Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

সোনালি রোদ্দুর হয়ে লক্ষ্মী ফিরে এল টোটোয়

রাতের দিকে খুব দূরের যাত্রী নেন না। তবে শহরের অলিগলিতে ঘরমুখো মানুষটাকে না নামিয়ে দিতে পারলে রাতের ভাত আর নিদেনপক্ষে সব্জির পরিপাটি আহারটুকু নিয়েও সংশয় তো থেকেই যায়। বহরমপুরের মহিলা টোটো চালক সোনালি জানা তাই রাতেও কিঞ্চিৎ ঝুঁকি নিয়েই যাত্রী নিয়ে ছোটেন।

 সোনালি জানা। বহরমপুরের রাস্তায়। নিজস্ব চিত্র

সোনালি জানা। বহরমপুরের রাস্তায়। নিজস্ব চিত্র

অনল আবেদিন
বহরমপুর শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৯ ০২:১১
Share: Save:

স্টেশনের কোল ঘেঁষে টোটো’টা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে রাতের শেষ ট্রেনের অপেক্ষায়। প্ল্যাটফর্ম-ছুট ঘরমুখো যাত্রীরা সেই টোটোর সামনে এসে অনেক সময়েই থমকে যান। বিস্ময় সামলে শেষতক প্রশ্ন করেন, ‘‘যাবেন নাকি?’’ তাতে অবশ্য সোনালির হাসিই পায়। বলেন, ‘‘যাব বলেই তো দাঁড়িয়ে আছি, কোথায় যাবেন?’’

রাতের দিকে খুব দূরের যাত্রী নেন না। তবে শহরের অলিগলিতে ঘরমুখো মানুষটাকে না নামিয়ে দিতে পারলে রাতের ভাত আর নিদেনপক্ষে সব্জির পরিপাটি আহারটুকু নিয়েও সংশয় তো থেকেই যায়। বহরমপুরের মহিলা টোটো চালক সোনালি জানা তাই রাতেও কিঞ্চিৎ ঝুঁকি নিয়েই যাত্রী নিয়ে ছোটেন।স্কুল জীবনের প্রণয় থেকেই বিয়েটা হয়েছিল তাঁর। কিন্তু বিয়ের পরে মুখোশ খুললেন স্বামী। মদ্যপ-মারধর-এমনকি স্বামীকে পথে আনতে নিজেই ঋণ নিয়ে যে টোটো কিনে দিয়েছিলেন, তাতেও মন বসেনি তার। সদা অনটনের সংসার টানতে তাই টোটো নিয়ে সরে এসেছেন সোনালি। ভোরে বেরিয়ে রাতে ফেরা— বহরমপুরের সোনালি বলছেন, ‘‘সবই সয়ে যায়। টোটো এখন পরিবারের অঙ্গ হয়ে গিয়েছে।’’

ভাড়া করা টোটোয় মালিককে দৈনিক আড়াইশো টাকায় দিতে গিয়ে হাত ফাঁকা করেই ঘরে ফিরতে হত তাঁকে। সোনালি বলছেন, ‘‘সংসারে খরচের জন্য স্বামী একটি পয়সাও দিত না। উল্টে ব্যাঙ্কের ঋণ শোধ করতে পাঁচ জনের পরিবার, পরিচারিকার কাজ করে প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা কিস্তির টাকা শোধ করেছি। বছর দেড়েক পর আর টানতে পারলাম না।’’ গত বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি ৯ বছরের ছেলের হাত ধরে স্বামীর ঘর ছাড়েন তিনি। কয়েক দিন পর স্বামীর হাত থেকে টোটো আদায় করেন। সোনালি বলেন, ‘‘কয়েক দিন খেলার মাঠে টোটো চালানো রপ্ত করে গত বছরের ৪ মার্চ থেকে যাত্রী বইছি। প্রথম দিকে কম আয় হত। এখন মোটামুটি ভালই হয়।’’ বহরমপুর শহরের খাগড়া এলাকায় তাঁর মায়ের বাড়িতে আছেন বিধবা মা ও পঞ্চম শ্রেণির পড়ুয়া ছেলে। ছেলের দু’জন গৃহশিক্ষক। সোনালি বলেন, ‘‘টোটোর উপার্জন থেকে গৃহশিক্ষককে হাজার টাকা দিয়েও এখন হাতে কিছু থাকে।’’

লক্ষ্মী মণ্ডল। জিয়াগঞ্জের রাস্তায়। নিজস্ব চিত্র

জেলার রাস্তায় ঘুরলে আরও এক সোনালির খোঁজ মেলে জিয়াগঞ্জের পথে। লক্ষী মণ্ডলের ফেরিওয়ালা স্বামীর টাকার খাঁই ছিল অস্বাভাবিক। জিয়াগঞ্জ শহরের ফুটপাথের ক্ষূদ্র ব্যবসায়ী বাবা শিবু মণ্ডল ধারদেনা করে জামাই-এর খাঁই মেটাতে দু’ লাখ টাকা দিয়েছিলে। তাতেও রেহাই মেলেনি। না পেরে শেষতক স্বামীর ঘর ছাড়েন তিনি। কোলে বছর আড়াই-এর মেয়ে। চাকরির আশা নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশ লক্ষ্মী নতুন করে শুরু করেন পড়াশোনা। কিন্তু ইতিহাসে এমএ পাশ করেও চাকরি জোটেনি। অসুস্থ বাবার চিকিৎসাও হয়নি সে ভাবে। লক্ষ্মী বলেন, ‘‘বাবা যে দিন মারা গেলেন, দেহটা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, ‘দেখ বাবা ঠিক দাঁড়িয়ে যাব!’’ শেষতক এক আত্মীয়ের কাছ থেকে সস্তায় টোটোও কিনে সেই পথেই ছুটছেন তিনি।

এখন তিন দফায় টোটো চালান তিনি। লক্ষ্মী বলেন, ‘‘রাতে বাড়ি ফেরার সময় মনে মনে বলি, দেখলে বাবা কথা রাখলাম তো!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

International Women's Day Toto public Transport
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE