Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
বোর্ডের নোংরা রাজনীতিতে গৌণ এখন দলের স্বার্থও

ডায়ানাদের চরম মনোভাব নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে ভারতীয় দলেও

বিতর্কের দাবানলে আক্রান্ত দুই ক্রিকেটারকে ছাড়া রবিবার ভারতীয় দল সিডনি থেকে অ্যাডিলেড পৌঁছল। সেখানে ০-১ পিছিয়ে থাকা অবস্থায় বিরাট কোহালিরা দ্বিতীয় এক দিনের ম্যাচ খেলতে নামবেন মঙ্গলবার।

বিপন্ন: হার্দিককে নিয়ে উৎকণ্ঠা ভারতীয় শিবিরেও। ফাইল চিত্র

বিপন্ন: হার্দিককে নিয়ে উৎকণ্ঠা ভারতীয় শিবিরেও। ফাইল চিত্র

সুমিত ঘোষ 
শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৯ ০৩:৪৪
Share: Save:

হার্দিক পাণ্ড্য এবং কে এল রাহুলকে নিয়ে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের অভ্যন্তরে নোংরা রাজনীতি ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। বলা হচ্ছে, হার্দিকরা গিয়েছিলেন যে শো-তে তার নাম ‘কফি উইথ কর্ণ’। কিন্তু এখন বোর্ডের সৌজন্যে পুরো তামাশাটা এমন জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এই এপিসোডের নামকরণ হওয়া উচিত ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লাফটার শো’।

বিতর্কের দাবানলে আক্রান্ত দুই ক্রিকেটারকে ছাড়া রবিবার ভারতীয় দল সিডনি থেকে অ্যাডিলেড পৌঁছল। সেখানে ০-১ পিছিয়ে থাকা অবস্থায় বিরাট কোহালিরা দ্বিতীয় এক দিনের ম্যাচ খেলতে নামবেন মঙ্গলবার। হার্দিক ও রাহুলকে দেশের বিমানে তুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গুরুতর প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, যে ভাবে ভারতীয় বোর্ড আভ্যন্তরীণ রাজনীতির জেরে স্বৈরাচারী ভঙ্গিতে দুই ক্রিকেটারকে অপরাধী সাজিয়ে ইতিমধ্যেই কাঠগড়ায় তুলে দিয়েছে, তা নিয়ে। কারও কারও মনে পড়ছে, আইপিএলে স্পট ফিক্সিংয়ে দিল্লি পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পরে শ্রীসন্থদের পাবলিক প্যারেড করানোর ঘটনা। হার্দিকরা ম্যাচ গড়াপেটার মতো গুরুতর অপরাধ না করলেও বোর্ড সম্পূর্ণ বেআইনি ভাবে তাঁদের উন্মত্ত জনতার হাতে তুলে দিতে চাইছে।

প্রশ্ন নম্বর ১) টক শো-তে কে এল রাহুল খুব আপত্তিজনক কোনও মন্তব্য করেছেন বলে প্রমাণ নেই। হার্দিক করেছেন। কিন্তু তাঁদের দু’জনকে একই রকম শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। তা-ও তাঁদের মন্তব্যের সঙ্গে ক্রিকেটের কোনও সম্পর্ক নেই। ক্রিকেট বোর্ডের কোড অফ কন্ডাক্টও এক্ষেত্রে বলবৎযোগ্য কি না, তা নিয়ে বোর্ডের প্রাক্তন আইনজীবীরা প্রশ্ন তুলেছেন। তা হলে ক্রিকেট বোর্ড কোন আইনে শাস্তি দিচ্ছে?

প্রশ্ন নম্বর ২) হার্দিকদের মন্তব্য প্রবল ভাবে নিন্দনীয় সন্দেহ নেই। কিন্তু বোর্ডের তরফে কী ভাবে শাস্তিযোগ্য, তা বিচার করা দরকার। এই মুহূর্তে বোর্ডের কোনও ওম্বাডসম্যানও নেই যে, তিনি এ নিয়ে রায় দেবেন। বোর্ড জানিয়েছে, তদন্ত কমিটি গড়া হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, কমিটি হওয়ার আগেই ডায়ানা এডুলজি বলা শুরু করেছেন, দুই ক্রিকেটারকে চরম শাস্তি দেওয়া দরকার। দেশের সর্বোচ্চ আদালত নিযুক্ত প্রতিনিধি কী করে আইন নিজের হাতে তুলতে পারেন?

প্রশ্ন নম্বর ৩) বোর্ড থেকে তদন্ত কমিটি গড়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কমিটি কী নিয়ে তদন্ত করবে? কারও মন্তব্য নিয়ে কি তদন্ত হয়? তদন্ত কমিটিতে যাঁরাই থাকুন না কেন, তাঁরা কি অনুষ্ঠানের ‘হোস্ট’ কর্ণ জোহরকে ডাকবেন? যদি ডাকেন, কর্ণ কি আসতে বাধ্য? কর্ণকে তদন্ত কমিটির সদস্যরা কী প্রশ্ন করবেন?

আরও পড়ুন: হার থেকে শিখতে চান রোহিত

হাস্যকর সব পরিস্থিতিতে আরও বাঁক এসে পড়ছে। এর মধ্যেই প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে বোর্ডের অন্দরমহলের নোংরা রাজনীতি। শ্রীনিবাসনের মতো কর্তাদের মৌরসিপাট্টা শেষ করার জন্য এবং লোঢা কমিটির সুপারিশ মেনে সুপ্রিম কোর্ট চার সদস্যের কমিটি অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর্স (সিওএ) গড়ে দিয়েছিল। তাতে কমিটি প্রধান হিসেবে ছিলেন বিনোদ রাই। অন্য তিন সদস্য ছিলেন ডায়ানা এডুলজি, রামচন্দ্র গুহ এবং বিক্রম লিমায়ে। সেটা ছিল জানুয়ারি, ২০১৭। দু’বছর পরে সিওএ হয়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র দুই সদস্যের। আছেন শুধু বিনোদ রাই এবং ডায়ানা এডুলজি। এবং, কোনও ব্যাপারেই তাঁরা একমত হতে পারছেন না। বরং পারস্পরিক সম্পর্কে এমনই তিক্ততা এসে গিয়েছে যে, অতীতের জগমোহন ডালমিয়া বনাম আই এস বিন্দ্রা বা এন শ্রীনিবাসন বনাম শশাঙ্ক মনোহর অথবা শ্রীনিবাসন বনাম ললিত মোদীর সংঘাতকে মনে করিয়ে দিতে পারে। তাই প্রশ্ন উঠছে, দেশের সর্বোচ্চ আদালত নিযুক্ত পর্যবেক্ষকরাও সেই পুরনো বোর্ড কর্তাদের মতো আচরণ শুরু করলেন কি না? এখানেই শেষ নয়। বিশ্বস্ত সূত্রের খবর, রাইকে প্যাঁচে ফেলার জন্য ডায়ানা এখন প্রচ্ছন্ন সমর্থন (ওয়াকিবহাল মহলে কারও কারও মতে প্রচ্ছন্ন নয়, প্রকট) করে যাচ্ছেন লোঢা কমিটির সুপারিশে ব্রাত্য হয়ে পড়া বোর্ড কর্তাদের। এঁদের কেউ কেউ বংশানুক্রমিক ভাবে রাজ্য সংস্থার প্রধান থেকে গিয়েছেন তিরিশ বছরের উপরে। কেউ ক্ষমতায় থেকে বছরের পর বছর ধরে নানা আর্থিক নয়ছয় আর অপশাসন চালিয়েছেন এবং এখনও লোঢা কমিটির সুপারিশ মেনে প্রশাসন থেকে বিদায় নিতে তীব্র অনীহা।

হার্দিকদের নিয়ে কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে তা নিয়েও তীব্র গোল বেঁধেছে বিনোদ রাই এবং ডায়ানা এডুলজির মধ্যে। আইনি জটিলতার কথা মাথায় রেখে রাই অনেক নরমপন্থী। তিনি প্রতিনিয়ত ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্টের সঙ্গেও কথা বলে চলেছেন। তাঁদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন যে, আইনি প্রথা মেনেই দুই ক্রিকেটারের বিচার করা হবে। কিন্তু ডায়ানা চরমভাবাপন্ন। শোনা যাচ্ছে, রাই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, তিনি এই প্রক্রিয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবেন যদি না আইনি পথে চলা হয়।

দুই ক্রিকেটারকে অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরিয়ে আনা নিয়ে শনিবার গভীর রাত পর্যন্ত নাটক চলে। ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট বোর্ডকে জানায়, বিশ্বকাপের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে। হার্দিক বিশ্বকাপের দলে গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। বিতর্কের দাবানলে পুড়তে শুরু করেছেন তিনি। চরম মানসিক অশান্তিতে রয়েছেন তরুণ অলরাউন্ডার। এর পর যদি তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়, তা হলে মানসিক ভাবে একেবারে দুমড়ে পড়বেন তিনি। টিম ম্যানেজমেন্ট থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়, হার্দিকদের যা শাস্তি দেওয়া হচ্ছে হোক। কিন্তু দেশে না ফিরিয়ে দলের সঙ্গে থাকতে দেওয়া হোক। তার পরে তদন্ত কমিটির সামনে যখন তাঁদের হাজিরা দিতে বলা হবে, তাঁরা উপস্থিত হবেন। হার্দিকদের মন্তব্যের সঙ্গে দল যে একমত নয়, তা কোহালি স্পষ্ট করে দিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের শাস্তি নিয়ে যে নোংরামি হচ্ছে তাতেও ভারতীয় টিম ম্যানেজমেন্ট প্রসন্ন নয়। বিশ্বস্ত সূত্রের খবর, রাই টিম ম্যানেজমেন্টের বক্তব্য মানতে রাজি থাকলেও ডায়ানা আপত্তি তোলেন। এমনকি, ঘনিষ্ঠ মহলে নাকি ডায়ানা এমনও বলেছেন যে, হার্দিক এবং রাহুলকে প্রয়োজনে এক বছরের জন্য নির্বাসিত করা হোক। সেটা করা হলে তাঁদের বিশ্বকাপে খেলাও আটকে যাবে। কেউ কেউ যা শুনে অবাক হয়ে যাচ্ছেন যে, তদন্ত কমিটি গড়ার আগেই কী করে বোর্ডের প্রতিনিধি এমন কথা বলতে পারেন!

ভারতীয় দলের অন্দরমহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে ডায়ানার চরমপন্থী মনোভাব নিয়ে। ক্রমশ যদি তা বিদ্রোহের আকার নেয়, অবাক হওয়ার থাকবে না। ইতিমধ্যেই কেউ কেউ বলতে শুরু করেছেন, ‘‘আমাদের যদি ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশন থাকত, এত সহজে কেউ বুলডোজার চালিয়ে দিয়ে চলে যেতে পারত না!’’ লোঢা কমিটির সুপারিশে সব চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল ক্রিকেটার্স অ্যাসোসিয়েশনের উপরে। ভারতীয় বোর্ডের কর্তারা কোনও কালেই চাননি ক্রিকেটারদের জোট সংঘবদ্ধ হোক। কর্তারা ভালই জানতেন, ক্রিকেটারেরা ঐক্যবদ্ধ হওয়া মানে তাঁদের অস্তিত্ব সংকট দেখা দিতে পারে। কিন্তু হার্দিকদের ঘটনায় ফের আলোচনায় চলে এসেছে ক্রিকেটারদের সংস্থার প্রয়োজনীয়তা।

আইনজ্ঞরা বলছেন, হার্দিকদের শাস্তি দেওয়ার এক্তিয়ার নেই বোর্ডের। ভবিষ্যতের কথা ভেবে ক্রিকেটারেরা নিয়ামক সংস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারছেন না, তাই। না হলে আইনি পদক্ষেপ করলে পাল্টা প্যাঁচে পড়তে পারে বোর্ড। ডায়ানা এডুলজিদের সেটা

কে বোঝাবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE