Advertisement
০৭ মে ২০২৪
রাজকোট পৌঁছে গেল বাংলা, ফাইনাল নিয়ে চাপানউতোর বোর্ড-সৌরাষ্ট্রে
Anushtup Majumdar

নায়কের চোখে দলই নায়ক

কী মাঠে, কী বাড়িতে! দলের বিপদে, প্রাণান্তকর চাপের মুখে বোলারদের ভূত তাড়ানোর রহস্যের একটা কিনারাও করা গেল।

মেজাজে: সৌরাষ্ট্র রওনা হওয়ার আগে ছেলের সঙ্গে খেলতে ব্যস্ত অনুষ্টুপ। নিজের ফ্ল্যাটে। ছবি সুমন বল্লভ

মেজাজে: সৌরাষ্ট্র রওনা হওয়ার আগে ছেলের সঙ্গে খেলতে ব্যস্ত অনুষ্টুপ। নিজের ফ্ল্যাটে। ছবি সুমন বল্লভ

সুমিত ঘোষ 
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০২০ ০৪:১৩
Share: Save:

নিউজ়িল্যান্ড থেকে চেতেশ্বর পুজারা যে ইলেকট্রিক স্কুটারে চেপে ছবি দিয়ে ফেসবুকে মন্তব্য করলেন, ‘‘টিম সৌরাষ্ট্র, হিয়ার আই কাম ফর দ্য ফাইনালস,’’ ও রকম যন্ত্রযান অনেক দেখেছেন তিনি। শহিদ ক্ষুদিরাম মেট্রো স্টেশন থেকে সামান্য দূরে তাঁর ফ্ল্যাটেই আছে এর মিনি সংস্করণ। ছেলে ঋষিক তাতে উঠে গতির ঝড় তোলে। আর বাবা বাইশ গজে দাঁড়িয়ে একা কুম্ভ হয়ে বার বার প্রতিপক্ষ বোলারদের ঝড়-ঝাপ্টা সামলানোর মতোই শান্ত ভঙ্গিতে সঙ্গ দিয়ে যান।

দেখতে-দেখতে মনে হবে অনুষ্টুপ মজুমদার ধৈর্যের প্রতীক। কী মাঠে, কী বাড়িতে! দলের বিপদে, প্রাণান্তকর চাপের মুখে বোলারদের ভূত তাড়ানোর রহস্যের একটা কিনারাও করা গেল। যখন ছেলেকে তিনি বোঝাতে থাকলেন, ‘‘ভূত বলে কিছু হয় না, ভূতের ভয়ই শুধু হয়। তা হলে যে জিনিসটা নেই-ই, তাকে ভয় কিসের?’’ বাইশ গজে ঠিক এ ভাবেই হিসাব কষে প্রতিপক্ষ বোলারদের ভূত তাড়ান। ‘‘ম্যাচের আগে কম্পিউটার অ্যানালিস্ট প্রতিপক্ষ বোলারদের নিয়ে বিশ্লেষণ আমাদের হাতে তুলে দেয়। সেই ভিডিয়ো দেখে পরিকল্পনা সাজাই কী ভাবে নিজের ইনিংসটা সাজাতে হবে। কোন বোলারকে সাবধানে খেলতে হবে, কার বিরুদ্ধে ঝুঁকি নিতে পারি। মনে-মনে ম্যাচের ছবিটা দেখার চেষ্টা করি, অমুক বোলার ছুটে আসছে... আমার অফস্টাম্প আক্রমণ করছে... আমি এ ভাবে তার মোকাবিলা করছি...।’’

বিষয়ের গভীরে যাওয়ার অদ্ভুত ঝোঁক আছে তাঁর। সত্যজিৎ রায়ের ভক্ত এই কারণেই। ‘‘এক বার জন্মদিনে বাবা প্রথম ফেলুদার বই উপহার দিয়েছিল। সেই থেকে ফেলুদার ফ্যান। বড় হওয়ার পরে সত্যজিৎ রায়ের অন্যান্য বইও পড়েছি, ফিল্ম দেখেছি। প্রফেসর শঙ্কুও আমার খুব প্রিয়। সব চেয়ে ভাল লাগত বিষয়ের গভীরে যাওয়া। কোনও কিছুই উপর-উপর ছেড়ে দিতেন না সত্যজিৎ রায়।’’ আশ্চর্যের কী যে, তিনি নিজেও ভূত তাড়ানোর গভীরেই প্রবেশ করতে চাইবেন! রঞ্জি ফাইনালে সৌরাষ্ট্রের যদি থাকে পুজারার ধৈর্য, তা হলে বাংলার আছে অনুষ্টুপের সংকল্প। রঞ্জি জিতবেন? চন্দননগরের ছেলেকে সরাসরি জিজ্ঞেস করা গেল তাঁর কলকাতার ফ্ল্যাটে বসে। একটুও না-ভেবে জবাব, ‘‘জিতব কি জিতব না, বলতে পারব না। ক্রিকেটে ও ভাবে বলা যায় না। তবে আমাদের বিশ্বাস অনেক বেড়ে গিয়েছে। শুধু আমরা কেন, পুরো বাংলাই যেন আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছে, আমরা পারব।’’

বঙ্গ ক্রিকেটে যেন প্রবাদই তৈরি হয়ে গিয়েছে, ৪০-৪ হয়ে বাংলা ধুঁকছে, ‘রুকু’কে (অনুষ্টুপের ডাকনাম, যা এখন সকলের মুখে ঘুরছে) স্মরণ করো। দিল্লির বিরুদ্ধে চার উইকেটে ১০০, অনুষ্টুপ ৯৯ রানের ইনিংস খেলে পার করালেন তিনশোর সীমানা। কোয়ার্টার ফাইনালে ওড়িশার বিরুদ্ধে বাংলা ৪৬-৪, সকলে ধরে নিয়েছে এখানেই শেষ হয়ে গেল সব স্বপ্ন, অনুষ্টুপের ব্যাট থেকে এল ম্যাচ ঘুরিয়ে দেওয়া ১৫৭। সেমিফাইনালে কর্নাটকের বিরুদ্ধে দল ৬২-৪, অনুষ্টুপ নেমে করলেন ১৪৯ নট আউট। ‘‘এটাই সব চেয়ে বড় প্রাপ্তি। প্রয়োজনের সময় দলের কাজে আসতে পারা,’’ ব্যক্তির আগে দলকে রাখো— অনুষ্টুপের ক্রিকেট মন্ত্র।

কী ভাবে চাপের মুখে বার বার হেলিকপ্টার নিয়ে উপস্থিত হয়ে যাচ্ছেন উদ্ধারকার্যের জন্য? রহস্য কী? অনুষ্টুপের উত্তর যে কোনও উঠতি ক্রিকেটারের কাছে শিক্ষণীয়। ‘‘পরিস্থিতি কতটা জটিল হয়ে রয়েছে, একদম ভাবি না। আমি ঠান্ডা থাকার চেষ্টা করি। নিজেকে খুব বেশি কিছু বলে চাপ বাড়িয়ে তুলি না। শুধু ভাবি, বল দেখে খেলব। প্রত্যেকটা বলের উপর মনঃসংযোগ করার চেষ্টা করি।’’ যেন মহাভারতের অর্জুন। পাখির চোখ দেখো। গাছ, ডালপালা, অত সবে নজর ঘুরিয়ে নিশানা হারিয়ো না।

ফ্ল্যাটের ড্রয়িংরুমের দেওয়ালে ক্রিকেট-জীবনের স্মরণীয় মুহূর্তের কিছু ছবি। উঁকি দিচ্ছে, আইপিএলে পুণে ওয়ারিয়র্সের জার্সিতে খেলা কম বয়সের অনুষ্টুপ। সতীর্থদের মধ্যে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ছাড়াও আছেন কোনও এক স্টিভ স্মিথ। এখন যিনি দুনিয়া শাসন করছেন ব্যাট হাতে। ‘‘সেই সময়কার স্মিথ আর এখনকার স্মিথে অনেক পার্থক্য। কোথায় পৌঁছে গিয়েছে,’’ বলতে বলতে অনুষ্টুপের স্বীকারোক্তি, ‘‘মানুষটা খুব ভাল। আমরা অনেক ভাল সময় কাটিয়েছি পুণেতে।’’ প্রশ্ন, ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’ গোছের এই আইপিএল নিলাম দেখে আক্ষেপ হয় না? আইপিএলের আকাশে ডানা মেলে ওড়াই তো হল না? ‘‘একেবারেই কোনও আক্ষেপ নেই। ও সব নিয়ে ভাবি না। আমি খুব খুশি যে, বাংলা তেরো বছর পরে ফাইনাল খেলছে আর আমি তাতে অবদান রাখতে পেরেছি,’’ বলে দিলেন অনুষ্টুপ। মনে পড়ে যাচ্ছিল পদ্মাকর শিভালকর, রাজিন্দর গোয়েলদের মুখ। আইপিএল-পূর্ব ভারতীয় ঘরোয়া ক্রিকেটে যাঁরা ওভারের পর ওভার বল করে যেতেন। জেনেশুনেই যে, কখনও ভারতের হয়ে খেলা হবে না কারণ বিষান বেদী, এরাপল্লি প্রসন্নরা আছেন। দুয়োরানির ছেলে হয়েই থেকে যেতে হবে, জেনেও কী অবিশ্বাস্য দায়বদ্ধতা! কখনও ভাটা পড়েনি রাজ্যের হয়ে সাধনায়!

চিয়ারলিডার আর আলো ঝলমলে আইপিএলের আগমনে আরওই ধাক্কা খেয়েছে রঞ্জি ট্রফির বাজার। পলি জমা নদীর মতোই দর্শক-ভালবাসার জলরাশি আরও দূরে সরে গিয়েছে দুয়োরানির সন্তানদের থেকে। সেমিফাইনালে কর্নাটকের বিরুদ্ধে জনজোয়ার তৈরি হওয়া ইডেন তাই নবজাগরণ এনে দিয়েছে। ‘‘সত্যিই এ রকম ম্যাচ আর মনে করতে পারছি না। যেখানে এত লোক বসে খেলা দেখছে, সমর্থন করছে। ম্যাচ জেতার পরে এত অটোগ্রাফ কখনও দিইনি,’’ স্বীকার করেন অনুষ্টুপ। এই ভালবাসায় বলিয়ান হয়েই রাজকোট যাচ্ছেন। সাহস দিচ্ছে ইডেনের গর্জন।

উৎপল চট্টোপাধ্যায় ঘরানার ক্রিকেটার তিনি। তারকাসুলভ হাঁকডাক নেই। চুপচাপ আসেন, টিমের বর্ম চাপিয়ে নীরব যোদ্ধার মতো লড়াই করেন, দলকে জেতান, নিঃশব্দে ফিরে যান। ভিড়ের মধ্যে মিশে থাকা এক আটপৌরে নায়ক। বাংলাকে ফাইনালে তোলার পরে তাঁকে নিয়ে এত হইচই হচ্ছে, কিন্তু অনুষ্টুপ বলে দিচ্ছেন, ‘‘ধুস, জীবন একই রকম আছে। পাল্টাবে কেন?’’ সংশোধন করে দিয়ে বলতে চান, ‘‘আমি একা নায়ক নই। কত ম্যাচ শাহবাজ বের করে দিয়েছে। ঈশান (পোড়েল) দুর্ষর্ধ বোলিং করেছে। মুকেশ (কুমার) অনবদ্য। মনোজ পঞ্জাব ম্যাচে কী ব্যাট করেছে! আমার দেখা সেরা। নীলকণ্ঠ একটা ম্যাচে দারুণ বোলিং করে গেল। সকলের অবদানের মিলিত ফল ফাইনালে ওঠা।’’ ফাইনাল জিততে গেলে কী করতে হবে? অনুষ্টুপের জবাব, ‘‘ফলের কথা বেশি না-ভেবে নিজেদের সেরাটা দেওয়ার উপরে নজর দিতে হবে। এত দিন ১০০ শতাংশ দিয়েছ। ফাইনালে ১১০ শতাংশ দাও।’’ চেতেশ্বর পুজারা, জয়দেব উনাদকাট? সটান জবাব, ‘‘ফাইনাল হবে দু’টো দলের। ব্যক্তি বনাম ব্যক্তি নয়। বিশ্বাস করি, আমরা পারব।’’

ভূত বলে কিছু হয় না, ভূতের ভয় হয়! সেই কখন তো বলে দিয়েছেন অনুষ্টুপ মজুমদার!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Anushtup Majumdar Bengal Saurashtra Ranji Trophy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE