প্রহসনের কল্যাণী। মোহনবাগানের অপেক্ষায় লাল-হলুদ ফুটবলার থেকে রেফারি। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস।
কেউ ভেবেছিলেন বিদেমির হাত ধরবেন। কেউ আবার ডাফির। বিক্রমজিৎ, কেন লুইস— তালিকায় বাদ নেই তাঁরাও। ছোট্ট চোখে যে অনেকগুলো স্বপ্ন ঘুরঘুর করছিল! কিন্তু বাস্তবে ঘটল উল্টো।
গোষ্ঠ পাল সরণির দাদারা অনুপস্থিত। হাত ধরলেন না। তাই মাঠেও নামা হল না। কিন্তু চোখের সামনে দেখতে হল, বন্ধুদের মাঠে ঢোকার যাত্রা। মেহতাব, ডং, অর্ণবদের হাত ধরে যখন একে একে মাঠে নামছেন লাল-হলুদের খুদেরা, তখন সবুজ-মেরুন জার্সিধারী খুদে ভক্তরা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাদের দিকে। গোটা কল্যাণী স্টেডিয়ামে উপস্থিত হয়তো ওই এগারো জন মোহনবাগানি-ই। যাদের বুক ফেটে যাচ্ছিল প্রবল কষ্ট আর আফসোসে।
কলকাতা ডার্বি অন্য সব ম্যাচের তুলনায় ব্যতিক্রমী। সব সময়। কিন্তু বুধবারের ডার্বি যে অন্যান্য কলকাতা ডার্বির থেকেও ব্যতিক্রমী! আইএফএ-র দেওয়া প্লেয়ার লিস্টের এক দিকটা ভরা। অন্য দিক ফাঁকা। মাঠের ভিতরে বল এক ইঞ্চি না গড়ালেও একটা দল ম্যাচটা জিতল। একটা দল হারল। তার পরেও ডাগ আউট প্রাণহীন। উচ্ছ্বাস-বিষাদ কোনওটাই নেই। নেই ম্যাচের নায়ককে ধরতে কোনও হুড়োহুড়ি। নেই ম্যাচের খলনায়ককে নিয়ে একটুও ফিসফাস। কর্তারাও শান্ত। উত্তেজনাহীন। হঠাৎ দেখলে মনে হবে, ডার্বি জয়ের আনন্দের মধ্যে যেন অদৃশ্য কোনও যন্ত্রণা তাড়া করছে বিজয়ী শিবিরের সবাইকে। যা হওয়াটা খুব অস্বাভাবিকও নয়।
মোহনবাগানের ওয়াকওভার দেওয়াটা মেনে নিতে পারছেন না ইস্টবেঙ্গল ফুটবলাররাও। হয়তো সে কারণে ঐতিহাসিক টানা সাত বার কলকাতা লিগ জয়ের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েও লাল-হলুদের সবচেয়ে অভিজ্ঞ ফুটবলার মেহতাব হোসেন বলে গেলেন, ‘‘তিন পয়েন্ট পাওয়াটা আনন্দের। তবে সেটা মোহনবাগানকে হারিয়ে পেলে আনন্দের মাত্রাটা আরও অনেক বেড়ে যেত। চার বছর আগেও হাফটাইমের পরে ওরা আর টিম নামায়নি মাঠে। তবু তো কিছুক্ষণ খেলাটা হয়েছিল। কিন্তু আজকের এই ঘটনা বাংলা ফুটবলকে এক ধাপ পিছনে ঠেলে দিল।’’
সবুজ-মেরুন ফুটবলাররা ছিলেন না, ছিল খুদে ম্যাসকটরা। —নিজস্ব চিত্র।
এই অদ্ভুত ডার্বি-পরিবেশ একেবারেই অচেনা বাংলার ফুটবলপ্রেমীদের কাছে। ফাঁকা গ্যালারি। মাঠের ভিতরে ডং-ডাফি যুদ্ধের বদলে মাঠের বাইরে গমগম করে বাজছে ক্যাটরিনা কাইফের ‘কালা চশমা’ গান। ইস্টবেঙ্গল অধিনায়ক অর্ণব মণ্ডল যেমন বলছিলেন, ‘‘এ ভাবে কখনওই জিততে চাইনি আমরা। অন্তত ফুটবলারদের কথা একবার ভাবা উচিত ছিল ওদের অফিশিয়ালদের। আমার বিশ্বাস, ওদের ফুটবলাররাও ডার্বি খেলতে না পেরে হতাশ।’’
সবুজ-মেরুন ফুটবলারদের মনের অবস্থা কী জানা যাচ্ছে না। কর্তাদের নির্দেশে সবার মুখে কুলুপ আঁটা থাকায়। তবে ডার্বি না খেলে তিন পয়েন্ট পাওয়া নিয়ে খুশি নন লাল–হলুদের সহকারি কোচ রিচার্ড ড্রাইডেন। ডার্বি না হওয়ায় বৃহস্পতিবারের প্র্যাকটিস কল্যাণীর মাঠেই সেরে নেওয়ার পরে বলছিলেন ‘‘আমার দু’রকমের অনুভূতি হচ্ছে। তিন পয়েন্ট পেয়ে ভাল লাগছে। কিন্তু ডার্বির উত্তেজনাটা ভীষণ মিস করলাম। ট্রেভরের (মর্গ্যান) কাছে শুনেছি, এই ম্যাচ নিয়ে। আশা করছি, আই লিগে আক্ষেপটা পুষিয়ে যাবে।’’
সেই টিম লিস্টেও এক দিক শূন্য।
সবিস্তার পড়তে ক্লিক করুন।
আই লিগ নিয়ে আবার অন্য রকম কিছু ভেবে রেখেছেন এক জন। গোটা কল্যাণী স্টেডিয়ামে একমাত্র তাঁকেই পাওয়া গেল ডার্বিময় মেজাজে। চনমনে ভাব। তির্যক হাসি হেসে ডু ডং বলে উঠলেন, ‘‘ডার্বিতে গোল করে ম্যাচের সেরা হতে চেয়েছিলাম। আগে যদি জানতাম মোহনবাগান এ রকম একটা পরিস্থিতি তৈরি করবে, তা হলে বলে দিতাম আমার চোট। খেলতে পারব না। তা হলে হয়তো মাঠে নামত ওরা। আই লিগ ডার্বির আগে সেটাই করব ভাবছি!’’
ডং একা নন, মাঠে উপস্থিত প্রাক্তন ফুটবলাররাও বিরক্ত বাগানের সিদ্ধান্তে। গৌতম সরকার যেমন ফের বললেন, ‘‘মোহনবাগান ফুটবল খেলবে না তো কী খেলবে? এই ম্যাচটার দিকেই তো প্রবীর দাশ-তপন মাইতির মতো বাঙালি ফুটবলাররা তাকিয়ে থাকে। আমরাও ডার্বি খেলেই কেরিয়ার তৈরি করেছি। বড় ক্লাবগুলোর ঠান্ডা ঘরে বসে থাকা কর্তাদের বুঝতে হবে, ডার্বি নিয়ে শুধু ইগোর লড়াই করলে চলবে না। এতে অনেক ফুটবলারের ভবিষ্যৎ জড়িয়ে।’’
ভবিষ্যতের কথা ভবিষ্যৎ-ই বলবে। তবে আপাতত মোহনবাগান কর্তাদের গোয়ার্তুমিতে সিদ্ধান্তে ডার্বির গায়ে যে কালো দাগ লেগে গেল, সেটা আর উঠবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy