বাসে দুই মাঝবয়সী নারীর কথোপকথনে একজনের মন্তব্য— ‘সত্যি বলছি তোর ভাগ্য খুব ভাল। আমার কাজের মেয়েটা একটা দিনও আটটার মধ্যে কাজে ঢোকে না। অথচ আমি অফিস থেকে ফিরতে না ফিরতেই বেরিয়ে যাবে। তখন হাজার বললেও একটুও দেরি করবে না।’
আরও পড়ুন: আমার দক্ষিণ ২৪ পরগনার ছাত্রীরা
আমার কলেজে আমার এক সহকর্মী খুব সন্দেহপ্রবণ। তাঁর সারা দিন মনে হয় ‘কাজের মেয়ে’টিকে তিনি যে যে কাজ দিয়ে এসেছেন, সে নিশ্চয়ই তা করছে না! তাই প্রায় আধ ঘণ্টা অন্তর অন্তর বাড়িতে ফোন করে মেয়েটি সব কাজ করছে কি না তিনি তার খবর নিতে থাকেন।
একদিন মেট্রোতে ফিরছিলাম। একটি মাঝবয়সি মেয়ে চোখ বড় বড় করে তার বন্ধুকে বলছেন, ‘ভাবতে পারবি না, সে দিন হঠাৎ দুপুরে বাড়ি ফিরে দেখি রিয়ার আয়া ওর সাথে টেবিলে বসে খাচ্ছে!’ বন্ধু তো বোধহয় এত অবাক করা কথা আগে কখনও শোনেননি। বললেন, ‘কী সর্বনাশ! এত সাহস হল কী করে? তোর না, সাথে সাথে ওকে নামিয়ে মাটিতে বসিয়ে দেওয়া উচিত ছিল।’
আরও পড়ুন: নারী দিবস ঘিরে বিতর্ক, দুই শিবিরে ভাগ সোশ্যাল মিডিয়া
এমন অনেক, আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। সারা দিন বাড়িতে না থেকে মেয়েরা নিজেদের কর্মক্ষেত্রে বসে কল্পনা করতে থাকেন, এমনকী যেন স্বচক্ষে দেখতেও থাকেন, তিনি বাড়ি না থাকার সুযোগে ‘কাজের মেয়ে’টি তার বাড়িতে কী কী অপকর্ম করে বেরাচ্ছে! অথচ মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত মেয়েদের শিক্ষা, চাকরি অর্থাৎ বহির্জগতে বিচরণের স্বপ্ন (কখনও হয়তো বাধ্যতা) কখনই সম্ভব হত না, নানা ধরনের পরিষেবা দিতে পারা এই সমস্ত ‘কাজের মেয়ে’দের, ভাল বাংলায় গৃহ-পরিচারিকাদের, ছাড়া।
আরও পড়ুন: বাধার পাহাড় পেরনোর কাহিনি লিখছে চম্পারণ
এই যে মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত মেয়েরা, যাঁরা কাজের লোক নিযুক্ত করেন এবং কাজের তদারকিও করেন, এঁদের সঙ্গে কাজের মেয়েদের এই যে একটা মুখোমুখি সম্পর্ক, যাকে দ্বন্দ্ব–সংঘাত–সংঘর্ষ যাই বলুন না কেন, কয়েকটি বিষয়ে তা আরও স্পষ্ট হয়।
যেমন ধরুন, মাইনে বাড়ানো। এক মালিক নারীর খুব আহ্লাদের কথা— ‘জানো তো, মেয়েটা ছোটবেলা থেকে আমাদের বাড়ি কাজ করছে। আর ২০ বছরে না না একবারও মাইনে বাড়ানোর কথা বলেনি। নিজেই বলে আমি তো ওদের ঘরের মেয়ের মতো।’ অথচ আমরা সবাই খুব জানি পুজোর সময় কোনও দিন বাড়ির মেয়ের কাপড় আর ওর কাপড় একদরের হবে না।
আরও পড়ুন: নারী: রবীন্দ্রনাথের চিন্তার সঙ্গে প্যাঁচ কষে গেছে জীবন
হাজারো বৈষম্যের নিদর্শন আছে। যেমন কাজের মেয়েরা যদি ছুটি চায়। ওদের ছুটি বলে তো আইনত এখনও কিছু ধার্য হয়নি। তাই কাজে না আসতে পারা মানে ওঁদের ক্ষেত্রে সেটা কামাই আর বাড়ির গৃহিণীর মুখ হাঁড়ি। কিন্তু গৃহিণীরা তো ছেড়ে কথা বলার লোক নন। তাই নো ওয়ার্ক নো পে। পাঁচ দিন কাজে আসেনি তাই হিসেব করে মাইনে কেটে নাও।
আর একটা উদাহরণ না দিলেই নয়। কর্মদক্ষতার প্রশ্ন। ‘তুমি তো দেখছি বাসন মাজতেই শেখোনি বাছা... আরে ঘরের কোনা, খাটের নীচগুলো মোছো... না দেখলেই বাপু তোমাদের ফাঁকি মারা।’ অথচ কর্মরতা মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত মেয়েরা প্রত্যেকে তাদের কর্মজগতে যথেষ্ট কর্মদক্ষতা দেখান তো? যে কাজের জন্য মাসের প্রথমে মোটা টাকা মাইনে পান, বিচার করেন তো সেই টাকার বিনিময়ে তিনি যে কাজ করেন তা যথেষ্ট কি না? আর তাছাড়া, প্রতিটি দিনই কি এক গুণমানের কাজ করা সম্ভব?
নিজেকে দিয়ে বলছি মশাই। হ্যাঁ। ওই খাঁটি বঙ্গললনার মতো নিজের কোলেই ঝোল টেনে বলছি, এ সব চিন্তা আমাদের মাথায় আসেও না, আর ‘কাজের মেয়ে’কে দিয়ে খাটিয়ে নেওয়ার ‘প্রোফেশনাল’ মানসিকতা ছাড়া আর কিছু করার কথা মনেও করি না।
লম্ফ মেরে ঝম্ফ দিয়ে একটু শেষের কথায় আসি। মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত মেয়েরা বনাম নিম্নশ্রেণির ‘কাজের মেয়ে’দের এই দ্বন্দ্ব অবশ্যম্ভাবী নয় কি? ইতিহাস কি শেষত ‘সিস্টারহুডের’ মহান বাক্যগুলিকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করেনি? জাতপাত-শ্রেণি-ধর্ম নানা পরিসরে মেয়েরা পরস্পরবিরোধী স্বার্থ নিয়ে মুখোমুখি নেমে পড়েনি? পড়েছে, এবং আবারও পড়বে।
গৃহ-পরিচারিকাদের শ্রমের স্বীকৃতি, মর্যাদা এবং অসংগঠিত শ্রমিক রূপে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ও অধিকারের যে দাবি প্রথম বিশ্ব থেকে তৃতীয় বিশ্ব, একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হিসাবে উঠে এসেছে, তাকে কেন্দ্র করেই হয়তো আবার ভাঙবে ‘সিস্টারহুডের’ ধারণা। তাহলে কী হবে? অধিকার আদায়ের লড়াই হল গিয়ে হক্ কথার এক কথা। এর চেয়ে বিশেষ কোনও উপসংহারে না গিয়ে শেষে একটা কথা বলি। আগামী ৮ই মার্চ কান পাতলে আমি এখনই মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত মেয়েদের যেন কিছু কানাকানি শুনতে পাই।
—“শুনেছিস, ওদের নাকি কাজ প্রতি ৫০০ টাকা করে দিতে হবে!
—শুধু তাই? প্রতি রবিবার ছুটি দিতে হবে!
— ওরে, আরও কী কী গাদা গাদা চাই আর চাই-এর একটা লিফলেট সে দিন আমার কাজের মেয়েটা হাতে ধরিয়ে দিল।
— বলিস কী রে! আমাদের রোজগারের টাকা তো সব এদের পিছনেই বেরিয়ে যাবে। শখ-আহ্লাদ-ফুর্তি বলে আর কিছু থাকবে না।
কথোপকথন চলতে থাকুক। তবে বন্ধুরা, আগামী ইতিহাসের এক বড় অংশ জুড়ে থাকবে ‘কাজের মেয়ে’দের অধিকার-মর্যাদা নিয়ে, উপযুক্ত আর্থিক প্রাপ্তি নিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম।
(লেখক নারী আন্দোলনের কর্মী এবং কলকাতার এজেসি বোস কলেজের বাংলার শিক্ষক)