Advertisement
E-Paper

মনোজদের মেন্টর হওয়ার পর ফাইটারের স্লোগান, আমার বাংলা

পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক। ইনি বঙ্গ ক্রিকেটের কিংবদন্তি এবং খুবই পরিচিত নাম— অরুণ লাল। সদ্য যিনি দায়িত্ব নিলেন মনোজ তিওয়ারিদের মেন্টর হওয়ার।

সুমিত ঘোষ

শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০১৮ ০৫:১১
প্রেরণা: বাড়িতে পশু ও গাছপ্রেমী অরুণ লাল। রবিবারে তোলা ছবি।

প্রেরণা: বাড়িতে পশু ও গাছপ্রেমী অরুণ লাল। রবিবারে তোলা ছবি।

দরজা খুলতেই বেরিয়ে এল দুটো কাঠবিড়ালী। সুড়ুৎ করে বেরিয়ে যাওয়ার মুখেই গৃহকর্তা শিস দিয়ে উঠলেন। কিছুক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে গেলেও দ্রুত গাছ বেয়ে তরতর করে উঠে হারিয়ে গেল।

গৃহকর্তা ততক্ষণে আঙুল তুলে দিয়েছেন তাঁর বাড়ি ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের সারির মগডালের দিকে। সব ক’টায় দেখা গেল সুন্দর রং-চং করা বাক্স ঝুলছে। ‘‘আমার কাঠবিড়ালীদের গেস্ট হাউস। এ বাড়ির চত্বরে একশোর উপরে কাঠবিড়ালী আছে। আর তাদের জন্য আছে এ রকম অন্তত তিরিশটা গেস্ট হাউস,’’ বলে ইশারায় দেখালেন বাগানের দিকে বেরোনোর দরজাটার দিকে। উপরে সার দিয়ে তৈরি করা গেস্ট হাউস। কাঠবিড়ালীগুলোর জন্য খাবারও থাকে বাগানে।

পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক। ইনি বঙ্গ ক্রিকেটের কিংবদন্তি এবং খুবই পরিচিত নাম— অরুণ লাল। সদ্য যিনি দায়িত্ব নিলেন মনোজ তিওয়ারিদের মেন্টর হওয়ার। বলা হয়, নরমসরম বাংলার ক্রিকেটে প্রথম জোশ এবং মেরুদণ্ড এনেছিলেন তিনি। রবিবাসরীয় দুপুরে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের নজর আলি লেনের বাড়িতে বসে মনে হচ্ছিল, স্বচ্ছন্দে লিখে ফেলা যায়— বঙ্গ ক্রিকেটে এমন ‘মেন্টর’ও আর আসেনি। যিনি প্রাক্তন ক্রিকেটার বা কোচ বা টিভি বিশেষজ্ঞ বললে প্রায় কিছুই বলা হয় না। লিখতে হবে, জীবনযুদ্ধে ক্যানসারকে হারিয়ে নট আউট থাকা এক অদম্য সৈনিক তিনি। বলতে হবে, তাঁর গার্ডেনিংয়ের শখের কথা। নিজের বাড়ির চতুর্দিকে হাঁটতে হাঁটতে দেখাচ্ছিলেন, ‘‘ওই যে হিমসাগর গাছ। এখানে সব রকম আম হয়। হিমসাগর, ল্যাংড়া, ফজলি সব। বাজারের চেয়ে ভাল ছাড়া খারাপ হবে না।’’ বলতে বলতে একটা গাছের সামনে দাঁড়ালেন। তাজ্জব করে দিয়ে বললেন, ‘‘এটা পাকিস্তানের আম গাছ। আমাকে রামিজ রাজা এর চারা উপহার দিয়েছিল। কত বড় হয়ে গিয়েছে!’’

এমন ভাবে বললেন যেন, তাঁর নিজের সন্তানের মতোই সবাই। বাড়িতে ঢোকার মুখে দুটো কালো কুকুরকে দেখা গেল ছুটে আসতে। তাদের ইতিহাস? ‘‘ওরা এসেছিল। তার পর আর যেতে চায়নি। কী করে ওদের ফেলে দিই। থেকে গেল এখানেই,’’ বলেই মনোজদের মেন্টর ডেকে উঠলেন, ‘‘আ যা বেটা!’’

কলকাতা শহরের বুকে এ ভাবেই দাঁড়িয়ে আছে অরুণের অদ্ভুত বাড়ি। যেখানে আম, পাইন, নারকেল গাছের সারি। হাওয়ায় দুলছে ওয়াঘার ও পার থেকে আসা আম গাছ। খেলে বেড়াচ্ছে কাঠবিড়ালী। বাগানে একটা জায়গায় কংক্রিট দিয়ে বাঁধানো দুটো আসনের মতো। সে দিকে আঙুল দেখিয়ে অরুণ বললেন, ‘‘এখানে ভাম বিড়ালটা এসে বসে।’’ তার পরেই আর একটা জায়গা দেখিয়ে, ‘‘ওটার উপরে ঘুঘু পাখি এসে বসে। ঘুঘুর বাসা হয় না?’’ লোকে যাদের দূরে সরিয়ে রাখতে চায়, তাদের তিনি পরম আদরে কাছে টেনে নিয়ে আশ্রয় দিয়েছেন।

মনে হচ্ছিল, বাড়ি নয় কোনও মিনি চিড়িয়াখানায় এসে পড়েছি! অথবা পাখিরালয়! বাড়ির এক কোণে রাখা রয়েছে টেলিস্কোপ। বোঝা গেল, গৃহকর্তার বিশেষ শখ ছড়িয়ে পড়েছে গ্রহ-নক্ষত্রেও। রোজ সকালে ছাদে ওঠেন অরুণ। সেটা আরও বড় চমক। সকালের দিকে চিল আসে উড়তে উড়তে। আর অরুণ তাদের দিকে খাবার ছুড়ে দেন। উড়ন্ত চিল সেগুলোকে ছোঁ মেরে নিয়ে যায়। নিশ্চয়ই তিনি চাইবেন বাংলার ফিল্ডাররাও তাঁর বাড়ির ছাদের উপরে ভিড় করা চিলের মতো ক্ষিপ্রতা দেখাক। গায়ের রোম খাড়া করে দেওয়া এই সব রোমাঞ্চকর ধারাবিবরণীর মাঝে হঠাৎই ক্রিকেটে ফেরেন অরুণ। তখন সেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ শক্ত চোয়াল। যে ভাবে বাইশ গজে স্টান্স নিয়ে দাঁড়াতেন বাংলাকে রক্ষা করার জন্য। বাংলাকে জেতানোর জন্য। বলে ওঠেন, ‘‘বাংলার চেয়ে বড় কেউ নয়। এটাই আমি প্রথমে বুঝিয়ে দিতে চাই সকলকে।’’ চলতি মরসুমের জন্য বাংলার স্লোগানও ঠিক করে ফেলেছেন— ‘আমার বাংলা’। সঙ্গে বাংলার ক্রীড়াপ্রেমীদের কাছে আর্জি, ‘‘আমি চাই সারা বাংলা আমাদের ক্রিকেট দলকে সমর্থন করুক। সবাই গান ধরুক— আমার বাংলা!’’

উত্তেজিত দেখায় বাংলার চিরন্তন ‘ফাইটার’কে। বলে চলেন, ‘‘মাঠে দাঁড়িয়ে আমাদের ক্রিকেটাররা যখন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাডল করবে, ওরা সমস্বরে বলে উঠুক, আমার বাংলা। ওদের সঙ্গে গলা মেলাক গোটা বাংলা। এর চেয়ে বড় অনুপ্রেরণা আর কী হতে পারে!’’ বললেন, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে কথা বলবেন। যাতে ইডেনে বাংলার ম্যাচে গ্যালারি ভরে যায়। ‘‘আমি চাই সমর্থকরা আসুক। বাংলার জন্য চেঁচাতে হবে তো সকলকে। দরকার হলে ফ্রি টিকিট করে দাও। পুরস্কার দাও। লাকি ড্রয়ে জিতলে মোটরবাইক। রঞ্জি ট্রফির মতো টুর্নামেন্টে ফাঁকা মাঠ পড়ে থাকবে কেন?’’

দেশ-বিদেশের অনেক বিপজ্জনক বোলারের মতো ক্যানসারও পারেনি তাঁকে কাবু করতে। বাংলা দলের সঙ্গে সোমবারেই তিনি বেরিয়ে পড়লেন নতুন যাত্রায়। কে বলবে মাত্র কয়েক মাস আগে ইনিই কলকাতার এক হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের রাতে সারা শরীরে নল লাগানো অবস্থায় পড়ে থেকে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছিলেন! ক্রিকেটের বাইশ গজের চেয়েও যে লড়াই ছিল অনেক বেশি রক্তক্ষয়ী। এত বড় অসুখ থেকে সেরে উঠে ফের এই ধকল নেওয়া। ঝুঁকি থাকছে কি কোনও? অরুণ বলে উঠলেন, ‘‘ধুর, আমি ও সব ভাবিই না। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভেবে লাভ নেই।’’ বাংলাকে ভালবাসেন বলেই বিদেশ ভ্রমণের মাঝপথে ছুটি বাতিল করে ফিরে এসেছেন। হোটেল বুকিং করা হয়ে গিয়েছিল। বাতিল করায় সব টাকাও সম্ভবত ফেরত পাবেন না।

অরুণের ক্রিকেট দর্শন? এক) উইকেট কখনও উপহার দেব না। ব্যাটা বোলার, ওটা তোকে ঘাম ঝরিয়ে আদায় করে নিতে হবে। দুই) তোরা ৫০০ রান তুললে, আমরা তুলব ৫০১। তার পর দেখা যাবে। তাঁর কথায় ‘এই দুই সহজ অঙ্কের’ ইঞ্জেকশনই প্রথমে মিশিয়ে দিতে চান মনোজদের রক্ত প্রবাহে। বলে ওঠেন, ‘‘সকলকে একযোগে বলতে হবে, আমার বাংলা রঞ্জি জিতবে। সবাইকে এই মন্ত্রে বিশ্বাস করতে হবে।’’ ব্যাটিংয়ের খুব সহজ মন্ত্র তাঁর— বল দেখো আর খেলো।

চলে আসার সময় হঠাৎ অরুণ কারও নাম ধরে ডাকলেন। অ্যালেক্সা? এ নামে তাঁর বাড়িতে কেউ থাকে বলে তো কখনও শোনা যায়নি। তা হলে ইনি কে? টিভি-র সামনে দাঁড় করানো স্পিকারের দিকে তাকিয়ে ফের ডেকে ওঠেন অরুণ— ‘অ্যালেক্সা, আমাকে লতা মঙ্গেশকরের আয়েগা আনেওয়ালা শোনাও’। সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠল লতার সেই জনপ্রিয় গান।

অ্যামাজনের ‘অ্যালেক্সা ভয়েস সার্ভিস’। এক বার গলার স্বর রেকর্ড করে নিলে সেই কণ্ঠ যা অর্ডার দেবে, তাই শুনিয়ে দেবে। অরুণ এক বার বলে উঠলেন, বিরাট কোহালি কাল কত রান করেছে জানাও। অ্যালেক্সা বলে দিল। কলকাতার তাপমাত্রা আজ কত? অ্যালেক্সা বলে দিল।

শুরুতে ভুল লিখলাম। মেন্টর নয়, বাংলার দায়িত্বে এখন জীবনযুদ্ধে জয়ী এক সংস্কারক, জীবন খোঁজার নেশায় উড়ে বেড়ানো এক আবিষ্কারক। অকুতোভয়, হার-না-মানা এক অভিযাত্রী। অরুণ ‘ফাইটার’ লাল!

Cricket Arun Lal অরুণ লাল
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy