Advertisement
E-Paper

তাঁদের নীলে এলইডি হয়েছে সাদা, তাই নোবেল

স্মার্টফোনের কল্যাণে যে আলো ঘোরে মানুষের পকেটে-পকেটে, যে আলো কাজে লাগে কম্পিউটারের পর্দায় কিংবা টিভির পর্দায় ছবি ফোটাতে, তা উৎপাদনের কৌশল আবিষ্কার করেছিলেন ওঁরা তিন জন। ইসামু আকাসাকি (৮৫), হিরোশি আমানো (৬০) এবং সুজি নাকামুরা (৬৪)। রোশনাইয়ের দুনিয়ায় বিপ্লব আনার জন্য এ বছর পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পেলেন এই ত্রয়ী।

পথিক গুহ

শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৪ ০২:১৩
ইসামু আকাসাকি, হিরোশি আমানো এবং সুজি নাকামুরা

ইসামু আকাসাকি, হিরোশি আমানো এবং সুজি নাকামুরা

স্মার্টফোনের কল্যাণে যে আলো ঘোরে মানুষের পকেটে-পকেটে, যে আলো কাজে লাগে কম্পিউটারের পর্দায় কিংবা টিভির পর্দায় ছবি ফোটাতে, তা উৎপাদনের কৌশল আবিষ্কার করেছিলেন ওঁরা তিন জন। ইসামু আকাসাকি (৮৫), হিরোশি আমানো (৬০) এবং সুজি নাকামুরা (৬৪)। রোশনাইয়ের দুনিয়ায় বিপ্লব আনার জন্য এ বছর পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পেলেন এই ত্রয়ী।

জাপানের নাগরিক আকাসাকি এবং আমানো অধ্যাপনা করেন সে দেশের নাগোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। নাকামুরা জন্মসূত্রে জাপানি, দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন ওদেশে এক বেসরকারি সংস্থার গবেষণাগারে, এখন মার্কিন নাগরিক, অধ্যাপনা করেন সান্টা বারবারায় ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। আকাসাকি আজ যখন পুরস্কারের খবর পান, তখন তিনি ঘুমোচ্ছিলেন। খবর পাওয়ার পরে তড়িঘড়ি সাংবাদিক সম্মেলন। সেখানে তিনি বলেন, “সব কিছু যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।”

বাহারি বাতির রোশনাই থেকে শুরু করে সাদা আলো জোগানোর বাতি, কিংবা রোজকার জীবনের নানা যন্ত্রপাতির দৌলতে এলইডি অর্থাৎ লাইট-এমিটিং ডায়োড এখন অনেকেরই পরিচিত শব্দ। এলইডি থেকে লাল ও সবুজ আলো মিলেছিল বেশ কয়েক দশক আগেই। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছিল না নীল আলো। যেটা ছাড়া সম্ভব হচ্ছিল না তিন রং মিশিয়ে সাদা আলো সৃষ্টি। তাবড় তাবড় সংস্থা কয়েক দশক ধরে গবেষণা চালিয়েও যা পারেনি, সেটাই সম্ভব করেন আকাসাকি, আমানো এবং নাকামুরা। আবিষ্কার করেন এলইডি থেকে নীল আলো পাওয়ার কৌশল। আর তাতেই খুলে যায় তিন রংয়ের মিশেলে সাদা আলো দেওয়ার এলইডি তৈরির রাস্তা। আজ যে পথ-ঘাট, বাড়ি-ঘর উজ্জ্বল হয় সাদা আলোয়, তা ওই সাদা এলইডি-র কল্যাণে। অনেক কম বিজলি পুড়িয়ে ঢের বেশি আলো মেলে এই এলইডি থেকে। বিদ্যুতের সাশ্রয় তো বটেই, আরও অনেক উপযোগিতা রয়েছে এর।

তিন বিজ্ঞানীকে পুরস্কৃত করে নোবেল কমিটি তাই বলেছে, “আলফ্রেড নোবেলের ইচ্ছে মেনে এ বছরের পুরস্কার সম্মান জানাচ্ছে এমন এক আবিষ্কারকে, যা মানবজাতির চরম উপকারে লেগেছে। নীল এলইডি ব্যবহার করে নতুন কায়দায় মিলছে সাদা আলো। এসেছে এলইডি বাতি। আমাদের হাতে এখন অনেক বেশি টেকসই এবং অনেক বেশি দক্ষ আলোর উৎস। আকাসাকি, আমানো এবং নাকামুরা ১৯৯০-এর দশকে সেমিকন্ডাক্টর থেকে নীল রশ্মি উৎপাদন করে মৌলিক বিপ্লব এনেছিলেন রোশনাই প্রযুক্তিতে। পৃথিবীতে মোট বিজলির এক-চতুর্থাংশ যে-হেতু কাজে লাগে আলো জ্বালাতে, তাই সাদা এলইডি পৃথিবী জুড়ে কমায় জ্বালানি খরচ। পৃথিবীতে দেড়শো কোটি মানুষ, যাঁরা এখনও বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিজলি পান না, তাঁদের জীবনযাত্রার মান বাড়াবে এলইডি আলো, কারণ এই আলো জ্বলে কম শক্তিতে। সস্তার সৌরশক্তিতেও এ বাতি আলো দেবে ঘরে-ঘরে।”

রোশনাই প্রযুক্তির কত যে বিবর্তন দেখল মানুষ! প্রথমে পাথরে পাথর ঘষে চকমকি আলো। তার পর তেল পুড়িয়ে, সলতে জ্বালিয়ে প্রদীপ। কুড়ি হাজার বছর আগেকার কৌশল। উনিশ শতকে লাইট বাল্ব। কৌশল তখনও মোটা দাগের। সরু তার বা ফিলামেন্টে তড়িৎ পাঠিয়ে এমন গরম করে ফেলা, যাতে তা থেকে আলো ঠিকরোয়। বিজলি খরচ ঢের। কিন্তু আলো তেমন জোরদার নয়। বিশ শতকে এল টিউবলাইট বা ফ্লুরোসেন্ট বাল্ব। বিজলিতে কিছুটা সাশ্রয়, আলোও তুলনায় বেশি। এতে আলো মেলে নতুন কৌশলে। প্রায় বায়ুশূন্য কাঁচনলে ঘটাতে হয় তড়িতের স্পার্ক। ফিলামেন্ট গরম করতে হয় না বলে তাপ তৈরির কারণে বিদ্যুৎশক্তির অপচয় অনেক কম হয় এতে।

এর পর এলইডি বাতি। বিদ্যুৎ থেকে সরাসরি আলো সৃষ্টি। অনেক বেশি দক্ষ কায়দা। বিজলি খরচের হিসেবে আলো তৈরির ক্ষমতায় ফ্লুরোসেন্ট বাতি পুরনো দিনের বাল্বের তুলনায় চার গুণেরও বেশি দক্ষ। আর এলইডি বাতি ফ্লুরোসেন্টের চেয়েও পাঁচ গুণ বেশি দক্ষ। আয়ুতেও অনেক ফারাক। পুরনো দিনের বাল্ব যদি টেকে এক হাজার ঘণ্টা, তবে, ফ্লুরোসেন্ট বাল্ব আলো দেয় দশ হাজার ঘণ্টা। এলইডি বাতির আয়ু সেখানে এক লক্ষ ঘণ্টা।

লাল এলইডি-র আবিষ্কার হয়েছিল ১৯৫০-এর দশকে। তা কাজে লেগেছিল ডিজিটাল ঘড়িতে, ক্যালকুলেটরে কিংবা বৈদ্যুতিন যন্ত্রের অন-অফ দশা বোঝাতে। সবুজ এলইডি-র আবিষ্কার এর কিছু পরে। কিন্তু বেগ দিচ্ছিল নীল এলইডি। অথচ এটা না পেলে যে তিন রঙ মিশিয়ে তৈরি হবে না সাদা আলো! বিপ্লব আসবে না রোশনাই জগতে! তার উপরে হাজার হাজার কোটি ডলার মুনাফার প্রলোভন তো আছেই। নীল এলইডি আবিষ্কারের লক্ষ্যে তাই দৌড় শুরু করে বহু বহুজাতিক সংস্থা। এবং অনেক বিশ্ববিদ্যালয়। তিন দশকের তীব্র প্রতিযোগিতা। সবাই যখন ব্যর্থ, এবং প্রায় নিশ্চিত যে নীল এলইডি আর মিলবে না কখনও, তখনও হাল ছাড়েননি আকাসাকি, আমানো এবং নাকামুরা। ১৯৯০-এর দশকে এসে এই তিন বিজ্ঞানী সফল হন নীল এলইডি তৈরিতে। আকাসাকি এবং আমানো তখন গবেষণা করছিলেন নাগোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর নাকামুরা ছিলেন জাপানের বেসরকারি সংস্থা নিচিয়া কেমিক্যালস-এর কর্মী।

তিন বিজ্ঞানীর মধ্যে নাকামুরা একটু অন্য রকম। ২০০০ সালে তিনি জাপান ছেড়ে চলে যান আমেরিকায়। বলেছিলেন, “জাপানি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করে লাভ নেই। ওখানে নিয়মের এত কড়াকড়ি যে স্বাধীন ভাবে গবেষণার সুযোগ নেই।” ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতে করতেও ছেড়ে কথা বলেননি নিচিয়া কেমিক্যালস-কে। ২০০ কোটি ইয়েনের মামলা ঠোকেন সংস্থাটির বিরুদ্ধে। অভিযোগ, নীল এলইডি আবিষ্কারের জন্য পেটেন্ট থেকে প্রাপ্য যথেষ্ট অর্থ দেওয়া হয়নি তাঁকে। মামলা গড়ায় অনেক দূর। শেষমেষ নিচিয়া কেমিক্যালস ৮৪ কোটি ইয়েনে রফা করে তাঁর সঙ্গে। সেই নাকামুরা এ বার আকাসাকি, আমানোর সঙ্গে ভাগ করে নেবেন নোবেল পুরস্কারের ১১ লক্ষ ডলার।

nobel in physics isamu akasaki hiroshi amano shuji nakamura pathik guha
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy