ফ্ল্যাশব্যাক: বাবার হাত ধরে আগরতলার সাই সেন্টারে ভর্তি হতে গিয়েছিল ছোট্ট মেয়েটা। যেখানে সব বিভাগে সেরা হওয়া সত্ত্বেও তাকে বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল। শুধু ‘ফ্ল্যাট ফুট’ বলে! জিমন্যাস্ট ওই রকম পা নিয়ে সফল হয় না, বলেছিলেন সাইয়ের কোচ।
কাট টু ২০১৪: দু’বছর আগে ইনচিওন এশিয়াডে পায়ে চোটের কারণে কোনও পদক পাননি। ফিরেছিলেন অষ্টম হয়ে। বাড়ি ঢুকেই কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। বাবা-মা ভেবেছিলেন আর বুঝি হল না। কিন্তু অদম্য জেদ আর হাড়ভাঙা প্র্যাকটিস তাঁকে ফিরিয়ে এনেছিল ফ্লোরে-বিমে।
সেই এককালের বাতিল আর কান্নায় ভেঙে পড়া দীপা কর্মকারকে সোমবার ভারতীয় সময় সন্ধ্যে ছ’টা নাগাদ যখন রিওতে ফোনে ধরা হল, তাঁর গলায় জেদ এবং স্বপ্নপূরণের পরে আরও বড় স্বপ্নের মিশেল। ‘‘অলিম্পিক্সে সুযোগ পেয়েছি। আমার স্বপ্ন সফল। এ বার আমার টার্গেট রিও থেকে পদক। প্রত্যেকেই ভাল কিছু করার লক্ষ্যে নামে। আমিও নামব।’’
ব্রাজিলে ততক্ষণে সকালের সূর্য তাপ ছড়াতে শুরু করেছে। আগরতলার অভয়নগরের বছর বাইশের মেয়ের গলায় তারই যেন বিচ্ছুরণ অন্য গোলার্ধ থেকে। ‘‘গ্লাসগোয় বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপেই হয়ে যেত। এত টেনশনে থাকতে হত না। ওখানে একটুর জন্য হাতছাড়া হয়েছিল অলিম্পিক্স কোয়ালিফাইয়ের সুযোগটা।’’ একটু আগেই সরকারি ভাবে জেনেছেন রিওর টিকিট পেয়েছেন। ঢুকে পড়েছেন ইতিহাসে। প্রথম ভারতীয় মেয়ে জিমন্যাস্ট হিসেবে অলিম্পিক্সে! যা গত ৫২ বছরে কোনও ভারতীয় পুরুষ জিমন্যাস্টও অর্জন করতে পারেননি
জিমন্যাস্টিক্সের সবচেয়ে কঠিন ইভেন্ট ভল্টিংয়ে প্রথম। আর বিমের উপরে হাতের চাপে শূন্যে শরীর ছুড়ে জোড়া ভল্ট দিয়ে পারফেক্ট টেন। সেটা আরও কঠিন। পোশাকি নাম ‘প্রোদুনোভা ভল্ট’। কিন্তু সেটাতেই স্পেশ্যালিস্ট দীপা কর্মকার। এবং সেটা করেই ইতিহাসে জায়গা তো আরওই বিস্ময়ের। জাতীয় দলে দীপার এক সময়ের কোচ জয়প্রকাশ চক্রবর্তী বলছিলেন, ‘‘প্রোদুনোভা ভল্ট দিতে গিয়ে কতজনের যে কোমর ভাঙে! প্যারালিসিস হয়ে যায় শরীর! মেয়েদের জন্য তো আরও বিপজ্জনক। কিন্তু দীপা ওটাই দারুণ করে। বিশ্বে মাত্র জনাপাঁচেক মেয়ে এখন ওটা খুব ভাল করছে। সাত বছর আগে মস্কো ডায়নামোর জিমন্যাস্ট কোচ দীপাকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। আমার সামনেই বলেছিলেন, এই ইন্ডিয়ান মেয়েটা অলিম্পিক্স পদক পেতে পারে। ভাল করে নজর দিন।’’
আপনার মেন্টর ও কোচ বিশ্বেশ্বর নন্দীর কাছে শুনলাম আপনি নাকি রবিবার রাতে রিওর স্টেডিয়াম থেকে ফিরেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন? অলিম্পিক্সে সুযোগ পাওয়া নিয়ে এতটা নিশ্চিত ছিলেন কী করে? রিওর জিমন্যাস্ট এরিনা, যেখানে সামনের অগস্টের কোনও এক সকালে দীপাকে নামতে হবে অলিম্পিক্স পদকের সন্ধানে সেখানে এ দিন যাওয়ার পথে দীপা মোবাইল থেকে বলছিলেন, ‘‘জীবনের সেরা পয়েন্ট (৫২.৬৯৮) করেছিলাম তো। জানতাম কোয়ালিফাই করবই। পনেরো তারিখ যখন এখানে এসে নিয়মমাফিক প্রথম বার ফ্লোরে উঠেছিলাম ট্রেনিংয়ের জন্য কেন জানি না মনে হয়েছিল, এ বার পারবই।’’
কিন্তু বিশ্বের ৭৮ প্রতিযোগীর সঙ্গে টক্কর। রবিবার তখনও তো সব ইভেন্টের পয়েন্ট যোগ করে উঠতে পারেননি বিচারকরা! তা সত্ত্বেও এতটা নিশ্চিত ছিলেন? এ বার দীপা — ‘‘দেখুন ভল্টিং ইভেন্টেই প্রচুর পয়েন্ট তুলেছিলাম। জানতাম সব মিলিয়ে হয়ে যাবে।’’ কিন্তু অলিম্পিক্স পদক পেতে তো রাশিয়া রোমানিয়া, চিন, আমেরিকার সেরা জিমন্যাস্টদের হারাতে হবে! ‘‘চেষ্টা করব। আমার কোচ সঙ্গে থাকলে ঠিক সব করে ফেলব,’’ অনায়াস উত্তর ভারতীয় জিমন্যাস্টের।
ছ’বার টানা জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। পরপর দু’টো জাতীয় গেমসে পাঁচটা করে মোট দশ সোনা। বাড়িতে পদকের ভাণ্ডার। সোমবারই রিওতে ভল্টিংয়ে আন্তর্জাতিক সোনা জিতলেন। ইতিহাসের পর ইতিহাস! দীপার সাফল্য-রেখচিত্র প্রায় সর্বদাই পারফেক্ট টেন। রসায়নটা কী? স্বয়ং দীপার ব্যাখ্যা, ‘‘কোচ, আমার কোচ বিশ্বেশ্বর নন্দী। উনি না থাকলে আমি এ সবের কিছুই করতে পারতাম না। কেন দেশের সেরা কোচের রাষ্ট্রীয় সম্মান দ্রোণাচার্য ওকে দেওয়া হবে না বলুন তো?’’ বলতে বলতেই ত্রিপুরা স্পোর্টস কাউন্সিলের স্পোর্টস অফিসার দীপা ফোন ধরিয়ে দেন তাঁর বিশ্বেশ্বর স্যারকে। ছাত্রীর সাফল্যে উল্লসিত গুরু বললেন, ‘‘ওর কখনও কোনও টেনশন ছিল না। রাতে কম্পিটিশন থেকে ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছিল। সব টেনশন যেন আমার। তবে মেয়েটা প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে পারে। ওটাই ওর সাফল্যের আসল কারণ। এক দিনের জন্যও প্র্যাক্টিসে ফাঁকি দিতে দেখিনি।’’
ত্রিপুরার মেয়ে হলেও দীপা কর্মকার বঙ্গললনা। যাঁর সামনে অলিম্পিক্স পদক জেতার হাইওয়ে। লক্ষ্যে পৌঁছতে কী ভাবে এর পর তৈরি হবেন? দীপা জানেন না কিছু। কোচও খোলসা করে কিছু বলছেন না। তবে দীপার বাবা দুলাল কর্মকার আগরতলা থেকে ফোনে ফাঁস করলেন, ‘‘শুনলাম সাই ওকে বিদেশে পাঠাবে। কোথায় সেটা জানি না। ওর কোচই হয়তো ঠিক করবেন।’’ দীপা দেশে ফিরছেন বৃহস্পতিবার। রিওর চূড়ান্ত রেজাল্টের ডেডলাইন আগামী অগস্ট। তা হোক। সোনার মেয়ের জন্য এখনই তো ‘ভুবন ডাঙার হাসি’ নিয়ে অপেক্ষা করে আছে গোটা দেশ।
ইতিহাস গড়লে যা হয়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy