Advertisement
০৩ মে ২০২৪

উত্তপ্ত অ্যাডিলেডে কোহালিকে বিদ্রুপ, এগিয়ে তবু ভারত

অ্যাডিলেড ওভালে  একটা ম্যাচ হাড্ডাহাড্ডি পরিণতির দিকে এগোচ্ছে। আর একটা ‘ম্যাচ’ মনে হচ্ছে শনিবারেই শুরু হয়ে গেল।

হুঙ্কার: অস্ট্রেলিয়ার উইকেট পড়তেই ফের আগ্রাসী বিরাট কোহালি। সঙ্গী কে এল রাহুল। শনিবার। ছবি: রয়টার্স।

হুঙ্কার: অস্ট্রেলিয়ার উইকেট পড়তেই ফের আগ্রাসী বিরাট কোহালি। সঙ্গী কে এল রাহুল। শনিবার। ছবি: রয়টার্স।

সুমিত ঘোষ
অ্যাডিলেড শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৩:৫৬
Share: Save:

অ্যাডিলেড ওভালে একটা ম্যাচ হাড্ডাহাড্ডি পরিণতির দিকে এগোচ্ছে। আর একটা ‘ম্যাচ’ মনে হচ্ছে শনিবারেই শুরু হয়ে গেল।

প্রথমটা অবশ্যই ভারত বনাম অস্ট্রেলিয়া প্রথম টেস্টের দ্বৈরথ। যেখানে তৃতীয় দিনের শেষে বৃষ্টির আতঙ্ক কাটিয়ে অ্যাডভ্যান্টেজ ভারত। দিনের শেষে ১৬৬ রানে এগিয়ে বিরাট কোহালির দল এবং যে ভাবে পিচে অফস্পিনারের আদর্শ ক্ষত তৈরি হয়েছে, যে ভাবে নেথান লায়নের বল সেই ক্ষতে পড়ে বিষাক্ত কেউটের মতো ফণা তুলছে, তা দেখে নিশ্চয়ই আর অশ্বিন হাসছেন। আর অস্ট্রেলীয় ব্যাটসম্যানেরা কেউ স্লিপে, কেউ সিলি পয়েন্টে দাঁড়িয়ে আসন্ন অগ্নিপরীক্ষার কথা ভেবে শঙ্কিত হচ্ছেন বললেও হয়তো কম বলা হয়।

দ্বিতীয় যে ‘ম্যাচ’টার কথা বলা হচ্ছে, সেটা অপ্রত্যাশিত! কোহালি বনাম অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট জনতা। এ বারে অস্ট্রেলীয় মিডিয়াতেও খুব লেখালেখি হচ্ছে ভারত অধিনায়ককে নিয়ে। সব জায়গায় বড় বড় করে শিরোনাম ‘কিং কোহালি’। শেন ওয়ার্ন থেকে রিকি পন্টিং— প্রত্যেকে বলে দিচ্ছেন, বিশ্বের এক নম্বর ব্যাটসম্যান রয়েছে ভারতের হাতে।

সেই সুর কেটে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে শনিবার দুপুরের ঘটনায়। কোহালি ব্যাট করতে নামার সময়ে গ্যালারি থেকে অস্ট্রেলীয় ক্রিকেট ভক্তদের একটা অংশ তাঁকে লক্ষ করে বিদ্রুপাত্মক ধ্বনি দিতে থাকে। ভারতীয় ক্রিকেট সমর্থকেরা তখন কোহালির নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছেন। তাই প্রথমে বোঝা যায়নি। কিন্তু ধ্বনিটা থামেনি, চলতেই থাকে। তখন বোঝা যায় যে, সকলে কোহালিকে সাদর অভ্যর্থনা জানাচ্ছে না। কেউ কেউ বিদ্রুপও করছে।

রিকি পন্টিং যা দেখে পাল্টা তোপ দাগেন নিজের দেশের সমর্থকদের উদ্দেশে। পন্টিং বলেন, ‘‘এটা ওরা কী করছে? বিশ্বের এক নম্বর ব্যাটসম্যান খেলতে নামছে, তার খেলা উপভোগ করা উচিত। তা নয়, বিদ্রুপ করছে?’’ ক্রিকেট মহলে অনেকেই পন্টিংয়ের সঙ্গে কোহালির তুলনা করেন। দু’জনেই আগ্রাসী ক্রিকেটার, সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে ভালবাসেন, মাঠের মধ্যে আক্রমণাত্মক শরীরী ভাষা। এবং, দু’জনকেই তাড়া করে বিতর্ক। ইংল্যান্ডে খেলতে গেলে পন্টিংয়ের জন্য অপেক্ষা করে থেকেছে এ রকম দর্শক বিদ্রোহ। সেই অভিজ্ঞতার কথা টেনে পন্টিং বলতে থাকেন, ‘‘আমাকে ইংল্যান্ডে কয়েক বার একই জিনিসের মুখোমুখি হতে হয়েছে। একটা কথা বলে দিতে পারি। আমার উপর এর কোনও প্রভাব পড়ত না। বিরাটের উপরেও পড়বে না।’’ নিজের দেশের দর্শকদের আচরণ নিয়ে তিনি যে মোটেও প্রসন্ন নন, এর পর সেটাও বুঝিয়ে দেন পন্টিং। বলে দেন, ‘‘এই দৃশ্যটা মোটেও দেখতে চাইনি।’’

শুধু দর্শকদের বিদ্রুপ বলেই নয়, অ্যাডিলেড ওভালের পরিবেশ এ দিন হঠাৎই উত্তপ্ত। শোনা যাচ্ছিল অস্ট্রেলীয়রা না কি স্লেজিং বন্ধ করে দিচ্ছে! কোথায় কী! ভারত দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করতেই জশ হেজ্‌লউড বার বার এসে মুরলী বিজয়কে উত্যক্ত করে গেলেন। স্লেজিংয়ের এখন নতুন নামকরণ হয়েছে অনেক দেশে। ‘ভোকাল স্প্রে’। হেজ্‌লউড— যাঁকে কি না অস্ট্রেলীয় পেসারদের মধ্যে সব চেয়ে শান্তশিষ্ট মনে হয়, তিনিই ‘স্প্রে’ করা শুরু করলেন। নিশ্চিত থাকা যায়, চতুর্থ ইনিংসে জয়-পরাজয় নিষ্পত্তির হাইভোল্টেজের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া ব্যাট করতে এলে কোহালি সুদে-আসলে তা ফিরিয়ে দেবেন।

ও দিকে অস্ট্রেলিয়ার কোচ জাস্টিন ল্যাঙ্গার আবার কটাক্ষ করে বিবৃতি দিয়েছেন, উইকেট পড়ার পরে কোহালির মতো আগ্রাসী উৎসব করলে তাঁদের নিশ্চয়ই বিশ্বের সব চেয়ে খারাপ ছেলে বলা হত। অবশ্যই বল-বিকৃতির ঝাল টেনে বলা। টুইটারে সেই মন্তব্য তুলে দেওয়ার পরে ভারতীয় ক্রিকেট সমর্থকেরা পাল্টা মন্তব্য করতে শুরু করেছেন, কোহালি উইকেট নিয়ে শুধু সেলিব্রেশনই তো করেছেন। অন্যায় কী করলেন! উইকেট নেওয়ার জন্য বলে সিরিশ কাগজ দিয়ে ঘষে প্রতারণা তো করেননি।

আর ধিকৃত কোহালি মানে যে আরও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কোহালি, সেটাও বুঝল অ্যাডিলেড। ঠিক যে সময়টা ভারতীয় দলের জন্য অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে উঠতে যাচ্ছিল, তখনই চেতেশ্বর পূজারার সঙ্গে জুটি বেঁধে রোদ্দুর ফেরালেন কোহালি। মাথার উপরে আকাশের মেঘ কেটে তখন ঝলমলে রোদ। ভারতীয় ব্যাটিংও উজ্জ্বল। পূজারা এবং কোহালির চতুর্থ উইকেটে ৭১ রানের পার্টনারশিপটা খারাপ হয়ে আসা উইকেটের চরিত্র বিচারে ১৭১ রানের সমান। এক দিকের উইকেটে ডান হাতি ব্যাটসম্যানের ঠিক গুডলেংথ স্পটে মারাত্মক ক্ষত তৈরি হয়েছে। অফস্পিনারের জন্য মোক্ষম স্পট সেটা। নেথান লায়নকে উল্টো দিক থেকে বল করানো হল এবং যখনই ক্ষতের আশেপাশে বল ফেলতে পেরেছেন অস্ট্রেলীয় অফস্পিনার, ফোঁস করে ছোবল দিতে এসেছে সাপ। কোহালির উইকেটটাও তুললেন ও ভাবেই। ক্ষতে পড়ে লাফিয়ে ভারত অধিনায়কের গ্লাভস ছুঁয়ে ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে জমা পড়ল। সাউদাম্পটনে ঠিক এ ভাবেই পিচের উপর তৈরি হওয়া স্পটে ফেলে তাঁকে আউট করেছিলেন মইন আলি।

দিনের খেলা শেষ হতে না হতেই এরটা দৃশ্য দেখা গেল। একটা কোণে একটা স্টাম্প পুঁতে বল করে যাচ্ছেন অশ্বিন। বোঝাই যাচ্ছে, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে সাউদাম্পটনে অফস্পিনারের ‘স্পট’ পেয়েও জেতাতে না পারার আক্ষেপ ঘোচাতে চান। আর সেই কথাটা শুনতে চান না যে, দলের এক নম্বর স্পিনার হয়েও তিনি বিদেশের মাঠে টেস্ট জেতাতে পারেন না।

জয়ের জন্য অশ্বিনের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে নিশ্চয়ই। কিন্তু তারও আগে বলতে হবে জয়ের ভিত গড়ে দিয়ে যাওয়া নিঃশব্দ যোদ্ধার কথা। তিনি, চেতেশ্বর পূজারা— দু’বার লায়নের বলে ডিআরএস নিয়ে বাঁচলেন। দিনের শেষে ৪০ অপরাজিত। সঙ্গে হেলমেটে ঘটাং করে এক বার বল লাগা অজিঙ্ক রাহানে। প্রথম ইনিংসের পরে এ বারেও টানছেন তিনি। রবিবার সকালেও যদি দেওয়াল হয়ে দাঁড়াতে পারেন পূজারা, দু’টো উপকার হবে। এক) লিডকে ধীরে ধীরে ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে যাওয়া যাবে এবং দুই) অস্ট্রেলীয়দের মনোবলও ততই ধ্বংস হতে থাকবে।

ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের আশা বাড়িয়ে তোলার জন্য একটা তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। অ্যাডিলেডে টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে ২০০ রানের উপর তাড়া করে অস্ট্রেলিয়া জিতেছে এক বারই। সেটাও সেই ১৯০২ সালে! পিচ, পরিবেশ, পরিস্থিতি, পরিসংখ্যান— সবই কোহালিদের দিকে। তবু ক্রিকেট যে মহান অনিশ্চয়তার খেলা, কে ভুলতে চাইবে! অস্ট্রেলিয়া এখনও বিশ্বাস করতে চাইবে, রবিবার সকালে পূজারা আর রাহানেকে দ্রুত তুলে নিতে পারলেই ম্যাচে তারা ফিরে আসতে পারবে। ভারত মনে করতে চাইবে, আড়াইশোর উপর ‘লিড’ নিয়ে যেতে পারলেই ক্রমশ ম্যাচ থেকে হারিয়ে যাবে প্রতিপক্ষ। পূজারা-কোহালি পার্টনারশিপের জন্য অ্যাডিলেডে ভারত হয়তো কিছুটা এগিয়ে। কিন্তু বিজয় মঞ্চে পৌঁছতে অনেক রাস্তা যাওয়া এখনও বাকি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE