Advertisement
০৭ মে ২০২৪

প্রেসিং ফুটবল আর ফলস নাইনে প্রিমিয়ার লিগেও শুরু ক্লপ বিপ্লব

চোখে চশমা। মুখে চাপদাড়ি। গায়ে ট্র্যাকস্যুট। দেখলে মনে হতেই পারে কোনও কলেজের প্রফেসর। কিন্তু ভুলেও তাঁকে হাল্কা ভাবে নেবেন না।

সোহম দে
শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৬ ০৪:০৩
Share: Save:

চোখে চশমা। মুখে চাপদাড়ি। গায়ে ট্র্যাকস্যুট।

দেখলে মনে হতেই পারে কোনও কলেজের প্রফেসর।

কিন্তু ভুলেও তাঁকে হাল্কা ভাবে নেবেন না। বাইরের চেহারা যাই হোক না কেন, তাঁর মগজটা যে কোটি টাকার। যা একটা ক্লাবকে ধ্বংসস্তুপ থেকে ফের সোনার সাম্রাজ্যে বদলে দিতে পারে। অনামী ফুটবলারদের মহাতারকায় পরিণত করতে পারে। বড় বড় দলগুলোকে অনায়াসে আটকে দিতে পারে। তিনি— লিভারপুল কোচ য়ুরগেন ক্লপ। যিনি ইংল্যান্ডের অন্যতম ঐতিহাসিক ক্লাবকে দিশা হারানো পথিক থেকে সাফল্যের চূড়োয় তুলে নিয়ে যাচ্ছেন।

মোরিনহো। গুয়ার্দিওলা। কন্তে। প্রিমিয়ার লিগ শুরু হওয়ার পর থেকে সবার চোখ ছিল এই তিনজনের উপর। কেউ তখন একবারও ভাবেননি ক্লপ বলেও একজন বস্তু আছেন লিগে। সেই ক্লপ যিনি একার হাতে বরুসিয়া ডর্টমুন্ড-কে ভাঙাচোরা গাড়ি থেকে রোলস রয়েসে পরিণত করতে পারেন। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের তারকা কোচেদের সমাগমে সেই ‘মেঘে ঢাকা তারাই’ তো এখন হয়ে উঠেছেন বিপক্ষের বড় কাঁটা। চেলসিকে স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে হারানো হোক বা আর্সেনালের বিরুদ্ধে এমিরেটসে তিন পয়েন্ট তোলা, ক্লপের ডিকশনারিতে অসম্ভব বলে কোনও শব্দ নেই।

ক্লপকে বাকি কোচেদের থেকে আলাদা করছে কী? আই লিগ জয়ী কোচ সঞ্জয় সেন যেমন মনে করছেন, প্লেয়ারদের সঙ্গে তাঁর বন্ধুর মতো সম্পর্কই লিভারপুলের থেকে সেরাটা বের করে আনে। ‘‘ক্লপ কিন্তু প্লেয়ার্স কোচ। বাইরে থেকে দেখলে যা মনে হয়, ক্লপের ম্যান ম্যানেজমেন্ট দারুণ। সব সময় দেখি ম্যাচ শেষে হাসিমুখে ফুটবলারদের পিঠ চাপড়ে দিচ্ছেন ক্লপ। কোচের এই বাহবাই মাঝে মাঝে ফুটবলারদের থেকে সেরাটা বের করে আনতে পারে,’’ বললেন সঞ্জয়।

ক্লপ কিন্তু বরাবরের আন্ডারডগ কোচ। যিনি সাধারণ প্লেয়ারদের নিয়েও ট্রফি জেতার মতো দল তৈরি করেন। ইতিহাসই বলছে, বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের দায়িত্ব যখন নিয়েছিলেন ক্লপ তখন বুন্দেশলিগা মানেই ছিল বায়ার্ন মিউনিখ। স্টুটগার্ট, উল্ফসবার্গরা এক-দু’বার জিতলেও বায়ার্নের একাধিপত্যে বুন্দেশলিগা ছিল ওয়ান টিম লিগ। সেখান থেকে বরুসিয়াকে ইউরোপের অন্যতম সেরা দল করে তুলেছিলেন ক্লপ। বুন্দেশলিগা চ্যাম্পিয়ন হোক বা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে ওঠা, ক্লপ-এফেক্টে একটা মাঝারি মানের দল হয়ে উঠেছিল ইউরোপীয় হেভিওয়েট। যে ক্লাবকে জার্মানির বাইরে কেউ তেমন পাত্তা দিত না, ক্লপের দৌলতে আজ বিশ্বজুড়ে তার অসংখ্য সমর্থক।

মোরিনহোর আঁটসাঁট রক্ষণ। গুয়ার্দিওলার তিকিতাকা ফুটবল। কন্তের সাইডব্যাকদের উইঙ্গার হিসেবে ব্যবহার করা। ক্লপের বিশেষত্ব সেখানে প্রেসিং ফুটবল। যেখানে ফুটবলাররা অনবরত জায়গা পাল্টাবেন। ফলস নাইন থাকবে। গতিকে কাজে লাগাবেন। প্রাক্তন ইস্টবেঙ্গল কোচ বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্যও বলছেন, ‘‘ক্লপের ফর্মেশনে কোনও ফুটবলার বিশ্রাম পায় না। সব সময় বলকে তাড়া করে চলেছে। বিপক্ষকে কোনও সময় দেয় না বলের উপর। ফুটবলারদের বারবার পজিশন পাল্টাতে হয়।’’

ক্লপের আর এক বড় গুণ হচ্ছে আনকোরা প্রতিভাদের মহাতারকা করে তুলতে পারেন। মারিও গটজে হোক বা রবার্ট লেভানডস্কি, ম্যাটস হুমেলস হোক বা মার্কো রয়েস— এঁদের নাম এক সময় ক’জন জানত। ক্লপের মগজাস্ত্রের সাহায্যে এই ফুটবলাররা এখন দাপিয়ে খেলছেন। দলবদলের বাজারে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছেন। দেশকে বিশ্বকাপ জেতাচ্ছেন। তিনি বুন্দেশলিগায় না থেকেও তো আছেন। আজও তো ডর্টমুন্ড ম্যাচ মানে ধারাভাষ্যকার ক্লপের নাম একবার না একবার বলবেন। গ্যালারি জুড়ে আজও ক্লপের ব্যানার ওড়ায় সমর্থকরা। জার্মান হেভিওয়েট বায়ার্ন মিউনিখও তো ক্লপের তৈরি অস্ত্র দিয়েই প্রতি বছর দল গড়ছে। বিশ্বজিৎ যে প্রসঙ্গে বলছেন, ‘‘ক্লপ তরুণ ফুটবলারদের তারকা বানাতে পারেন। ভাল করে জানেন কী ভাবে সাধারণ মানের ফুটবলারের থেকেও সেরাটা বের করে আনা যায়।’’

লিভারপুলের দায়িত্ব নেওয়ার সময় সমালোচকরা বলেছিল, ক্লপ পারবেন না। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের গতির সঙ্গেই মানাতে পারবেন না জার্মান কোচ। কিন্তু গত মরসুমে ব্রেন্ডন রজার্সের ভাঙাচোড়া দলের দায়িত্ব নিয়েও তো ইউরোপা লিগ ফাইনালে গিয়েছিলেন। চলতি মরসুমে ফিলিপ কুটিনহো, রবের্তো ফির্মিনো, সাদিও মানের মতো ফুটবলারদের নিয়েও তো দুই ম্যাঞ্চেস্টারের আশি কোটি-একশো কোটি তারকাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। পরিসংখ্যান বলছে, লিভারপুল দলটাও আস্তে আস্তে ক্লপের স্ট্র্যাটেজির সঙ্গে মানিয়ে নিচ্ছে। লিগ টেবলের চার নম্বরে বসে রয়েছে। আঠারো গোল করেছে। কুড়িটা ক্লাবের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গোলের সুযোগ তৈরি করেছে। সঞ্জয় বলছেন, ‘‘ক্লপ ফ্যাক্টরের জন্য লিভারপুলকে ইপিএলের দাবিদার মানছি। আর্সেনাল, চেলসিকে হারিয়েছে। হতে পারে কয়েকটা ম্যাচ হয়েছে। কিন্তু ক্লপ খুব ভাল কোচ। আমার মনে হয় শেষ পর্যন্ত লিভারপুল চ্যালেঞ্জ করবে।’’

ক্লপ শব্দটার মানে তো তাই শুধু বিশ্বমানের এক জন কোচ নয়। ক্লপ শব্দটার আসল মানে তো বিপ্লবও!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Jürgen Klopp EPL
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE