উচ্ছ্বাস: জস বাটলার আউট হওয়ার পরে কে এল রাহুল, বিরাট কোহালিদের উৎসব। বৃহস্পতিবার। ছবি: এএফপি।
শেন ওয়ার্নের কাউন্টি মাঠে চমকের অভাব নেই। বৃহস্পতিবার, চতুর্থ টেস্টের প্রথম দিন যেমন সুপারহিট দু’দলের ড্রেসিংরুমের ঠিক পিছনেই থাকা ক্লাইম্বিং ওয়াল।
ইংল্যান্ডের এক প্রাক্তন ক্রিকেটার রব কি মনে হল তাঁর দলকে নিয়ে সমস্ত আশাই ছেড়ে দিয়েছেন। এমনই আগুন ঝরাচ্ছেন তখন ভারতীয় পেসাররা। রব-কে ম্যাচ সম্প্রচারকারী চ্যানেলে দেখানো হতে থাকল বার বার। দেওয়াল বেয়ে উঠছেন, হড়কে নেমে আসছেন, আবার ওঠার চেষ্টা করছেন।
তাঁর মতো অনেকেই ভাবতে পারেননি, ইংল্যান্ড অকল্পনীয় ভাবে ম্যাচে ফিরে আসবে। সাময়িক ভাবে তাঁরা ভুলে গিয়েছিলেন এজবাস্টন টেস্টের কথা। দ্বিতীয় ইনিংসে ৮৭-৭ হয়ে গিয়েছিল ইংল্যান্ড। শেষ তিন উইকেটে অসাধারণ লড়াই করে স্যাম কারেন দলের স্কোরকে নিয়ে যান ১৮০-তে। নিজে ৬৩ করার পাশাপাশি শেষ তিন উইকেটে ৯৩ রান যোগ করে প্রথম টেস্টের রংই পাল্টে দিয়ে যান তিনি।
এখানে পরিস্থিতি আরও অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে উঠেছিল ইংল্যান্ডের জন্য। লাঞ্চেই তারা ৫৭-৪। উইকেট তো পড়ছেই, রানও করতে পারছেন না কেউ। ভারতীয় পেসাররা তখন স্বর্ণযুগের ওয়েস্ট ইন্ডিজকে মনে করানোর মতো আগ্রাসী বোলিং করছেন। বহু দিন ধরে ক্রিকেট কভার করা ইংরেজ সাংবাদিকেরাও বলে চলেছেন, এ রকম ভারতীয় বোলিং আক্রমণ তাঁরা কখনও দেখেননি। যেখানে স্পিনের মায়াজালে বেঁধে নয়, গতির আগুনে প্রতিপক্ষকে পুড়িয়ে মারছে ভারত।
আলোচনার শিরোনামে ফের যশপ্রীত বুমরা। নিজের দ্বিতীয় ওভারেই তিনি বিস্ময় বলে ফেরালেন কিটন জেনিংসকে। এত দিন বলা হচ্ছিল বুম বুম বুমরা। এ বার নামকরণ হয়ে গেল, ‘বুমেরাং বুমরা’। তার কারণ বুমেরাংয়ের মতো ঘুরে এসে তা ধরাশায়ী করে দিল জেনিংসকে।
ইংল্যান্ডের ব্যাটসম্যানেরা এত দিন ভাবছিলেন, বুমরার হাতে বাঁ হাতি ব্যাটসম্যানের ইনসুইং অর্থাৎ ডান হাতি ব্যাটসম্যানের আউটসুইংটা নেই। বাঁ হাতি জেনিংস সেটা ধরে নিয়ে কোনও স্ট্রোকই খেলার চেষ্টা করলেন না। গোঁত্তা খেয়ে এসে বল লাগল প্যাডে। ডেভিড গাওয়ার, নাসের হুসেনরা তখন বলে চলেছেন, ট্রেন্ট ব্রিজের পরে যে আট দিনের ছুটি পেয়েছে ভারত, তখনই নতুন এই অস্ত্র তুলে এনেছেন বুমরা।
একটু পরে হরভজন সিংহকে পাওয়া গেল। মুম্বই ইন্ডিয়ান্সে অনেক দিন ধরে বুমরাকে দেখেছেন তিনি। গাওয়ার, হুসেনদের পর্যবেক্ষণ শুনে বলে ফেললেন, ‘‘ধুস। বাঁ হাতি ব্যাটসম্যানের ক্ষেত্রে আগেও এই বলটা করেছে বুমরা। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ক্রিস গেলকেই আউট করেছে এই বলে। ওরা কী যে ভিডিয়ো বিশ্লেষণ করে কে জানে!’’ বোলিং কোচ বি অরুণকে নিয়েও উচ্ছ্বসিত তিনি। বললেন, ‘‘ভারতীয় বোলিংয়ের সাফল্যের নেপথ্যে অরুণের প্রচুর অবদান। এই বোলারদের উঠে আসার সময় জাতীয় অ্যাকাডেমিতে ওদের নিয়ে কাজ করেছেন। সাফল্যের দিনে বোলিং কোচকেও কৃতিত্ব দিতে হবে।’’
হরভজনের কথা একদম ঠিক। দিনের খেলা শেষে বুমরাও একই কথা বলে গেলেন। ক্রিস গেলের উদাহরণ তিনিও দিলেন। আর জেনিংসকে আউট করা বল নিয়ে বললেন, ‘‘স্বপ্নের ডেলিভারি বলব না। টিমের কাজে আসা যে কোনও বলই আমার কাছে ভাল বল। যে কোনও উইকেটই ভাল উইকেট।’’ জানালেন, এতটা সুইং করবে তাঁরাও ভাবতে পারেননি। টিম ঠিক করে রেখেছিল টসে জিতলে ব্যাট করবে। শুনে মনে হচ্ছিল, কখনওসখনও টস হারাটাও অভিশাপ নয়, আশীর্বাদ।
ট্রেন্ট ব্রিজের মতো হ্যাম্পশায়ারের মাঠেও ভয়ঙ্কর ভারতীয় পেস বোলিং। দশ উইকেটের আটটি তাঁরা তুললেন। অশ্বিন বাকি দু’টি। সকালে ১৪ ওভার একটানা বল করলেন বুমরা এবং ইশান্ত। ইংল্যান্ড ব্যাটসম্যানেরা তখন ব্যাটে-বলেই করতে পারছেন না। বুমরার প্রথম স্পেল ৮-১-২০-২। ইশান্তের প্রথম স্পেল ৬-৩-৭-১। ভারতীয় পেস বোলিংয়ের সর্বকালের অন্যতম সেরা প্রদর্শনী হয়ে থাকল সেই সময়টা। এর পর মহম্মদ শামি এসে আরও চাপ বাড়িয়ে দিলেন। ভারতের সুইংয়ের সুলতান তিনি। টেস্ট ম্যাচেও প্রায় ভর্তি স্টেডিয়ামে তখন ভারতীয় সমর্থকদের ‘ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া’ ধ্বনি গর্জন হিসেবে আছড়ে পড়ছে।
কিন্তু ৮৬-৬ হয়ে যাওয়া ইংল্যান্ডকে ম্যাচে ফিরিয়ে আনলেন কারেন। প্রথমে মইন আলির সঙ্গে সপ্তম উইকেটে যোগ করলেন ৮১ রান। নবম উইকেটে স্টুয়ার্ট ব্রডকে নিয়ে জুড়লেন ৬৩ রান। ভারতীয় পেসারদের দাপটে ইংল্যান্ড একটা সময় হয়ে গিয়েছিল ৮৬-৬। সেখান থেকে শেষ চার উইকেটে ১৬০ যোগ করে প্রথম ইনিংসে তুলল ২৪৬। একটা চিন্তা থাকছেই যে, স্যাম কারেনের ১৩৬ বলে ৭৮ (আটটি চার, একটি ছয়) না ম্যাচের টার্নিং পয়েন্ট হয়ে দাঁড়ায়। কুড়ি বছরের অলরাউন্ডার নিজে সাংবাদিকদের বলে গেলেন, ‘‘৮৬-৬ থেকে আড়াইশোর কাছাকাছি তোলাটা নিঃসন্দেহে প্রাপ্তি। আমরা ইতিবাচকই ভাবছি ম্যাচ নিয়ে।’’
আবার মনে হচ্ছে, প্রথম দিনে ভারত যে ১৯-০ স্কোরবোর্ড নিয়ে ফিরল, চার ওভার বল করে অ্যান্ডারসনরা যে কোনও সাফল্য পেলেন না, সেটা কারেন-কামালের পরে ভারতীয়দের মনোবল কিছুটা হলেও মেরামত করে দেবে। রব কি-র দৃশ্যটা খুব প্রাসঙ্গিক লাগতে শুরু করেছে। দেওয়াল বেয়ে উঠছেন, হড়কে যাচ্ছেন, আবার ওঠার চেষ্টা করছেন। টেস্টেরও মনে হচ্ছে সেটাই স্ক্রিপ্ট!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy