Advertisement
০৫ মে ২০২৪
মেসিদের গ্রহে

ক্লাসিকোয় বার্সার অক্সিজেন ইনিয়েস্তার মগজ আর পাস

লিওনেল মেসির মতো তাঁর এত গোল নেই। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর ফ্যানবেসের অর্ধেকও তাঁর নেই। তাঁকে কেউ ‘ঈশ্বর’ বলে না। সোনার বল ছোঁয়ারও সৌভাগ্য তাঁর হয়নি।

বার্সার প্র্যাকটিসে ইনিয়েস্তা।-টুইটার

বার্সার প্র্যাকটিসে ইনিয়েস্তা।-টুইটার

সোহম দে
শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৪:০৪
Share: Save:

লিওনেল মেসির মতো তাঁর এত গোল নেই।

ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর ফ্যানবেসের অর্ধেকও তাঁর নেই।

তাঁকে কেউ ‘ঈশ্বর’ বলে না। সোনার বল ছোঁয়ারও সৌভাগ্য তাঁর হয়নি।

তাতে কী?

দুর্দান্ত অভিনেতাদের সব সময় অস্কার লাগে নাকি? শুধু মাত্র ‘অ্যাকশন’ শব্দটা শুনে ক্যামেরার সামনে আসল জাতটা বেরিয়ে আসে। ঠিক সে রকমই তাঁর প্রতিভারও ব্যালন ডি’অর দরকার পড়ে না। বুট পরিয়ে মাঠে নামিয়ে দেওয়া হোক। জাতটা চোখের সামনে ধরা পড়বে।

বার্সেলোনায় দশ নম্বরের জাদুকর থাকতে পারেন। এগারো নম্বরের ওয়ান্ডারকিড থাকতে পারেন। ন’নম্বরের একজন গোলক্ষুধার্ত স্ট্রাইকার থাকতে পারেন। কিন্তু তাঁকে ছেড়ে প্রথম এগারো যেন ভাঙা একটা সিংহাসন। তিনিই সেই মোৎজার্ট। যিনি কাতালান অর্কেস্ট্রা চালান। তিনি— আন্দ্রে ইনিয়েস্তা। বার্সার মুকুটহীন সম্রাট।

শনিবার এল ক্লাসিকোয় অপেক্ষা করছে রিয়াল মাদ্রিদ। তার আগে একের পর এক ধাক্কা খেয়ে চলেছে বার্সা। মালাগার মতো দুর্বল দলের বিরুদ্ধে নিজভূমিতে ড্র। রিয়েল সোসিয়েদাদের মাঠ থেকে লজ্জা বাঁচিয়ে ফেরা। ম্যাঞ্চেস্টার সিটির সঙ্গে হার। কাটাছেঁড়া করতে বসে অধিকাংশের মত ছিল মেসির উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা পতন ডেকে আনছে। অনেকের মতে, এনরিকের ট্যাকটিক্সের সঙ্গে নাকি বার্সা মানাতে পারছে না।

কিন্তু বুঝতে হবে, অদৃশ্য মাঝমাঠ নিয়ে যুদ্ধজয় করা সম্ভব নয়। ফরোয়ার্ড লাইন তোমার সোনার হতে পারে। কিন্তু বল বাড়ানোর লোক না থাকলে ফরোয়ার্ডদেরও গোটা নব্বই মিনিট স্রেফ দর্শক হয়ে থাকতে হয়। বার্সায় সেই কাজটাই তো করেন ইনিয়েস্তা। মুভ যেমন তৈরি করেন। আবার তুলির ব্রাশস্ট্রোকের মতো সূক্ষ্ম কিছু স্কিলে মন্ত্রমুগ্ধ করে দেন দর্শকদের।

একজন মেসি আছেন তো। তা হলে ইনিয়েস্তা এত গুরুত্বপূর্ণ কেন? প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক ও নিজের সময়কার অন্যতম সেরা বল প্লেয়ার প্রশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়কে মুগ্ধ করে ইনিয়েস্তার বল কন্ট্রোল। ‘‘ইনিয়েস্তা নেই বলেই তো বার্সেলোনার এই অবস্থা। কেউ মুভ তৈরি করতে পারছে না। ইনিয়েস্তার সবচেয়ে বড় গুণ হচ্ছে বল কন্ট্রোল। যত ডিফেন্ডারই থাক না কেন ভিড়ের মধ্যেও বলটা ঠিক ধরে রাখে। খুব বুদ্ধি রেখে খেলে।’’ নিজে প্লে-মেকার ছিলেন। তাই জানেন ফাইনাল পাসের গুরুত্বটা কী? ‘‘একজন প্লে-মেকারের আসল জিনিস হচ্ছে ফাইনাল পাস। তুমি ড্রিবল করলে দারুণ। কিন্তু পাসটা বাড়াতে পারলে না। তা হলে হবে না। ইনিয়েস্তা তো দশটার মধ্যে দশটাই সঠিক বল বাড়ায়।’’

মেসির মতো লা মাসিয়ার আর এক ‘গোল্ডেন গ্র্যাজুয়েট’ ইনিয়েস্তা। খুব ছোট বয়স থেকেই তাঁর খেলার মধ্যে সফল প্লে-মেকার হওয়ার মশলা ছিল। কিন্তু রোনাল্ডিনহো, জাভি, ভিয়া, মেসি, পুয়োলের মতো মহাতারকাদের মাঝখানে তিনি যেন মেঘে ঢাকা তারা হয়েই থেকে গিয়েছেন। আটটা লা লিগা। চারটে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ দিয়েছেন বার্সাকে। স্পেনকে দুটো ইউরো আর বিশ্বকাপও দিয়েছেন। ক্লাব আর দেশকে শ্রেষ্ঠত্বের চূড়োয় পৌঁছে দিয়েও প্রচারের আলোর বাইরে থাকেন।

ইনিয়েস্তার গুরুত্বটা বোঝা যায় মেসির খেলায়। মাঝমাঠে ইনিয়েস্তা থাকলে দলের দশ নম্বরও যেন আরাম করেই তাঁর ফ্রি-রোলটা খেলতে পারেন। ভাবতে হয় না মাঝমাঠ নিয়ে। কারণ জানেন, ইনিয়েস্তা তো আছেই ঠিক সামলে নেবে। মেসি বরং মন দেন গোল খোঁজায়। প্রশান্ত যোগ করেন, ‘‘মেসি ফ্রি-রোলে খেলে। ওকে কোচ স্বাধীনতা দেয় ফ্ল্যাঙ্ক পাল্টানোর। ইনিয়েস্তা না থাকলে বারবার মেসিকে মাঝখানে নামতে হয়। বল রিকভার করতে হয়। তাতে আক্রমণে বেশি যেতে পারে না, গোলের আশে পাশে থাকতে পারে না।’’

ইতালীয়রা যেমন ডিফেন্সের জন্য বিখ্যাত, জার্মানরা শেষ পর্যন্ত লড়াই করে থাকে, ব্রাজিল আবার টোটাল ফুটবল খেলে। সেখানে স্প্যানিশদের গুণ কিন্তু বলের উপর দক্ষতা। স্প্যানিশ প্লেয়াররা এমনিতে দুর্দান্ত পাসার হয়। নড়াচড়া বেশি করব না। একটাই পাস দেব কিন্তু সেটা সঠিক। খুব বেশি ড্রিবল করব না। এ রকম খেলা জয় তুলে আনে। কিন্তু গ্যালারির আবেগ ভুলে যায়। বোরিং পাসিং দেখতে তো আর কেউ মাঠে আসে না। তাই তো স্প্যানিশদের মধ্যে ইনিয়েস্তা একজন ভিন্ন জাতের ফুটবলার। যিনি বল নিয়ে সুন্দর ড্রিবলও করেন। আবার দুর্দান্ত কিছু মুভও তৈরি করেন। বুদ্ধিদীপ্ত ফুটবল যাকে বলে। তাঁকে আটকাতে হলে বিপক্ষের কাছে ফাউল ছাড়া কোনও উপায় থাকে না।

আইলিগ জয়ী কোচ আর্মান্দো কোলাসো বলছেন, ‘‘আমার মতে বিশ্বের সেরা প্লেয়ার ইনিয়েস্তা। ওর পা থেকে বলটা বেরোয় না। বল হারালেও সঙ্গে সঙ্গে সেটা নিয়ে নেয়।’’ ঠিক তাই। বিপক্ষের পাসিং অ্যাভিনিউ বন্ধ করে দেন ইনিয়েস্তা। বিপক্ষকে বাধ্য করেন কঠিন কঠিন পাসগুলো খেলতে। যেটা করতে গিয়ে বিপক্ষ টিম হামেশাই বল তুলে দেয় বার্সার পায়ে।

এল ক্লাসিকোয় ইনিয়েস্তা ফেরা মানে বার্সার বাড়তি অক্সিজেন পাওয়া। কোলাসো বলছেন, ‘‘হ্যাঁ, অবশ্যই ইনিয়েস্তা থাকলে বার্সেলোনার খেলার স্টাইলই পাল্টে যায়। অসাধারণ প্লেয়ার। কাউন্টারেও দারুণ। রিয়াল মাদ্রিদের বিরুদ্ধে ওর ফেরা জরুরি।’’

ইন্টারনেট ঘাঁটলে দেখা যাচ্ছে, বার্সার সঙ্গে ট্রেনিং শুরু করে দিয়েছেন ইনিয়েস্তা। এল ক্লাসিকোয় তাঁর নামটাই হয়তো থাকতে চলেছে প্রথম দলে। রিয়াল যতই লিগ জেতার নেশায় মত্ত থাক না কেন, এক জন ইনিয়েস্তা ফেরা মানে আর কেউ ফেভারিট থাকল না।

কারণ বন্যেরা বনে সুন্দর, ইনিয়েস্তা ফুটবল মাঠে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Andrés Iniesta El Clasico Barcelona
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE