Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

বিরাট জয়ে ম্যাচ উইনারের ব্যাটন বদল অন্য হাতে

চিপক, তুমি কি কখনও দেখেছ বাইশ গজে পূর্বসূরির হাত থেকে উত্তরসূরির হাতে চলে যাচ্ছে ম্যাচ উইনারের ব্যাটন? চিপক, তুমি কি কখনও দেখেছ বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ফিনিশার তাঁর অস্তমিত দিনেও কী ভাবে ‘নতুন ফিনিশার’কে দেখিয়ে দিচ্ছে, ম্যাচের শেষ ওভার পর্যন্ত থাকতে হয়?

নায়ক: চেন্নাইয়ে হার্দিক-রাজ। প্রথমে ব্যাট হাতে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির সঙ্গে জুটিতে, পরে মাতালেন বোলার হার্দিক পাণ্ড্যও। উল্লসিত অধিনায়ক বিরাট কোহালি। ছবি: পিটিআই।

নায়ক: চেন্নাইয়ে হার্দিক-রাজ। প্রথমে ব্যাট হাতে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির সঙ্গে জুটিতে, পরে মাতালেন বোলার হার্দিক পাণ্ড্যও। উল্লসিত অধিনায়ক বিরাট কোহালি। ছবি: পিটিআই।

কৌশিক দাশ
চেন্নাই শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৩:১৩
Share: Save:

চিপকের বাইশ গজ অনেক ঐতিহাসিক দৃশ্যের সাক্ষী থেকেছে। কিন্তু চিপক, এমন দৃশ্য কি দেখেছ, যেখানে পরম্পরার হাতবদল হচ্ছে?

চিপক, তুমি কি কখনও দেখেছ বাইশ গজে পূর্বসূরির হাত থেকে উত্তরসূরির হাতে চলে যাচ্ছে ম্যাচ উইনারের ব্যাটন?

চিপক, তুমি কি কখনও দেখেছ বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ফিনিশার তাঁর অস্তমিত দিনেও কী ভাবে ‘নতুন ফিনিশার’কে দেখিয়ে দিচ্ছে, ম্যাচের শেষ ওভার পর্যন্ত থাকতে হয়?

চিপক, তুমি আজ ভারতীয় ক্রিকেটের দুই যুগের এমন সঙ্গম দেখলে যা খুব কমই এ ভাবে অকপটে ফুটে ওঠে।

ইনিংসের ষোলো নম্বর ওভারে সেই অতি পরিচিত চেহারাটাকে নামতে দেখা গেল। সেই গাট্টাগোট্টা, নির্লিপ্ত মুখের মানুষটা। যাঁকে দেখে চিরকাল আবেগে ভেসেছে ভক্তরা। আর চিপক তো বেশি করে ভাসবেই। কারণ এই চিপক যে সেই মানুষটার কাছে ঘরের চেয়েও যে বেশি আপন।

গ্যালারি গর্জে উঠল— ধোনি, ধোনি, ধোনি।

ভারত জয়ী ২৬ রানে (ডিএল)

সেরা হার্দিক পাণ্ড্য ৬৬ বলে ৮৩ রান

এর ঠিক পাঁচ ওভার পরের কথা। স্কোরবোর্ড দেখাচ্ছে, ৮৭ রানে ৫। লম্বা, ছিপছিপে শরীরটাকে দেখা গেল হেঁটে আসছে পিচের দিকে। গ্যালারির যাবতীয় আবেগ তখন জমে উঠছিল ঘরের মানুষটাকে ঘিরে। কিন্তু ম্যাচ যত এগোতে থাকল, সেই আবেগের স্রোতটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে দিতে থাকলেন বছর তেইশের ছেলেটা। একটার পর একটা বল আছড়ে পড়তে লাগল চিপকের নানা প্রান্তে।

আর গ্যালারি গর্জে উঠল— হার্দিক, হার্দিক, হার্দিক।

এর পরে ১১৬ বল মাঠে ছিলেন ওই দু’জন। ফিনিশার এবং নয়া ফিনিশার। মহেন্দ্র সিংহ ধোনি এবং হার্দিক পাণ্ড্য। অস্ট্রেলীয় বোলিং আক্রমণকে সামলে তুললেন ১১৮ রান। কিন্তু এ একেবারেই নিছক শুষ্ক একটা পরিসংখ্যান। যা দিয়ে ক্রিকেট রোমান্টিসিজম বোঝানো সম্ভব নয়।

এক জন যেন সেই চ্যাম্পিয়ন বক্সার। যাঁকে জীবনের শেষ ক’টা লড়াইয়ে আবার শ্রেষ্ঠত্বের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। তিনি বিপক্ষের ঘুসি শরীরে নিলেন, একের পর এক আঘাত সহ্য করে গেলেন, কিন্তু রিংয়ে ভেসে বেরালেন সেই অশরীরীর মতো, যাঁকে দেখা যাচ্ছে, ছোঁয়াও যাচ্ছে কিন্তু নক আউট করা যাচ্ছে না। ধোনি নামার সময় স্কোরটা দেখলেন ৪ উইকেটে ৬৪। তিনি মাথা নামিয়ে আঘাত নিতে তৈরি হলেন। ডিফেন্স করলেন, পরাস্ত হলেন, খুচরো রান নিয়ে বেঁচে রইলেন। তার পরে শেষ মুহূর্তে জ্যাবটা মারলেন। জেমস ফকনারের করা ৪৮তম ওভারে দু’টো চার একটা ছয়— উঠল ১৬। ৫০তম ওভারে এল আরও একটা ছয়, একটা চার। ইনিংসের শেষ ওভারে ধোনি যখন আউট হলেন, তাঁর নামের পাশে ৮৮ বলে ৭৯, চারটে বাউন্ডারি, দু’টো ওভারবাউন্ডারি। সঙ্গে আরও বার্তা— ফিনিশার মানে যে ফিনিশ করে।

হার্দিকের তরুণ রক্তে জোশ আছে, অভিজ্ঞতা কম। তিনি দাঁড়িয়ে মার খাওয়ার বান্দা নন। পাল্টা মারের রাস্তায় তিনি বেছে নিলেন লেগ স্পিনার অ্যাডাম জাম্পাকে। কোথাও কোথাও বলা হয়, ৬৬৬ নাকি শয়তানের নম্বর। তা, আমাদের হার্দিক এই নম্বরটা খুব বেশি ভালবাসেন। তিনি ইমদ ওয়াসিম, শাদাব খান, মালিন্দা পুষ্পকুমার এবং রবিবারের জাম্পা— এঁদের সবাইকেই ভালবেসে ওই ৬৬৬ স্টাম্প তাদের বুকে সেঁটে দিয়েছেন। এ দিন জাম্পার ওই ওভারে ছয়ের হ্যাটট্রিক-সহ উঠল ২৪ রান।

ব্যাট সুইং নিখুঁত। টাইমিং নিখুঁত, ব্যাট স্পিডে একশোয় প্রায় একশো। না হলে মার্কাস স্টয়নিসকে ও রকম গল্ফের সুইংয়ের মতো ব্যাট চালিয়ে লং অনের ওপর দিয়ে গ্যালারিতে ফেলা যায় না। কিন্তু তাও হার্দিক যে এখনও নয়া ফিনিশার! বিপক্ষকে একটার পর একটা পাঞ্চে বিপর্যস্ত করেও মুখের সামনে থেকে হাতটা আনমনে নামিয়ে নিলেন। ডিফেন্সটা একটু আলগা হয়ে গেল। কাউন্টার জ্যাবটাও এল ওই সামান্য ভুলের সুযোগ নিয়ে। জাম্পা বলটা একটু টেনে দিয়েছিলেন। অ্যাক্রস খেলার কোনও দরকার ছিল না। কিন্তু হার্দিক খেললেন। এবং ক্যাচ দিয়ে গেলেন শর্ট থার্ডম্যান অঞ্চলে।

হার্দিক নিজেও বলে থাকেন, আমি ধোনির কাছ থেকে শিখতে চাই ম্যাচ ফিনিশ করার রেসিপি। তা রবিবার সেই শেখার সুযোগ তিনি পর্যাপ্ত পেয়েছেন। ১১৮টা বল কম কথা নয়। হার্দিক নিশ্চয়ই বুঝেছেন, ইট’স নট ওভার টিল ইট’স ওভার। দ্য লাস্ট ম্যান স্ট্যান্ডিং অলওয়েজ উইনস। শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছুই শেষ হয় না। শেষ পর্যন্ত তোমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। তবেই তো তুমি জিতবে। তা সে যতই নামের পাশে ৬৬ বলে ৮৩ দেখাক না কেন। সঙ্গে পাঁচটা চার, পাঁচটা ছয়-সহ। শেষ পর্যন্ত স্কোরবোর্ডে ২৮১-৭ উঠল ওই ফিনিশার ছিল বলে।

রানটা চেন্নাইয়ের পিচে কঠিনই ছিল। বল ঘুরছিল। ভারতের হাতে দুই রিস্ট স্পিনার। তার ওপর বৃষ্টিতে ওভার কমে খেলা দাঁড়ায় ২১ ওভারে। টার্গেট ১৬৪। ওই অবস্থায় একবার গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের মার ছাড়া ভারতকে কিছুই আর চাপে ফেলেনি। অস্ট্রেলিয়া থেমে গেল ১৩৭-৯ স্কোরে। ইডেনে নামার আগে ভারত ১-০ এগিয়ে।

কিন্তু চিপক, তুমি যে আরও দু’টো অর্থবহ দৃশ্য দেখে নিলে।

দেখলে, মহেন্দ্র সিংহ ধোনি উইকেটের সামনে যে রকম, পিছনে সে রকমই নির্ভরতা দিচ্ছেন। শরীর ছুড়ে ক্যাচ নিচ্ছেন। বিদ্যুৎ গতিতে স্টাম্প করছেন। যা দেখে প্রেসিডেন্ট বক্সে বসে থাকা নারায়ণস্বামী শ্রীনিবাসনও নিশ্চয়ই হাততালি দিয়েছেন।

দেখলে, সত্যিকারের এক অলরাউন্ডারের উত্থান। যে ব্যাটে ঝড় তোলার পাশাপাশি দুরন্ত গতিতে বলটাও করছেন। তুলে নিচ্ছেন স্টিভ স্মিথ, ট্রাভিস হেড-দের উইকেট।

কপিলদেব নিখাঞ্জও কি দেখলেন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE