ছবি উৎপল সরকার
খানিকটা ডিএলটিএ-র কোর্টে। কিছুটা টিম হোটেলের পুল সাইডে। অনেকটাই ব্রেকফাস্ট টেবলে। আনন্দ অমৃতরাজ স্পেন টাইয়ের ফাঁকে ফাঁকে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিলেন আনন্দবাজার-কে! তবে জায়গাই বারবার যা বদলেছে। ভারতীয় ডেভিস কাপ দলের নন প্লেয়িং ক্যাপ্টেন একটা জায়গায় কিন্তু কমন— তাঁর আক্রমণাত্মক সব মন্তব্যে!
প্রশ্ন: রাফায়েল নাদালদের টিমের থেকে ভারত একটাও সেট নিতে পারবে না— সাধারণ ধারণা টাইয়ের আগে এমনই ছিল টেনিস মহলে! সেখানে তিন দিনে একটা করে তিনটে সেট পেয়েছে ভারত। ভালই পারফরম্যান্স কী বলেন?
আনন্দ: রসিকতা করছেন? যেমনটা এই টাইয়ের আগে থেকে হয়ে আসছিল এখানে সব মহলে!
প্র: রসিকতা কেন করব? তবে এটা তো ঠিক, ০-১৫-র চেয়ে ৩-১৩ শুনতে ভাল!
আনন্দ: ৩-টা একটু এ দিক-ও দিক হলে স্বচ্ছন্দে ৬-ও হতে পারত। তা হলে টাইটাও ০-৫ হারতাম না আমরা। গত দু’বারের শক্ত প্লে-অফের মতো এ বারও অন্তত একটা রাবার জেতার সম্মান থাকত স্পেনের মতো হেভিওয়েটের বিরুদ্ধে।
প্র: একটু বিস্তারিত বলবেন?
আনন্দ: গত বার এখানেই চেকদের থেকে একটা সিঙ্গলস কেড়ে নিয়েছিলাম আমরা। তার আগের বার বেঙ্গালুরুতে সিঙ্গলস-ডাবলস দু’টো জিতেছিলাম সার্বিয়ার বিরুদ্ধে। এ বারও তো স্পেনের সঙ্গে প্রথম দিন একটা সিঙ্গলস আর শনিবার ডাবলসে আমরা একটা সময় জেতার মতো জায়গায় চলে গিয়েছিলাম। মানে আমি রামকুমার ভার্সেস ফেলি (ফেলিসিয়ানো লোপেজ) আর নাদালদের সঙ্গে লিয়েন্ডার-সাকি (সাকেত মিনেনি) ডাবলসের কথা বলছি।
প্র: কী বলছেন? রামকুমার তৃতীয় সেট জেতার পর চতুর্থটায় ১-৬ উড়ে গিয়েছেন। ডাবলসে দ্বিতীয় সেটের শেষের দিক থেকে নাদাল কিছুটা নিজের মতো খেলতে শুরু করতেই ভারতীয় জুটির প্রচুর আনফোর্সড এরর! তবু ভারত ওই দু’টো ম্যাচ জিতত ভাবছেন?
আনন্দ: হ্যাঁ। কারণ রামের চতুর্থ সেটের প্রথম সার্ভিসটাই ব্রেক না হলে ও হঠাৎ ওই রকম মানসিক ভাবে লড়াই থেকে হারিয়ে যেত না। শিওর। তার আগের সেটটাই জিতে ওই সময় ও মোমেন্টামে ছিল। আর এক বার ২-২ করে ফেলতে পারলে ফিফথ সেট যে কারও হতে পারত।
ডাবলসেও ঠিক ওই সময়টার খেলার গতিপ্রকৃতি অনুযায়ী সাকেতের সার্ভিস গেমে আমাদের ২-০ সেট এগিয়ে যাওয়ার কথা। আর এক বার ২-০ হয়ে গেলে নাদাল যে রকম ঘেঁটে ছিল ওর সার্ভিস আর মেজাজে, তাতে লিয়েন্ডারের মতো পোড়খাওয়া হয়তো স্ট্রেট সেটে ডাবলসটা বার করে নিত। নাদালদের ম্যাচে ফেরার সুযোগটা আমরাই করে দিয়েছিলাম। সাকেতের ওই গেমে প্রথম সার্ভের ফুট ফল্টটাই আমাদের জুটির যেন যাবতীয় ছন্দ নষ্ট করে দিল। তার পরই তো ওই সার্ভিস গেম নষ্ট থেকে সেট টাইব্রেকারে চলে গেল। আর আমাদের পিছনোর শুরু।
প্র: লিয়েন্ডারও তাই বলছিলেন। ওঁর মতে ফুট ফল্টের কল-টাও ভুল ছিল।
আনন্দ: তা হলে কল-টাকে চ্যালেঞ্জ করেনি কেন তখন? আমিও অবাক হয়ে গিয়েছিলাম তখন কোর্টে নন-প্লেয়িং ক্যাপ্টেনের চেয়ারে বসে। লিয়েন্ডাররা নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। অবিশ্বাসের চোখে চেয়ার আম্পায়ারের দিকে তাকাল। অথচ আমার দিকে দু’জনের কেউ এক বারও তাকায়নি। তাকালেই চোখের ইশারায় বলে দিতাম টিভি রিভিউ নিতে।
প্র: আপনিও কি নিশ্চিত ওটা ফুট ফল্ট ছিল না সাকেতের?
আনন্দ: ঠিক পুরোপুরি নই। হয়ে থাকতেও পারে। কিন্তু তার পরেও ওই গেমে সাকি দু’টো ‘এস’ মেরেছিল। তা সত্ত্বেও গেমটা আমরা হারি আর ম্যাচটার সেখান থেকেই ঘুরে যাওয়ার শুরু।
প্র: রির্ভাস সিঙ্গলসেও তো তরুণ সুমিত নাগল ডেভিস কাপে আবির্ভাবেই জেতার সুযোগ পেয়েছিল!
আনন্দ: আর অদ্ভুত ভাবে শেষমেশ হারল! দ্বিতীয় সেট জিতে যখন ১-১ করল, টানা আটটা গেম জিতে করেছে। আবার শেষ সেটে ৩-০ এগিয়ে থেকেও যখন ৩-৬ হারল, তখন টানা ছ’টা গেম পায়নি! এ রকম ম্যাচ আমি খুব কম দেখেছি!
প্র: উনিশ বছর বয়সেই একটা বেস্ট অব থ্রি ম্যাচ খেলতে গিয়ে কিন্তু সুমিতের ‘মেডিক্যাল টাইম আউট’ লেগেছে! এটা কি দলের ফিটনেসের পক্ষে ভাল বিজ্ঞাপন?
আনন্দ: সুমিতের সমস্যাটা অন্য ছিল। হঠাৎ-ই সামান্য নিঃশ্বাসের কষ্ট হচ্ছিল। ওয়াটার ব্রেকে ঠিক পরিমাণ মতো এনার্জি ড্রিঙ্কস খায়নি।
প্র: রামকুমার-সাকেতরাও তো পাঁচ সেট খেলতে গেলেই ক্র্যাম্প ধরিয়ে বসছেন!
আনন্দ: আসলে এই ইন্ডিয়ান টিমের তরুণদের পায়ের জোরের অভাব। মানে টপ লেভেল টেনিস টুর্নামেন্টে খেলতে যতটা পায়ের জোর লাগে সেই অনুযায়ী। সে জন্য ওদের আরও বড় মাপের টুর্নামেন্ট নিয়মিত খেলতে হবে। আর সেই খেলার যোগ্যতা পাওয়ার জন্য চ্যালেঞ্জার্স থেকে আরও বেশি এটিপি পয়েন্ট তুলতে হবে ভাল খেলে। খুব ভাল হয়, ওরা ব্যক্তিগত ট্রেনার রাখলে। কিন্তু বছরভর ট্যুরে ট্রেনার রাখার খরচ বিশাল। বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে প্রথম একশোয় ঢুকতে না পারলে খরচটা সামলানো মুশকিল। বেশি প্রাইজমানির এটিপি টুর্নামেন্ট খেলার সুযোগ পেয়ে বেশি রোজগার করা সম্ভব। কিন্তু রামকুমার-সাকিদের পক্ষে দেড়শো-দুশো র্যাঙ্কিংয়ে থেকে সেই বেশি রোজগার করার সুযোগটাই তো নেই! একটা অদ্ভুত অবস্থার মধ্যে ওরা। আর ওদের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় টেনিস দলও।
প্র: ভারতের তা হলে অদূর ভবিষ্যতে ওয়ার্ল্ড গ্রুপে ওঠার সম্ভাবনা নেই বলছেন?
আনন্দ: সত্যি বলতে কী, তাই। তার জন্য সিঙ্গলসে অন্তত এক জন বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে প্রথম পঞ্চাশে থাকা প্লেয়ার দলে দরকার। যে নিজের দু’টো সিঙ্গলস বার করে নিতে পারবে। তা হলে বাকি তিনটে ম্যাচের একটা জিতলেই টাই আমাদের।
প্র: য়ুকি ভামব্রির র্যাঙ্কিং তো একটা সময় প্রথম একশোর মধ্যে ছিল। সোমদেব সত্তরের ঘরে উঠে এসেছিলেন।
আনন্দ: সেটা সামান্য ক’দিনের জন্য। বরং ওদের চোট অনেক দিন ধরে চলেছে। সোমদেব তো শুনেছি আমেরিকায় কোচিং-ই শুরু করে দিয়েছে। আর নিয়মিত খেলবে বলে মনে হয় না। তার উপর বয়সও বত্রিশ-তেত্রিশ হয়ে গেল। য়ুকির বয়স কম। কিন্তু ভীষণ ইনজুরি প্রবণ। বিদেশে রিহ্যাবে থেকেও একশো ভাগ ফিট হয়ে উঠত পারছে না। রামকুমার বার্সেলোনায়, সুমিত জার্মানিতে ট্রেনিং করে বছরের বেশির ভাগ সময়। তবু লম্বা ম্যাচ খেলতে হলে ক্র্যাম্প ধরিয়ে বসছে। অথচ দাভিদ ফেরারকে তেত্রিশেও বলা হচ্ছে ম্যারাথন ম্যান। আসলে আমাদের ভারতীয়দের গড়নটাই যত সমস্যার। জিন-কে তো আর অস্বীকার করার উপায় নেই। মাঝেসাঝে একটা-দু’টো লিয়েন্ডার, সানিয়ার মতো ঈশ্বরপ্রদত্ত চেহারার প্লেয়ার উদয় হয়ে ইন্ডিয়ান টেনিসকে টেনে নিয়ে যাবে। কিন্তু সেটা ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে বসে থাকার মতো।
প্র: লিয়েন্ডার-সানিয়ার ঝগড়া নিয়ে কী বলবেন?
আনন্দ: নো কমেন্টস। আমি সম্পূর্ণ ভাবে এ সব ইস্যুর বাইরে। আমার কাজ ভারতীয় ডেভিস কাপ দল নিয়ে। ব্যস!
প্র: তবু একজন প্রাক্তন ভারতীয় টেনিস তারকা হিসেবে ব্যাপারটা কী চোখে দেখবেন?
আনন্দ: দেশের টেনিস আর উঠতি টেনিস প্লেয়ারদের জন্য ভাল বিজ্ঞাপন নয়। তোমার আইডল-কে হঠাৎ পাঁচটা গড়পরতা সাধারণ মানুষের মতো তোমার মনে হলে, নিজের সেই কাজের প্রতি ভালবাসাটা চলে যায়। তাতে নিজের ক্ষতি। দেশের ক্ষতি। কারণ তুমি একটা স্বপ্নকে তাড়া করছ। আর তোমাকে নিয়ে দেশ স্বপ্ন দেখছে। এটা আমাদের দেশের সিনিয়র টেনিস তারকারা মনে রাখলে বোধহয় ভাল হয়। কারণ অসংখ্য ভারতীয় ছেলেমেয়ে লিয়েন্ডার-সানিয়া হয়ে ওঠার স্বপ্ন নিয়ে টেনিস র্যাকেট প্রথম বার হাতে তোলে!
প্র: এখনও আঠারো মাস দূরের এশিয়ান গেমসে লিয়েন্ডার ডাবলস খেলার কথা বলেছেন সাকেত মিনেনিকে নিয়ে! সম্ভব?
আনন্দ: এখানে লিয়েন্ডার ডাবলসটা যে রকম অসাধারণ খেলেছে তার পরে ওর এখনও বিকল্প দেখছি না টিমে। আর সাকেতের সঙ্গে প্রথম বার নেমেই কিন্তু ওদের জুটির মধ্যে কোর্টে একটা স্বাভাবিক বোঝাপড়া গড়ে উঠেছিল। সাকেত ডাবলসে ন্যাচারাল অ্যাড কোর্ট মানে বাঁ-কোর্টের প্লেয়ার। লিয়েন্ডার দেড় বছর পরে ফিট থাকলে ওদের জুটি এশিয়া়ডে মেডেলের প্রশ্নে খারাপ হবে না। অলিম্পিক্স চ্যাম্পিয়ন নাদালদেরই তো হারিয়ে দিয়েছিল আর একটু হলে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy