বহু দিন মনে ছিল আশা, মানুষকে করে তুলব বিজ্ঞানমনস্ক। অবশ্যই সেটা এক মহৎ উদ্দেশ্য, কিন্তু বিজ্ঞানমনস্ক হলেই কি মন কুসংস্কার-মুক্ত হয়? বহু দিনের অভিজ্ঞতা বলছে, হয় না। বহু মানুষ, যাঁরা সারা জীবন বিজ্ঞান নিয়েই কাটিয়েছেন, বিজ্ঞান যাঁদের পেশা, তাঁদের মন কি সব সময়েই কুসংস্কার-মুক্ত হয়? তাঁদের অনেককেই কি তাবিজ, মাদুলি, আংটি ইত্যাদি পরতে দেখা যায় না? পণ্ডিতমশাইকে ডেকে, পঞ্জিকা ঘেঁটে শুভ দিন, শুভ তিথি ঠিক না করে ক’জনের সাহস আছে সন্তানের বিবাহের দিন-ক্ষণ ঠিক করার? বছর বছর বহু বিজ্ঞান জাঠার আয়োজন করেও কি এই প্রথার এতটুকু কোনও পরিবর্তন ঘটানো গিয়েছে? আমেরিকার মতো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যায় উন্নত দেশেও কি সর্বত্র ডারউইনের বিবর্তনবাদ পড়াতে দেওয়া হচ্ছে? কেন হচ্ছে না?
আমার মতে, এর কারণ দু’টি। প্রথমত, আধুনিক বিজ্ঞান মূলত মানুষের মনস্তত্ত্ব অস্বীকার করেই গড়ে উঠেছে। আইনস্টাইন বলতেন, বিজ্ঞানের সূত্রগুলি তো বলে দেয় না মানুষ তাকে কী ভাবে ব্যবহার করবে। যেমন E=mc2। এই সূত্রে কি বলা আছে, “ইহা ব্যবহার করিয়া বোমা বানাইবে না?” মানুষ যে দিন আগুন আবিষ্কার করেছিল, সে দিন কি সে জানত যে, আগুন দিয়ে যেমন রান্না করা যায়, শীতের রাতে আরাম পাওয়া যায়, তেমনই আগুন দিয়ে শত্রুর ঘরও ধ্বংস করা যায়? আগুন কী ভাবে ব্যবহার করা হবে, আগুনের বিজ্ঞানে কি তার কোনও ইঙ্গিত আছে? নেই। তা হলে মানুষকে কে বলে দেয় আগুন কী ভাবে ব্যবহার করতে হবে? আইনস্টাইনের মতে, এই সমস্ত বিধান সুস্থ সমাজের রীতির মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত থাকে। সেটা হয় কী ভাবে? না, সমাজে কিছু মহাপুরুষের মাধ্যমেই এগুলি প্রকাশ পায়। যেমন হয়েছিল আমাদের দেশে মুনি-ঋষিদের মাধ্যমে, গৌতম বুদ্ধের মাধ্যমে, ইহুদিদের মধ্যে মোজ়েসের মাধ্যমে, পশ্চিম এশিয়ায় জিশু, জরাথ্রুস্ট ও মহম্মদের মাধ্যমে, চিনে কনফুসিয়াসের মাধ্যমে। মানুষের অন্তর্জগতে বিজ্ঞানের কোনও ভূমিকা নেই, অন্তত, আধুনিক প্রযুক্তিভিত্তিক বিজ্ঞানের। একমাত্র বিশুদ্ধ বিজ্ঞানচর্চাই এই অন্তর্জগতের হদিশ দেয়। কিন্তু ক’জনই বা সেটা আস্বাদন করতে পারেন? এইখানেই আসছে দ্বিতীয় কারণটি। এই বিপুল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে মানুষ বড়ই একা ও অসহায়। এই বিশ্বজগতের যাবতীয় ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ কার্যকারণ সম্বন্ধ বিজ্ঞান দেখাতে অক্ষম। এক সময় মনে হয়েছিল, এটি সাময়িক সীমাবদ্ধতা। বিজ্ঞানের ক্রম-অগ্রসরের মধ্যে দিয়ে এই সীমা অতিক্রম করা যাবে। কিন্তু দেখা গেল, ঘটল ঠিক তার উল্টোটাই। আধুনিক বিজ্ঞান আবিষ্কার করল এই জটিল জগতের অবশ্যম্ভাবী অনির্দেশ্যতার (আনপ্রেডিক্টেবিলিটি) কথা। আরও জানা গিয়েছে, অণু-পরমাণুদের জগতে অনিবার্য অনিশ্চয়তার কথা (হাইজ়েনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি)। ব্যক্তি মানুষ এই সমস্ত অনির্দেশ্যতার শিকার। মানুষের জীবনে কখন যে কী ঘটে, বলা যায় না। সে অসহায়। সে এমন কিছুকে আঁকড়ে ধরতে চায়, বিশ্বাস করতে চায়, যা তাকে শান্তি দেবে, স্বস্তি দেবে। ধর্মের মধ্যে, আচারের মধ্যে সে সেই আশ্রয় পায়। বিজ্ঞান এই বিশ্বাস, এই শান্তি, এই আশ্রয় তাকে দিতে পারে না।
আমার বৃদ্ধা মায়ের কথা প্রায়ই ভাবি। আজ অন্তত সত্তর বছর ধরে দেখে আসছি মা গুরুদেব নিয়ে, পুজোআচ্চা নিয়ে শান্তিতে, খুশিতে থাকেন। তাঁকে কি আমি বিজ্ঞান বোঝাতে পারব? কখনওই না। যদি নাছোড়বান্দার মতো চেষ্টা করে যাই, তাতে মা’র অশান্তিই বাড়বে। তাঁর বিশ্বাস ভেঙে দিলে তাঁর মধ্যে যে শূন্যতার সৃষ্টি হবে, বিজ্ঞান কি তাকে পূরণ করতে পারবে? তা হলে তাঁর শান্তি কেড়ে নেওয়ার অধিকার কি আমার আছে?