Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

বিশ্বকাপ শেষ বাঙালির, মেসি-বিদায়ে শোকের ছায়া কলকাতায়

সংযুক্ত সময়ে যখন সের্খিয়ো আগুয়েরো হেডে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে গোল করে ফল ৩-৪ করলেন, তখন দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র শঙ্খদীপ ভাদুড়ি পকেট থেকে মেসির ছবি বের করে কপালে ঠেকাল।

অতিথি: পল্লীশ্রীর এনএসসি স্পোর্টস ক্লাবে হতাশ আর্জেন্টিনা সমর্থকদের সঙ্গে খেলা দেখছেন দীপেন্দু বিশ্বাস। শনিবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

অতিথি: পল্লীশ্রীর এনএসসি স্পোর্টস ক্লাবে হতাশ আর্জেন্টিনা সমর্থকদের সঙ্গে খেলা দেখছেন দীপেন্দু বিশ্বাস। শনিবার। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

দীপেন্দু বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০১৮ ০৬:৩২
Share: Save:

প্রিয় ফুটবলার লিয়োনেল মেসি খেলছেন। তাই নীল-সাদা শাড়ি পরে পল্লীশ্রীর এনএসসি স্পোর্টস ক্লাবে বিশ্বকাপের প্রি-কোয়ার্টার ফাইনাল দেখতে বসেছিলেন গৃহবধূ পাপিয়া সেনগুপ্ত।

দ্বিতীয়ার্ধে তাঁর দল আর্জেন্টিনা যেই ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ২-১ এগিয়ে গেল, উচ্ছ্বাসে ডান হাত মুঠো করে শূন্যে ছুড়লেন তিনি। বললেন, ‘‘ম্যাচ এ বার আমাদের। পরের লক্ষ্য কোয়ার্টার ফাইনাল।’’ যদিও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। খেলা শেষ হতেই টিভিতে অশ্রুসজল লিয়ো মেসিকে দেখেই আঁচলে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙে পড়লেন পাপিয়াদেবী।

সংযুক্ত সময়ে যখন সের্খিয়ো আগুয়েরো হেডে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে গোল করে ফল ৩-৪ করলেন, তখন দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র শঙ্খদীপ ভাদুড়ি পকেট থেকে মেসির ছবি বের করে কপালে ঠেকাল। খুদে মেসি সমর্থকের আর্তি, ‘‘লিয়ো আর দেড় মিনিট। দয়া করে একটা গোল কর। বাঁচাও আর্জেন্টিনাকে।’’

স্বপ্নভঙ্গ: কাজানে বিষণ্ণ আর্জেন্টিনা ভক্ত। ছবি: গেটি ইমেজেস

এর কিছু পরেই খেলা শেষ। বিশ্বকাপে মেসিদের বিদায়ে তখন গোটা পাড়ায় নেমে এসেছে শ্মশানের স্তব্ধতা। ক্লাবের দুই কর্তা শিবঙ্কর সেনগুপ্ত এবং বিপ্লব দত্ত তখন হাহাকার করছেন। ‘‘সারা দিন ধরে নীল-সাদা পতাকা আর কাগজ দিয়ে গোটা ক্লাবটা সাজিয়েছিলাম। আমাদের বিশ্বকাপ আজ রাতেই শেষ হয়ে গেল। এ বছর আর বিশ্বকাপ দেখব না।’’ গলায় এক রাশ দুঃখ। সঙ্গে উঠে আসে হতাশা। ‘‘মেসি কিন্তু মারাদোনা নয়। আর আমাদের কোচ সাম্পাওলি না দলে নিলেন ইকার্দিকে,না ব্যবহার করলেন পাওলো দিবালাকে!’’

বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে ফ্রান্সের কাছে হারের পরে এটা শুধু পল্লীশ্রীর গাঁধী কলোনির ছবি নয়। গোটা কলকাতার আর্জেন্টিনা সমর্থকদের একটা খণ্ডচিত্র।

মিশেল প্লাতিনি বনাম দিয়েগো মারাদোনার দেশের সম্মুখসমর উপভোগ করতে স্টুডিয়ো থেকে বেরিয়েই পৌঁছে গিয়েছিলাম পল্লীশ্রীর এই ক্লাবে। শুক্রবার সকালেই রাশিয়া থেকে কলকাতা ফিরেছি। বুধবার রাতে স্টেডিয়ামে বসে দেখে এসেছি মেসির সেই অনবদ্য গোল। তাই এনএসসি ক্লাবে ঢুকতেই ওই পাড়ার আর্জেন্টিনার সমর্থকরা জানতে চাইছিলেন রাশিয়ার গল্প, মেসির কথা।

ওঁদের উৎসাহ দিতে বলছিলাম, আর্জেন্টিনার নাগরিক সেবাস্তিয়ান আইমারের কথাটা। যাঁর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছে এ বারের বিশ্বকাপে গিয়ে। গত বুধবার আমার পাশে বসেই মেসিদের নাইজিরিয়া জয় দেখেছেন সেবাস্তিয়ান। মেসি এই বিশ্বকাপে তেরোতম প্রয়াসে গোলের খাতা খোলার পরে তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘‘তেরোর গেরো কাটিয়ে ফেলল লিয়ো। এ বার গোলের পর গোল করে দলকে ফাইনালে নিয়ে যাবে।’’

এ দিন সেই তেরো মিনিটেই যখন ফ্রান্সের আঁতোয়া গ্রিজ়ম্যান পেনাল্টিতে ফরাসিদের এগিয়ে দিলেন, মনে পড়ছিল সেবাস্তিয়ানের মুখটাই। বেচারা এই ম্যাচও দেখতে গিয়েছে কাজ়ানে। গত দুই বিশ্বকাপে স্টেডিয়ামে বসে, আর্জেন্টিনার ম্যাচ দেখার অভিজ্ঞতার নিরিখে জানি, প্রিয় দল পিছিয়ে পড়লেও স্টেডিয়ামে কখনও থামে না ‘ভামোস ভামোস আর্জেন্টিনা’ স্লোগান।

কিন্তু এ দিন ফ্রান্সের প্রথম গোলের পরে সেই উৎসাহ মিইয়ে গিয়েছিল এনএসসি স্পোর্টস ক্লাবে। মেসি সমর্থকরা মুষড়ে পড়েছিলেন। কিন্তু প্রথমার্ধের একদম অন্তিম লগ্নে অ্যাঙ্খেল দি মারিয়া বাঁ পায়ে ২৫ গজের দূরপাল্লার দুরন্ত শটে সমতা ফেরাতেই জেগে উঠেছিল আর্জেন্টিনার নীল-সাদা রঙে সেজে ওঠা ক্লাবঘর।

এতক্ষণ ক্লাবের আর এক শীর্ষকর্তা ভাস্কর সান্যাল অনর্গল টিপ্পনি কাটছিলেন পাড়ার আর্জেন্টিনা সমর্থকদের। গোল হতে সেই ব্রাজিল সমর্থক ভাস্করবাবুকে জোর করে আর্জেন্টিনার জার্সি পরিয়ে ছাড়লেন মেসি সমর্থকরা। গোটা ক্লাব তখন লাফাচ্ছে, নাচছে। ঘুরে দাঁড়ানোর আনন্দে মেসি-অনুরাগীরা তখন মাতোয়ারা। দেখলাম পাড়ার বেশ কয়েকজন মাসিমা-মেসোমশাইও সব কাজ চুকিয়ে বসে গিয়েছেন মেসির জয় দেখতে।

দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই যখন মার্কোস রোহোকো বসিয়ে আর্জেন্টিনা কোচ হর্হে সাম্পাওলি ফেদেরিকো ফাজিয়োকে নামাচ্ছেন তখনই হে হে করে উঠলেন, নবম শ্রেণীয় ছাত্রী শ্রেয়া গঙ্গোপাধ্যায়। আশঙ্কিত গলায় তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘এই পরিবর্তনটা কিন্তু ঠিক হল কি? রোহো না থাকলে রক্ষণে কিন্তু চাপ বাড়বে।’’ আর শেষ পর্যন্ত হলও তাই। আর্জেন্টিনা রক্ষণে এই পরিবর্তনের ফলেই বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যেতে হল মেসিদের।

তবে তার আগেই সেট পিস থেকে মেসির শট তাঁর দলের রাইটব্যাক গ্যাব্রিয়েল মের্কাদোর পায়ে লেগে ২-১ এগিয়ে দিয়েছে আর্জেন্টিনাকে। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে নীল-সাদা উৎসবের প্রস্তুতিও শুরু করে দিয়েছেন বঙ্গ-আর্জেন্তিনীয় সমর্থকরা। কিন্তু পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা উত্তেজনাকর এই ম্যাচে আর্জেন্টিনার উচ্ছ্বাস যে পরের ২০ মিনিটে ভূপতিত করবেন কিলিয়ান এমবাপে তা কে জানতেন!

ফাজিয়োদের রক্ষণের ভুলত্রুটির সুযোগ নিয়ে প্রথমে বেঞ্জামিন পাভার্দ ডান পায়ের হাফভলিতে যে দুরন্ত গোলটা করলেন সেটাই ম্যাচ নিয়ে গেল গ্রিজ়ম্যানদের শিবিরে। পাশে বসা দশম শ্রেণীর ছাত্র শুভ হাজরা ও দেবব্রত সান্যাল তখন গজগজ করছিলেন, ‘‘ধুর, বক্সের সামনে মার্কিংটাই তো ঠিক নেই।’’

আর তার পরে চার মিনিটের ব্যবধানে প্যারিস সাঁ জারমঁ-তে দি মারিয়ার সতীর্থ এমবাপের জোড়া গোল। আর সেখান থেকেই মেসি সমর্থকদের উল্লাস কর্পূরের মতো উবে যাওয়া শুরু।

প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম ম্যাচেই নব্বই মিনিটে সাত গোল। জোড়া গোল করে নকআউটে পেলে, মাইকেল আওয়েনের পরে ‘টিনএজার’ তারকা হিসেবে এমবাপের উঠে আসা। সব মিলিয়ে দুর্দান্ত একটা ম্যাচ দেখলাম শনিবার রাতে। কিন্তু তার চেয়েও ভয়ের তথ্য দিয়ে গেল এই ম্যাচ।

এই কাজ়ানেই দক্ষিণ কোরিয়ায় কাছে হেরে বিদায় নিয়েছিল গত বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন জার্মানি। এ বার বিদায় নিলেন মেসিরা। রাশিয়া বিশ্বকাপে তাতারস্তানের এই শহর কিন্তু তারকা বিদায়ের স্থান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে উঠছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE