখি ‘কনডর’কে বাদ দিলে ডানার নিরিখে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে অ্যালবাট্রসই। এই দৈত্যাকার পাখিটি তার ডানা দু’টিকে দু’দিকে ছড়িয়ে দিত পারে সর্বাধিক ১২ ফুট পর্যন্ত। মানে, এক তলা বাড়ির চেয়েও উঁচু। এদেরই আরেকটি প্রজাতিকে বলে সি-ইগ্‌ল। এত বড় ডানার বিস্তারের জন্য প্রায় ‘আলোর গতি’তে আকাশ সাঁতরে বেড়াতে পারে অ্যালবাট্রস। বায়ুমণ্ডলের কোনও বাধাই তার গতিতে রাশ টানতে পারে না। এক রকমের ‘জিরো রেজিস্ট্যান্স’। কার্যত প্রতিরোধহীন।


সেই অ্যালবাট্রস


মাইকেল ফেল্পস

একেবারে অ্যালবাট্রসের আদলেই মাইকেল ফেল্পসকে গড়েছিলেন ঈশ্বর! সাধারণত, মানুষ তার দু’টি হাতকে দেহের দু’পাশে টানটান করে ছড়িয়ে দিলে এক হাতের মধ্যমা থেকে অন্য হাতের মধ্যমার দূরত্ব যতটা হয়, সেটাই হয় সেই মানুষের উচ্চতা। দুই হাতের দৈর্ঘ্যের ক্ষেত্রে ফেল্পসকে একটু বেশি নম্বর দিয়েছিলেন ঈশ্বর! ফেল্পসের হাত দু’টির দূরত্বকে তাঁর উচ্চতার চেয়েও অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ৬ ফুট ৭ ইঞ্চি। ফেল্পসের উচ্চতাটাও তাঁর জিন এমন ভাবে ঠিক করে রেখেছিল যাতে তিনি পৌছতে পারেন ৬ ফুট ৪ ইঞ্চিতে। সাঁতারুর জন্য যেটা আদর্শ উচ্চতা। মানে, ফেল্পসের উচ্চতার চেয়েও বেশি তাঁর দুই হাতের দুই মধ্যমার মধ্যেকার দূরত্ব। ওটাই ছিল ঈশ্বরের হাতে থাকা ‘ট্রাম্প কার্ড’। শুধু অলিম্পিক্সেই ২৩টি সোনা সহ ২৮টি পদক জিতে যিনি সর্ব কালের সেরা পদকজয়ী। ভেঙে দিয়েছেন সাঁতারু মার্ক স্পিৎজের ৪৪ বছর আগেকার রেকর্ডও।


যেন মাদুর! আদর্শ সাঁতারুর জিন কাঠামো

সবাইকে সব কিছু না দিলেও আগামী দিনের সম্ভাবনাময় অ্যাথলিট, জিমন্যাস্টদের শরীরে তাঁদের জন্মের সময়েই জিনের এমন কিছু কিছু গঠন বৈচিত্র্য থাকে। হরেক রকমের জিন কাঠামো থাকে। হরেক রকমের জিন সজ্জা থাকে। সেগুলোর কোনটি কী ভাবে সম্ভাবনাময় অ্যাথলিট, জিমন্যাস্টদের প্রতিভায় শান দিতে সাহায্য করবে, সেটা আগে বুঝে নিতে হবে ভারতীয় ক্রীড়া প্রতিভার জহুরিদের। এমনটাই বলছেন জিনতত্ত্ববিদ, ক্রীড়া বিজ্ঞানী, চিকিৎসক ও বায়োলজিস্টরা। তাঁদের বক্তব্য, এখানেই আমাদের দেশে খেলার জহুরিদের খামতি থেকে যাচ্ছে।


আদর্শ জিমন্যাস্টের জিন কাঠামো

ক্রীড়া বিজ্ঞানী, বিশিষ্ট চিকিৎসক কল্যাণ মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘এইখানেই ফেল্পসের বিশেষত্ব। ফেল্পস যে আগামী দিনে এক জন খুব বড় মাপের সাঁতারু হয়ে উঠতে পারবেন, তার জন্য তাঁর জন্মের সময়েই তাঁর শরীরের জিন কাঠামো পথটা তৈরি করে রেখেছিল। আদর্শ সাঁতারুর উচ্চতা, উচ্চতাকে ছাপিয়ে যাওয়া দুই হাতের ব্যতিক্রমী ব্যবধান, হাতের তুলনায় ফেল্পসের ছোট দু’টি পা কিন্তু সেই পা দু’টোকে সর্বাধিক ১৪ ফুট দূরত্ব পর্যন্ত ছড়িয়ে রাখার ক্ষমতা, এক জন ৬ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতার মানুষের টরসো যতটা বড় হয়, সেই রকম বিশাল একটা টরসো- ফেল্পসের শরীরকে যত রকমের সম্ভব বিরল ‘অলঙ্কারে’ সাজিয়ে তোলার ফন্দি এঁটে রেখেছিল তাঁর জিন কাঠামো, তাঁর জন্মের সময়েই। ফেল্পসের শরীরের নিম্নাংশের দৈর্ঘ্য তুলনায় কম। ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি। নিম্নাংশের অতটা কম দৈর্ঘ্য আর ছোট হলেও পা দু’টোকে অতটা ছড়িয়ে দিতে পারার ক্ষমতাই ফেল্পসের ক্ষেত্রে সাঁতার কাটার সময় জলের প্রতিরোধকে কার্যত শূন্য করে দেয়। সমুদ্রে যে সুবিধাটা হয় হাঙরের ঝোড়ো গতিতে ছোটার জন্য। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ফেল্পসের শৈশবেই সেটা বুঝতে পেরে তাঁকে সাঁতারু বানানোর প্রেসক্রিপশন দিয়েছিলেন!’’


উসেইন বোল্ট


সেবাস্টিয়ান কো

ভারতীয় ক্রীড়া ক্ষেত্রের জহুরিরা এই ভাবে প্রতিভা বাছেন না। বেছে নেওয়ার সেই বিজ্ঞানভিত্তিক সুযোগগুলি কোথায় কোথায় আছে তার খবরাখবর রাখেন না। রাখলেও সেগুলিকে ব্যবহার করেন না।

‘স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়া-(ইস্ট জোন)’-এর অ্যাথলেটিক্সের অবসরপ্রাপ্ত কোচ কুন্তল রায় বলছেন, ‘‘আমাদের ১২০ কোটি মানুষের দেশের কোনও মানুষের শরীরেই ফেল্পস, কার্ল লুইস, সেবাস্তিয়ান কো, নাদিয়া কোমানিচি হয়ে ওঠার সহায়ক জিন কাঠামো নেই, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলিকে অসম্ভব দক্ষ করে তোলার জন্য তাঁদের শরীরে প্রয়োজনীয় হরমোনের বিন্দুমাত্র বা পর্যাপ্ত ক্ষরণ হয় না, এটা কোনও বিশ্বাসযোগ্য কথা হতে পারে না। হাই জাম্পের জন্য খুব ভাল উচ্চতার দরকার হয়। রাজস্থান, হরিয়ানা সহ গোটা উত্তর ভারতেই ওই উচ্চতার সম্ভাবনাময় ক্রীড়া প্রতিভার অভাব নেই। ডিসকাস থ্রোয়ার, শটপাট, হ্যামার থ্রোয়ারদের শরীর


নাদিয়া কোমানিচি

যতটা ভারী হওয়া প্রয়োজন বিজ্ঞানসম্মত ভাবে, তার অভাব নেই উত্তর ভারতের সম্ভাবনাময় ক্রীড়া প্রতিভাদের মধ্যে। সাঁতারু হয়ে ওঠার শারীরিক গঠন কাঠামো আর সহায়ক প্রাকৃতিক পরিবেশের অভাব নেই কেরল সব দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলি, এবং পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির ক্রীড়া প্রতিভাদের মধ্যে। কিন্তু সেই শারীরিক গঠন কাঠামোর বাছ-বিচারটা কী ভাবে করতে হয় আগামী দিনের সম্ভাবনাময় প্রতিভা-সন্ধানে বা সেই প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে কী ভাবে জন্মের সময় জিন কাঠামোর দৌলতে পাওয়া সেই শারীরিক কাঠামোগুলির সুযোগ নিতে হয় আদর্শ অ্যাথলিট বা জিমন্যাস্ট গড়ে তোলার জন্য তার পর্যাপ্ত ধারণাই নেই ভারতের ক্রীড়া ক্ষেত্রের বেশির ভাগ জহুরির।’’


দীপা কর্মকার

তার পর আসে বেসিক ট্রেনিং-এর প্রসঙ্গ। বিদেশে অ্যাথলেটিক্স বা জিমন্যাস্টিক্সে ওই বেসিক ট্রেনিংটা শুরু হয়ে যায় একেবারে তিন/চার বছর বয়স থেকেই। আমাদের সেটা শুরু হয় মোটামুটি ১০ বা ১২ বছর বয়সে। খুব হাতেগোনা কয়েকটি ক্ষেত্রে সেটা ভারতে শুরু হয় ৮/৯ বছর বয়সে। তবে তার বেশির ভাগটাই হয় ব্যাক্তিগত উদ্যোগ বা পারিবারিক উৎসাহ, অনুপ্রেরণায়।

এই অভিযোগই উঠে এল ‘স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়া-(ইস্ট জোন)’-এর জিমন্যাস্টিক্সের কোচ মিনারা বেগমের গলায়। বহু বার আন্তর্জাতিক ক্রীড়ামঞ্চে কোচিংয়ের দায়িত্ব পাওয়া মিনারার কথায়, ‘‘একটা উদাহরণ দিই। প্রণতি নায়েক। দীপা কর্মকারের মতোই সম্ভাবনাময় জিমন্যাস্ট প্রতিভা প্রণতি। কিন্তু ও (প্রণতি) অনেক পরে জিমন্যাস্টিক্সটা শুরু করেছিল। আমার কাছে এসেছে ১২/১৪ বছর বয়সে। ‘সাই’য়ে আমার কাছে যারা আসে, তাদের বেশির ভাগেরই বয়স ওই রকমের বা তারও কিছু বেশি। আরও বড় সমস্যাটা হল, এদের বেশির ভাগই অতটা বেশি বয়সে এসেও বেসিক ট্রেনিং করে আসে না। ফলে অতটা বেশি বয়সে শুরু হয় বেসিক ট্রেনিং। তাতেও তিন-চার বছর লাগে।’’


পিভি সিন্ধু

এতে কতটা ক্ষয়-ক্ষতি হচ্ছে সম্ভাবনাময় ভারতীয় অ্যাথলিট বা জিমন্যাস্টদের ক্ষেত্রে?

বেঙ্গালুরুর ‘ইনস্টিটিউট অফ স্টেম সেল বায়োলজি অ্যান্ড রিজেনারেটিভ মেডিসিন’ (ইনস্টেম)-এর জিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মহেন্দ্র রাও বলছেন, ‘‘বিজ্ঞানের নিয়মে জিন কাঠামো যা যা করতে পারে সেই অ্যাথলিট বা জিমন্যাস্টদের আন্তর্জাতিক মানের স্তরে উন্নীত করার ব্যাপারে, অতটা দেরি করে কোটিং নিতে আসায় আর তার পরেও বেসিক ট্রেনিংটা না করে আসায়, ওই সব অ্যাথলিট বা জিমন্যাস্টের ক্ষেত্রে তার কিছুই প্রায় করা যায় না। ‘ইটস বেটার লেট দ্যান নেভার’ কথাটা বোধহয় জিন কাঠামোর ক্ষেত্রে ঠিক কাটে না। দেরি মানে সেখানে সব কিছুই গন্ডগোল হয়ে গেল, বরবাদ হয়ে গেল। কারণ, জিন কাঠামো তার নিজস্ব ঘড়ির কাঁটা ধরেই চলে।’’

আরও পড়ুন-

বিশ্বের পা মঙ্গলে, ভারত আলোর গতিতে ফিরে যাচ্ছে প্রাগৈতিহাসিক যুগে!

চাইলেই ভাল স্প্রিন্টারকে কি আমরা বানাতে পারব পদকজয়ী ম্যারাথনার?

জিন, হরমোন, পরিবেশ পিছিয়ে রাখছে ভারতীয় অ্যাথলিটদের?

এর পরেও কী ভাবে আগামী দিনে সম্ভাবনাময় ক্রীড়া প্রতিভা খুঁজে নেওয়া যেতে পারে আর তার জন্য আমাদের জহুরিদের কী কী করণীয়, কাল রবিবার, শেষ কিস্তিতে তা আলোচনা করা হবে।

ঋণ স্বীকার: ক্রীড়া চিকিৎসা বিজ্ঞানী কল্যাণ মুখোপাধ্যায়, কলকাতা,

জিন বিশেষজ্ঞ মহেন্দ্র রাও, ‘ইনস্টেম’, বেঙ্গালুরু,

জিন বিশেষজ্ঞ অলোক শ্রীবাস্তব, খ্রিস্টান মেডিক্যাল কলেজ, ভেলোর

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE