Advertisement
০৫ মে ২০২৪
Athletics

অভাবের সংসার পেরিয়ে স্বপ্নের দৌড় সোনার মেয়ের

বাবা চাষী। অভাবের সংসার। কোচের কথায় শুরু করেন দৌড়। আর তারপর শুরু সোনার মেয়ের স্বপ্নের দৌড়।

সোনা জেতার পর হিমা। ছবি: এএফপি।

সোনা জেতার পর হিমা। ছবি: এএফপি।

রাজীবাক্ষ রক্ষিত
গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০১৮ ১৪:২৩
Share: Save:

গ্রামের মাঠে ফুটবল পেটাতেন। সেখান থেকে গত বছরই ৪০০ মিটার ইভেন্টে দৌড়তে শুরু করা। এমনকী দৌড়োদৌড়িতে হাতেখড়িই হয়েছিল মেরেকেটে বছর দুয়েক আগে। কিন্তু চলতি বছরের মার্চ থেকে জুলাইয়ের মধ্যে একের পর এক নজির গড়ে ইতিহাসে ঢুকে পড়লেন অসমের নগাঁও জেলার ধিঙের দরিদ্র পরিবারের মেয়ে হিমা দাস। যা রূপকথার মতোই!

বাবা ধান চাষী রঞ্জিৎ দাস। মা জোমালি দাস। পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট হিমাকে দৌড়ের তালিম দেওয়া বা ভাল খাওয়া-দাওয়া করানোর মতো সামর্থ্য পরিবারের ছিল না। দেশের হয়ে দৌড়ানো তো দূরের কথা। বাবা অবশ্য ফুটবল খেলতেন। তাই হিমাও বড় হয়ে ফুটবলার হওয়ার স্বপ্নই দেখত। গ্রামের মাঠে স্থানীয় ক্লাবের হয়ে স্ট্রাইকার পজিশনে নামতেন।

কিন্তু মেয়েদের ফুটবলে সুযোগ-সুবিধে তেমন ছিল না। তাই ২০১৬ সালে দৌড় প্রশিক্ষক নিপন দাস বোঝান হিমাকে। বলেন, পায়ের পেশি মজবুত, গতি ভাল, তাই অ্যাথলেটিক্সে নামলে সুযোগ বেশি। খরচও কম। মাঠে একা-একাই দৌড়নোর অনুশীলন করা যায়। গ্রামের মাঠেই কয়েক মাস দৌড়ানোর পর হিমা গুয়াহাটির রাজ্য অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে ১০০ মিটার ইভেন্টে নাম দেন। গুয়াহাটি যাওয়া, থাকার জন্য আর্থিক সাহায্য করেন গ্রামের এক চিকিৎসক। গুয়াহাটিতে হিমা ব্রোঞ্জ পান। সেই শুরু।

এর পর স্কুল পর্যায়ের জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে ১০০ মিটারে ব্রোঞ্জ ও ২০০ মিটারে রুপো জেতা। এবং হায়দরাবাদে অনূর্ধ্ব-১৮ পর্যায়ের জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে সুযোগ পাওয়া। সেখানে ২৪.৮৫ সেকেন্ডে ২০০ মিটার দৌড়ে রুপো পান হিমা। সুযোগ আসে ব্যাঙ্ককের এশিয় যুব চ্যাম্পিয়নশিপ ও নাইরোবির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে।

কিন্তু ৪০০ মিটারে কখনওই নামেননি তিনি। নিপনবাবু জানান, কমনওয়েলথ গেমসে যোগ দেওয়ার জন্য ফেডারেশনে পদক জিততে হত। তাই ২০০ মিটারের পাশাপাশি ৪০০ মিটার দৌড়েও হিমাকে নামানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কয়েক মাস অনুশীলন করেই ফেডারেশন কাপে সোনা!

নিপনবাবুর কথায়, “একেবারে প্রাথমিক পরিকাঠামো আর ন্যূনতম প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েও হিমা মানসিক শক্তি ও প্রতিভার জোরে এই জায়গায় পৌঁছেছে।” তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, মাত্র এক বছর আন্তর্জাতিক মঞ্চে দৌড়াচ্ছেন হিমা। গত মাসেও পোল্যান্ডে জোড়া সোনা পেয়েছেন। কোচের মতে, “আন্তর্জাতিক মঞ্চে যাঁরা দৌড়ায় তাঁরা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বড় মঞ্চের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেয়। অনুশীলন-ডায়েট শিখতে থাকে। কয়েক বছর লাগে সেই প্রস্তুতিতে। কিন্তু একটা দরিদ্র গ্রামের মেয়ে মাত্র এক বছরে এই জায়গা অর্জন করে নিয়েছে। আমি নিশ্চিত এশিয়ান গেমসে দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে ও।”

দেখুন হিমার সোনা জেতার দৌড়।

গত মাসে গুয়াহাটিতে আন্তঃরাজ্য সিনিয়র অ্যাথলেটিক্সে নামার আগেই প্রশিক্ষণের সময় এক মহিলা অ্যাথলিটের অভিযোগে আটক হতে হয়েছিল নিপনবাবুকে। ধাক্কা খান হিমা। আবার ওই প্রতিযোগিতার সময়ই নিজের স্বপ্নের নায়িকা পি টি ঊষার সঙ্গে দেখা হয় হিমার। ঊষা তখন হিমাকে উদ্বুদ্ধ করেন। হিমাকে এখন অনেকেই ভবিষ্যতের ঊষার তকমা দিচ্ছেন। এর আগে এশিয়ান গেমস ও এশিয় চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা পেয়েছিলেন ঊষাও। কিন্তু হিমার মতে, অনেক পথ পেরোনো বাকি।

তবে এই সাফল্যের পর স্বপ্ন দেখছে ক্রীড়ামহল। ভেসে আসছে অভিনন্দন বার্তা। ফিনল্যান্ডে সোনা পাওয়ার পর থেকেই রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে দেশের তাবড় ব্যক্তিত্বের শুভেচ্ছাবার্তায় ভেসে যাচ্ছেন হিমা। রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ টুইটে লেখেন, “কোনও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে এটাই ভারতের প্রথম ট্র্যাক ইভেন্টে সোনা। হিমাকে অভিনন্দন। অসম ও ভারতের জন্য এক গর্বের সময়। এখন অলিম্পিকের পোডিয়াম তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।” শুধু ইংরাজি নয়, হিমার অভিনন্দনবার্তা অসমীয়া ভাষাতেও লেখেন রাষ্ট্রপতি। হিমাকে অভিনন্দিত করে টুইট করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও। তিনি লেখেন, "ভারত আনন্দিত, গর্বিত।" ক্রীড়ামন্ত্রী রাজ্যবর্ধন রাঠৌড় আবার হিমার ইতিহাস গড়ার মধ্যে নারী শক্তির জয় দেখছেন। অ্যাথলেটিক্স ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ার সভাপতি অ্যাডিল সুমারিওয়ালা লেখেন, “এই জয় আমার জীবনের ও ভারতীয় অ্যাথলেটিক্সের ইতিহাসে সবচেয়ে গর্বের ঘটনা। হিমা ও তাঁর প্রশিক্ষকদের ধন্যবাদ।”

আরও পড়ুন: জুনিয়র বিশ্ব অ্যাথলেটিক্সে সোনা জিতে নজির হিমার

হিমাকে অভিনন্দন জানিয়ে টুইট করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি লিখেছেন, “এই সাফল্য অন্য মহিলাদের অনুপ্রাণিত করবে। কিছুই যে অসম্ভব নয়, এই বিশ্বাস জোগাবে।” টুইট করেছেন কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট রাহুল গাঁধিও। ক্রিকেটের দুনিয়া থেকেও আসছে বার্তা। বীরেন্দ্র সেহবাগ, রোহিত শর্মারা টুইট করেছেন। এত অভিনন্দনে আপ্লুত হিমা বলেছেন, “অসম ও ভারতের সকলে যে ভাবে আমায় উৎসাহ দিয়ে গিয়েছেন তার জন্য ধন্যবাদ।”

প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার রাতে অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ৫১.৪৬ সেকেন্ডে ৪০০ মিটার ইভেন্ট শেষ করে সোনা পান হিমা। রোমানিয়ার অ্যান্ড্রিয়া মিকলস ও আমেরিকার টেইলর ম্যানসন যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় হন। শুধু এই প্রতিযোগিতাতেই নয়, যে কোনও বিশ্ব দৌড় চ্যাম্পিয়নশিপে এটাই ভারতীয় মেয়েদের প্রথম সোনা।

১৮ বছরের হিমার অবশ্য এটা মোটেই সেরা সময় নয়। গোল্ড কোস্টে কমনওয়েলথ গেমসে ৫১.৩২ সেকেন্ডে দৌড়েও পদক হাতছাড়া হয়েছিল হিমার। কিন্তু গত মাসে জাতীয় আন্তঃরাজ্য সিনিয়র অ্যাথলেটিক্সে মাত্র ৫১.১৩ সেকেন্ডে ৪০০ মিটার দৌড়ে সোনা পান হিমা। তা ছিল জাতীয় রেকর্ড। ১৮ বছরের হিমা ২০০ মিটার দৌড়েছিল ২৩.১০ সেকেন্ডে। তা ছিল জাতীয় রেকর্ডের সমান সময়। দুই বিভাগেই এশিয়ান গেমসে নামতে চলেছেন তিনি।

আরও পড়ুন: বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়ার বিপ্লবের পিছনে আসল মাথা কিংবদন্তি সুকেরই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE