গ্যালারির রঙ লাল-হলুদ। বারাসতে মঙ্গলবার। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস
ইস্টবেঙ্গলের কাছে বোধহয় কৃতজ্ঞ থাকা উচিত আইএফএ-র! সংগঠকদের কল্যাণে ভারতীয় ফুটবল মানচিত্রে গুরুত্বহীন-হাস্যকর হয়ে ওঠা কলকাতা লিগে গতবারের মতো এ বারও আচমকা উত্তেজনা আনল লাল-হলুদ। তৈরি করল উত্তেজনা।
কলকাতা লিগের এখন এমনই ‘গুরুত্ব’ যে, মোহনবাগান বুক বাজিয়ে বলে দেয়, ডার্বি-ই খেলবে না, ম্যাচটাকে আগের মতো প্রদর্শনীর তকমা দিলে। অথচ সেই লিগের একটা ম্যাচে কীনা শেষ বাঁশি বাজার পর মুহূর্তে মারাদোনা স্টাইলে নিজের বুকে নিজেই মারতে মারতে সমর্থক গ্যালারির দিকে হুড়মুড়িয়ে এগোতে দেখা গেল ট্রেভর মর্গ্যানকে! উচ্ছ্বাসের এ রকম বহিঃপ্রকাশ কখনও দেখা যায়নি ইস্টবেঙ্গলের পেশাদার সাহেব কোচের জয়োৎসবে!
নব্বই মিনিট রোলার কোস্টারে চড়া দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর সাত গোলের যুদ্ধে ম্যাচ শেষ হওয়ার দু’মিনিট মাত্র আগে উইনিং গোল করে উঠেই এক দৌড়ে সটান কোচের কোলে লালরিন্দিকা রালতে! ওরফে ডিকা।
বারাসত স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে লাল-হলুদ সমর্থকদের অসংখ্য মশালের আলোর কাছে তখন মাঠের নৈশালোকও ম্লান তো বটেই। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল লাল-হলুদ রিজার্ভ বেঞ্চে পর্যন্ত! মাঠে ড্রামের প্রচণ্ড আওয়াজ। থোকা থোকা লাল-হলুদ আবিরের ওড়াউড়ি। যে অতিপরিচিত আবহ বেশ কয়েক বছর আগেও দেখা যেত কলকাতা লিগে।
কী ব্যাপার! ইস্টবেঙ্গলের নজিরবিহীন টানা সাত বার খেতাব জয় হয়ে গেল না কি? না, আসলে সেই ইতিহাস গড়ার পথে লাল-হলুদ মঙ্গলবার বিরাট হোঁচট খাওয়া থেকে বাঁচল। দু’বার পিছিয়ে পড়ে, একবার দু’গোলের ব্যবধান ঘুচিয়ে শেষমেশ ৪-৩ জিতল মর্গ্যানের দল। কলকাতা লিগে যে চমকপ্রদ কামব্যাকের অভ্যেস ইস্টবেঙ্গল তৈরি করে ফেলেছে গত মরসুমে বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্যের হাতে। দেখা যাচ্ছে বাঙালি প্রশিক্ষক হটিয়ে ব্রিটিশ কোচ এলেও ইস্টবেঙ্গলের লড়াকু চরিত্রটা একই আছে।
টানা ছ’বার কলকাতা লিগ জিতে চল্লিশ বছর আগের পিকে-র লাল-হলুদের রেকর্ড ছোঁয়ার পথে গত বার ইস্টবেঙ্গল দু’টো ম্যাচ বার করে নিয়েছিল দু’গোলের ব্যবধানে পিছিয়ে পড়ার পরেও। এ দিন সেই আর্মি একাদশ আর কালীঘাট মিলন সঙ্ঘের দশা হল ইউনাইটেড স্পোর্টসের। তবে দু’মরসুমে তিনটে মহাপ্রত্যাবর্তনের রেটিংয়ে এ দিনেরটা শীর্ষে। কারণ ধারেভারে ইউনাইটেড বাকি দুইয়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে। গোলে সংগ্রাম মুখোপাধ্যায়ের মতো অভিজ্ঞ। ডিফেন্সে বেলো রজ্জাকের মতো গত বারও বড় দলে থাকা বিদেশি। সেই ধারালো প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি ১-৩ পিছিয়ে পরার পরে ৪-৩ জেতাটা মোটেও সহজ কাজ ছিল না। তবু শেষ সতেরো মিনিটে তিন গোল করে ইস্টবেঙ্গল। সমর্থকদের ভয়াল চাপ আর মূলত ‘টু হর্স রেস’-এর মিনি লিগে দু’পয়েন্টে পিছিয়ে আশঙ্কা সামলে। শেষ আধঘণ্টা তাই ইস্টবেঙ্গল একটা নয়, তিনটে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে খেলল।
ম্যাচের নাটকীয় মোড় ঘোরার পিছনে অনেকগুলো কারণ। এক) হেভিওয়েট ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে এগিয়ে থাকার পরেও নিজেদের ডিফেন্সে লোক না বাড়িয়ে ওপেন ফুটবল খেলে ডুবল ইউনাইটেড। দুই) টিমে এই মুহূর্তে চাপে থাকা ডু ডং হাফটাইমের পরে নেমে মরিয়া খেলায় ইস্টবেঙ্গলের আক্রমণের ঝাঁজ বাড়ে। তিন) গুরুত্বপূর্ণ সময় বক্সে ডিকাকে বেলোর ফাউলে আশীর্বাদের মতো পেনাল্টি পায় ইস্টবেঙ্গল। ইউনাইটেড স্বাভাবিক ভাবেই রেফারির সিদ্ধান্তে খুশি নয়। চার) ৩-৩ হওয়ার পর ম্যাচের শেষের দিকে আর বড় দলের চাপ সামলাতে পারেনি ইউনাইটেড। পাঁচ) ওই সময়টায় সাইডলাইন থেকে সুব্রত ভট্টাচার্যের কোচিং অভিজ্ঞতাটা মিস করেছেন বেলোরা।
তবে কোচহীন ইউনাইটেডও এ দিন মনোতোষের গোলে এগিয়ে যায়। ডিকা হাফটাইমের পরে সমতা ফেরালেও ন্যায্য পেনাল্টি থেকে ইউনাইটেডকে দ্বিতীয় বার এগিয়ে দেন বেলো। আরও ব্যবধান বাড়ান সুহের। ডং পেনাল্টি থেকে ব্যবধান কমালেও তখনও ‘দিল্লি বহুত দূর’ ইস্টবেঙ্গলের কাছে। পেনাল্টিটা ডিকা মারতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ডং মারতে চাওয়ায় দু’বার ভাবেননি ইস্টবেঙ্গলের জয়ের নায়ক। ‘‘ডং নিজেই বলল, পেনাল্টি মারবে। আজ আমাদের টিমের জয়ের পাশাপাশি ডংয়ের গোল পাওয়াও দরকার ছিল। ও গোলে ফিরলে টিমেরই উপকার।’’ প্রকৃত টিমম্যানের মতোই শোনাচ্ছিল ম্যাচ শেষে ডিকার কথাগুলো। চোট পুরো সারিয়ে ফেলায় যাঁকে এ বার মরসুমের শুরু থেকে নিয়মিত প্রথম দলে সুযোগ দিচ্ছেন মর্গ্যান। যার মর্যাদা রাখতে পেরে উচ্ছ্বসিত ডিকা তাঁর এ দিনের উইনিং গোল উৎসর্গ করলেন ইস্টবেঙ্গল কোচকেই।
ইস্টবেঙ্গল জিতলেও অর্ণব মণ্ডল-সহ ডিফেন্সও প্রচুর প্রশ্ন তুলে দিল। মর্গ্যান সেই ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে গেলেন, ‘‘পুওর ডিফেন্স। তবে আমাকে আশা রাখতেই হবে।’’ কিন্তু লাল-হলুদ সমর্থকেরা কোচের মতো অতটা আশাবাদী হতে পারছেন না!
ইস্টবেঙ্গল : দিব্যেন্দু, ক্যালাম, গুরবিন্দর, অর্ণব, নারায়ণ, নিখিল (প্রহ্লাদ), লালরিন্দিকা, রফিক, অবিনাশ (রবার্ট), আদিলেজা (ডং), জিতেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy