Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

‘আর্সেনই বদলে দেন ইংল্যান্ডের ফুটবল সংস্কৃতি’

ইংল্যান্ডে ফুটবলাররা আগে প্রচুর পরিমাণে চকোলেট বার খেয়ে খেলতে নামতেন। কারণ, শর্করা ক্লান্তি দূর করে। আমিও খেয়েছি।

ট্রেভর জেমস মর্গ্যান
শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৮ ০৪:১০
Share: Save:

আর্সেন ওয়েঙ্গার আমার কাছে শুধু মাত্র ফুটবল ম্যানেজার নন। এক জন বিপ্লবী ও দার্শনিক! যিনি বদলে দিয়েছেন ইংল্যান্ডের ফুটবল সংস্কৃতি।

ইংল্যান্ডে ফুটবলাররা আগে প্রচুর পরিমাণে চকোলেট বার খেয়ে খেলতে নামতেন। কারণ, শর্করা ক্লান্তি দূর করে। আমিও খেয়েছি। কিন্তু ওয়েঙ্গার ১৯৯৬ সালে আর্সেনালের দায়িত্ব নিয়েই ফুটবলারদের চকোলেট বার খাওয়া বন্ধ করে দিলেন। শুধু তাই নয়। ইংল্যান্ডে ফুটবলারদের খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম ছিল না। যাঁর যা ইচ্ছে খেতে পারতেন। কোনও ক্লাবেই পুষ্টিবিদ ছিল না। ওয়েঙ্গার নিয়োগ করলেন পুষ্টিবিদ। একে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা চকোলেট বার খাওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি। তার উপর পুষ্টিবিদের বানিয়ে দেওয়া খাদ্যতালিকা মেনে চলার ফতোয়া। আলোড়ন পড়ে গিয়েছিল ইংল্যান্ডে। প্রবল সমালোচনা শুরু করে দিলেন প্রাক্তন ফুটবলাররা। তাঁদের মতে, ফুটবলারদের দুর্বল করে দিচ্ছেন ফরাসি ম্যানেজার। ওয়েঙ্গার কোনও প্রতিবাদ না করলেও সিদ্ধান্তে অবিচল ছিলেন। পরের মরসুমেই ইপিএল চ্যাম্পিয়ন আর্সেনাল। তাতেও অবশ্য সমালোচকদের মুখ বন্ধ হয়নি। আমার এক বন্ধু আর্সেনালের টিম ম্যানেজমেন্টে ছিল। ওর কাছেই জানতে চেয়েছিলাম, চকোলেট বার খাওয়া কেন বন্ধ করলেন ওয়েঙ্গার? ও বলল, শর্করা ক্লান্তি দূর করে ঠিকই। কিন্তু ওয়েঙ্গারের মনে হয়েছে, ফুটবলাররা যে ভাবে মাঠে নামার আগে আট-দশটা করে চকোলেট বার খাচ্ছে, তাতে শরীরে মেদ জমবে। বাড়বে অসুস্থ হয়ে পড়ার সম্ভাবনাও। তাই বন্ধ চকোলেট বার খাওয়া।

ওয়েঙ্গার বুঝিয়েছেন, ফিজিয়ো থেরাপিস্টের প্রয়োজনীয়তাও। ইংল্যান্ডের ক্লাবগুলোয় আগে ফুটবলাররাই একে অপরকে মাসাজ করে দিতেন। আর্সেনালের দায়িত্ব নিয়েই পেশাদার ফিজিয়ো থেরাপিস্ট নিয়োগ করেন ওয়েঙ্গার। বাধ্যতামূলক করেছিলেন ম্যাচ এবং অনুশীলনের পরে ফুটবলারদের মাসাজ নেওয়া। এর সুফল কয়েক মাসের মধ্যেই পেতে শুরু করল আর্সেনাল। ফুটবলারদের চোট-আঘাতের সমস্যা অনেক কমে গেল। ওঁর দেখানো পথেই হাঁটতে শুরু করল অন্য ক্লাবগুলো।

অনেকে মনে করেন আধুনিক ফুটবলের পথিকৃত পেপ গুয়ার্দিওলা। আমার মতে কিন্তু ওয়েঙ্গার। নিজেদের মধ্যে পাস খেলতে খেলতে বিপক্ষকে নাজেহাল করে দেওয়া তো নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে দেখিয়েছেন আর্সেনাল ম্যানেজার।

ইংল্যান্ডে ওয়েঙ্গারের লড়াইটা মূলত ছিল আলেক্স ফার্গুসনের সঙ্গে। অথচ দু’জনের দর্শনে আশ্চর্য মিল। দু’জনেই দল গড়তেন ভবিষ্যতের কথা ভেবে। যে কারণে, কখনও তারকার পিছনে ছোটেননি আর্সেনাল ম্যানেজার। সারা বিশ্ব থেকে প্রতিশ্রুতিমান ফুটবলার খুঁজে আনতেন। থিয়েরি অঁরি, প্যাট্রিক ভিয়েরা, নিকোলাস আনেলকা, মার্ক ওভারমার্স, ডেনিস বার্গক্যাম্প থেকে রবার্ট পিরেস— উঠে এসেছেন ওয়েঙ্গারের কোচিংয়েই। ফুটবলারদের আগলে রাখতেন সন্তানের মতোই। ম্যানেজার হয়েও সব সময় ভাবতেন কী ভাবে ক্লাবের খরচ কমানো যায়। আর্সেনালকে ক্লাব হিসাবে দেখেননি ওয়েঙ্গার। মনে করতেন, আর্সেনাল একটা প্রতিষ্ঠান। জেতা হারার চেয়েও ওঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, প্রতিষ্ঠানের মর্যাদারক্ষা করা। ওঁর জন্যই সারা বিশ্বে আর্সেনালের অসংখ্য ভক্ত। ওয়েঙ্গার ও আর্সেনাল সমার্থক হয়ে উঠেছে।

২০০৮-০৯ মরসুম। আমি তখন হাল সিটির কোচিং দলের সদস্য। ইপিএলে আর্সেনালের বিরুদ্ধে ঘরের মাঠে আমরা হেরেছিলাম। তবে ফিরতি পর্বে ওদের মাঠে জিতেছিলাম। দু’বারই খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম ওয়েঙ্গারকে। পুরো ম্যাচে কখনও দেখলাম না, ভুল করা সত্ত্বেও ফুটবলারদের বকতে। আর্সেনালে ২২ বছরের দীর্ঘ কোচিং জীবনে কখনও প্রকাশ্যে ফুটবলারদের সমালোচনা করেননি। শুধু তাই নয়। ড্রেসিংরুমে কী হয়েছে, সেই খবরও কোনও দিন বাইরে বেরোতে দেননি। ওয়েঙ্গারই আমাকে শিখিয়েছেন, শুধু ফুটবল জ্ঞান থাকলেই কোচিং করা যায় না। দরকার সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে চলার ক্ষমতা। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কীভাবে মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়।

তা হলে কেন সরতে হচ্ছে ওয়েঙ্গারকে? সাফল্য না পেলে সরে যেতেই হবে। আর্সেনাল শেষ বার ইপিএল জিতেছিল ১৪ বছর আগে! গত বছর চ্যাম্পিয়ন্স লিগে যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। আগামী বছরও সম্ভাবনা কম। ইংল্যান্ড ফুটবলে সব চেয়ে বেশি বার এফ এ কাপ (১৩) জয়ের নজির রয়েছে আর্সেনালের। অথচ এই মরসুমে সেমিফাইনালেই উঠতে পারেনি। ফলে ক্ষোভ বাড়ছিল সমর্থকদের। আর্সেনাল কর্তারাও মনে হয় আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন ওয়েঙ্গারের উপর থেকে। নতুন চুক্তিতে সই করাননি তাঁকে। এই কারণে নিজেই আর্সেনালের সঙ্গে ২২ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিলেন কিংবদন্তি কোচ। এ ভাবে ওয়েঙ্গারের বিদায় নেওয়াটা যন্ত্রণার।

তবে আর্সেনাল যত দিন থাকবে ওয়েঙ্গারও থাকবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE